গরিবের অ্যাম্বুলেন্স পরিকল্পনাহীন প্রকল্পে গচ্চা
আব্দুল আওয়াল, বাগাতিপাড়া (নাটোর)
নাটোরের বাগাতিপাড়ায় হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মুমূর্ষু রোগীদের জরুরি চিকিৎসা কেন্দ্রে পরিবহনের জন্য নেওয়া হয়েছিল 'গরিবের অ্যাম্বুলেন্স' প্রকল্প। প্রথম থেকেই সেটি পরিচালনায় ছিল না সঠিক কোনো নিয়ম নীতি। রক্ষণা-বেক্ষণ ও ব্যবহারেও ছিল না তদারকি। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়ে প্রকল্পটি। এতে সরকারের গচ্চা যেতে বসেছে প্রায় সাড়ে নয় লাখ টাকা।
ইউনিয়ন পরিষদ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই অ্যাম্বুলেন্সের প্রতি মানুষের তেমন সাড়া ছিল না। গাড়িগুলোর ব্যাটারি ও যন্ত্রাংশ সচল রাখতে ভাড়ায় সাধারণ মানুষ পরিবহন করা হয়েছে। সেই ক্ষেত্রেও ছিল প্রতিবন্ধকতা। রোগী পরিবহনের গাড়ি বলে মানুষের উঠতে আগ্রহ ছিল কম। এভাবে বছর খানেক যেতে না যেতেই ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যে সবকটি অ্যাম্বুলেন্স অকেজো হয়ে পড়ে। এখন এই অ্যাম্বুলেন্স গুলো ইউনিয়ন পরিষদের সামনে খোলা আকাশের নীচে পড়ে আছে। রোদ-বৃষ্টিতে লোহার তৈরি কাঠামো গুলোতেও মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আরও জানা যায়, প্রকল্পটি গ্রহণের আগে ও পরে কোনো সময়ই কোনো পরিকল্পনা ছিলনা।
উপজেলা নির্বাহী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে স্থানীয় সরকারের উপজেলা পরিচালন ও উন্নয়ন প্রকল্প এবং জাইকার অর্থায়নে কেনা হয় অ্যাম্বুলেন্স গুলো। প্রতিটিতে ব্যায় হয় এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৬৪ টাকা। এতে ৫ টি অ্যাম্বুলেন্স বাবদ মোট ব্যয় হয় ৯ লাখ ৪৩ হাজার ৮২০ টাকা। উপজেলার পাঁকা, জামনগর, সদর, ফাগুয়াড়দিয়াড় এবং দয়ারামপুর ইউপি চেয়ারম্যানদের হাতে ২০১৯ সালের মে মাসে তৎকালীন ইউএনও নাসরিন বানু অ্যাম্বুলেন্সের চাবি তুলে দেন। আর প্রত্যেকটি অ্যাম্বুলেন্সের সাথে চালকের জন্য একটি করে মোবাইল ফোনও দেওয়া হয়।
আরও জানা যায়, ব্যাটারিচালিত এবং ছাদে ঘূর্ণায়মান লাল আলো বিচ্ছুরণের জন্য সাইরেন হর্ন যুক্ত এই অ্যাম্বুলেন্স গুলো স্পেশাল ভাবে তৈরি করা। এর ভেতরে ছিল দুই সিটের গদিযুক্ত আসন, একটি রোগীর শুয়ে যাওয়ার জন্য প্রসস্থ আসন এবং অপরটি সাহায্যকারীদের জন্য অপেক্ষাকৃত চিকন বসার আসন। ২৪ ঘণ্টা সার্ভিসের জন্য অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে মোটা কালিতে লেখা আছে মোবাইল নম্বর। উদ্দেশ্য ছিল, সেই নম্বরে কল দিয়ে ঠিকানা জানিয়ে দিলেই বাড়ির দোরগোড়ায় গিয়ে হাজির হবে অ্যাম্বুলেন্স। এবং নাম মাত্র ভাড়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের গর্ভবতী ও সন্তানসম্ভবা নারীসহ মুমুর্ষু রোগীদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকে আনা-নেওয়া করবে।
ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, কম খরচে গ্রামাঞ্চলের গরিব রোগীদের পরিবহণের জন্য এর নামকরণ করা হয়েছিল "গরিবের অ্যাম্বুলেন্স"। কিন্তু মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়ে এই অ্যাম্বুলেন্স গুলো। ব্যাটারি-মোটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ অকেজো হয়ে পড়ায় সবকটিই এখন পড়ে রয়েছে। প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে অকেজো হয়ে রোদ-বৃষ্টির মধ্যে পড়ে থাকায় অন্যান্য যন্ত্রাংশ গুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকারি কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের নেই রক্ষনা-বেক্ষণের জন্য আলাদা কোন বরাদ্দ।
ফাগুয়াড়দিয়াড় ইউনিয়ন পরিষদের অ্যাম্বুলেন্সের চালকের দায়িত্বে থাকা গ্রাম পুলিশ আকরাম হোসেন বাবু বলেন, অ্যাম্বুলেন্সটি দিয়ে তিনি মোট ২৬ টি রোগীকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ইঞ্জিন চালিত যেকোনো জিনিসই ঘরে পড়ে থাকলে নষ্ট হয়ে যায়, তাই মাঝে মধ্যে সাধারণ মানুষও ভাড়ায় পরিবহন করেছেন তিনি।
জামনগর এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী মাহাতাব উদ্দিন বলেন, এখন প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় বিভিন্ন অটো গাড়ি ও ভ্যান রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের ওই গাড়ির জন্য মানুষ অপেক্ষা করে না। ফলে এটি মানুষের কোনো কাজেই আসে না।
উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা ও বাগাতিপাড়া সরকারি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, এই প্রকল্পের উদ্দেশ্যটি ভালো ছিল। কিন্তু এগুলো ব্যবহারে কোন মনিটরিং ছিল না। রক্ষণা-বেক্ষণেও কোনো গাইড লাইন না থাকাতে এগুলোর ব্যবহার সঠিক হয়নি। এককথায় যে উদ্দেশ্যে অ্যাম্বুলেন্সগুলো দেওয়া হয়েছিল শেষ পর্যন্ত সেটা সফল হয়নি। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের এতগুলো অর্থ যেখানে ব্যয় করা হয়েছে সেখানে জবাবদিহি থাকার দরকার ছিল। কিন্তু এই প্রকল্পে সেটি দেখা যায়নি।
এব্যাপারে বাগাতিপাড়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, প্রথম দিকে কিছু সাড়া পাওয়া গেলেও পরে আর রোগীদের সাড়া পাওয়া যায় নি। আবার অ্যাম্বুলেন্সগুলো ব্যাটারী চালিত হওয়াতে দ্রুত অকেজো হয়ে পড়েছে। ইঞ্জিন চালিত হলে এই সমস্যা হতো না। অপরদিকে কাঠামোগত ভাবে এর ত্রুটি রয়েছে। যেকারণে এই অ্যাম্বুলেন্সে রোগীর সাড়া পাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, এটি পরিচালনায় কোন গাইড লাইন ছিলনা। গ্রাম পুলিশদের মধ্য থেকে একজনকে এই অ্যাম্বুলেন্সের চালকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। রোগীর সাড়া না পেয়ে গাড়িটি সচল রাখতে মাঝে মধ্যে ভাড়ায় সাধারণ মানুষ পরিবহন করা হতো। নষ্ট হওয়ার পরে সরকারিভাবে কোন বরাদ্দ না পাওয়ায় পরবর্তীতে এগুলো আর মেরামতের ব্যবস্থাও নেয়া যায়নি।
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুরাইয়া মমতাজ বলেন, গরিবের অ্যাম্বুলেন্স প্রকল্প সম্পর্কে তিনি কিছুই অবগত নয়। বিধায় এবিষয়ে তাঁর কোনো মন্তব্য নাই।
সাম্প্রতিক মন্তব্য