বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ভীতি ও করোনায় বিচ্ছিন্ন চীন
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাস সংক্রমিত চীনের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ‘বৈশ্বিক জরুরী স্বাস্থ্য পরিস্থিতি’ ঘোষণা করেছে। করোনা ভাইরাসের ছোবল ইতোমধ্যে সার্স-কে ছাড়িয়ে গেছে। গত ১২ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত চীনে করোনা ভাইরাসের ছোবলে মারা গেছেন ১,১১৩ জন। আক্রান্ত হয়েছেন ৪৪,৬৫৩ জনেরও অধিক মানুষ। গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। হংকং-এর প্রধান জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও চিকিৎসক অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েল লুয়াং জানিয়েছেন- যতি আক্রান্ত লোকের এক শতাংশও মারা যায় তাহলে সেই সংখ্যা সাড়ে চার কোটি ছাড়িয়ে যাবে!
চীনের বাইরে ২৮টি দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। চীনে গত একদিনে ৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও তিনজন রোগী করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় কেরালা রাজ্য সরকার এটাকে এক দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। করোনা এখন একটি মহা আতঙ্কের নাম। চীন থেকে ফেরত আসা নিজ দেশের মানুষকে সবাই অজানা আতঙ্ক নিয়ে সন্দেহ করছে। গেল সপ্তাহে চীন থেকে ঢাকায় জ্বর নিয়ে ফেরত আসা একজন রোগীকে করোনা শনাক্ত করার পূর্বেই সারারাত ১০৪ ডিগ্রী জ্বর নিয়ে অমানবিকভাবে কষ্ট করে এয়ারপোর্টে বসে রাত কাটাতে হয়েছে। কেউ তাকে দ্রæত হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। আটকে পড়া নিজ নাগরিকদেরকে চীন থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত আনা শুরু করেছে দেশটি। তাঁরা তাদের ৬০০ জন নাগরিককে মূল ভূমিতে সরাসরি ফেরত না এনে ক্রিসমাস দ্বীপে দু’সপ্তাহের জন্যে কোয়ারেনটাইনে রাখার পরিকল্পনা করেছেন। উল্লেখ্য, ক্রিসমাস দ্বীপটি অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখন্ড থেকে ৭০০ কি,মি.দুরে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া বলেছে যে, সাম্প্রতিককালে চীন সফর করেছে এমন লোকদেরকে তারা নিজ দেশে প্রবেশ করতে দিবে না।
চীনের লি ওয়েনলিয়াং নামের যে চিকিৎসক সর্বপ্রথম প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস সম্পর্কে বিপদের সতর্কবাণী করেছিলেন তিনিও এই ভয়ংকর ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা গেছেন। একজন সতর্ক চিকিৎসক এই ভয়ংকর ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কেউ কেউ বলছেন করোনা ভয়ংকরাতা প্রকাশ করায়- তাঁকে হত্যা করা হয়েছে! এটা আরো বেশী আতঙ্ক যুক্ত করেছে। চীনের একজন বাবা কোয়ারেন্টাইনে থাকায় বাড়িতে পক্ষাঘাতগ্রস্থ ১৭ বছরের কিশোর সন্তান খাবারের অভাব মারা গেছে বলে সংবাদে জানা গেছে। সে সারাক্ষণ হুইলে চেয়ারে বন্দী হয়ে বাড়িতে একা থাকতো। সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- এ যেন এক মহা মানবিক বিপর্যয়।
করোনা ভাইরাস নামকরণটি এসেছে এর আকৃতির ওপর ভিত্তি করে। অতি শক্তিশালী মাইক্রোসকোপে করোনা ভাইরাস দেখতে ক্রাউন বা মাথার মুকুটের মত। তাই এর নাম দেয় হয়েছে করোনা। করোনা এখন সারা বিশে^ এক মহা আতঙ্কের নাম।
ভয়াবহ সংক্রমণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় হাসপাতাল সংকট নিরসনে চীন সরকার ১০ দিনের মধ্যে ‘ফায়ার গড মাউন্টেইন’ নামক হাজার শয্যা বিশিষ্ট অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরী করে ফেলেছেন। সেখানে এক হাজার চারশত সেনা চিকিৎসক সেবা দিবেন।
এছাড়া করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকায় উহান প্রদেশের ঝিয়াংজিয়া জেলায় ‘থান্ডারগড মাউন্টেইন’ নামক ১৬০০ আসন বিশিষ্ট আরকেটি অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে।
চীন সরকার করোনা ভাইরাস আক্রান্ত কোন রোগীকে চীন থেকে ছাড়া হবে না মর্মে জানিয়েছে। অনাক্রান্ত বাংলাদেশী ৩১২ জনকে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। তাদেরকে দেশে আনার জন্য খরচ হয়েছে ২ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা। তাদেরকে আগামী ১৪ দিন হাজীক্যাম্পে কোয়ারান্টাইনে থাকতে হবে। দেশে ফেরত আসার জন্য চীনে আরো শুধু ১৭১ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী এখনও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
এ পর্যন্ত মোট ২৮টি দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হবার সংবাদ পাওয়া গেছে। অন্য কোন দেশে যেতে পারছেন না চীন ফেরত বিমানের পাইলট ও ক্রুগণ। চীন ভ্রমণে যেতে ইচ্ছুক বিভিন্ন দেশের ভ্রমণকারীগণ তাদের হোটেল বুকিং, এয়ার বুকিং ও ক্রয়কৃত টিকিট বাতিল করেছেন। নতুন করে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হবার আশংকায় ২৭টি দেশ তাদের চীনগামী এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল করায় চীন বিশ্ব থেকে মোটামুটিভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হবার জন্যে চীনের সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে। চীনা অর্থনীতিবিদগণ আশংকা প্রকাশ করেছেন, তাদের বড় বড় অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবার ফলে দেশটির ৬২ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হবে।
এদিকে করোনা সংক্রমণ নিয়ে অভিযোগ ও অসহযোগিতার কথা এই মানবিক বিপর্যয়কে আরা বেশী বিপদসংকুল করে তুলছে বলে বিশিষ্টজনেরা মনে করছেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র হুয়াচুন ইং বলেছেন- যুক্তরাষ্ট্র এই বিপদে সাহায্য দেয়ার পরিবর্তে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তারা সহযোগিতা না করে চীন ভ্রমণকারীদেরকে সীমানা বন্ধ করে সে দেশে ঢুকতে না দেয়ার নিষেধাজ্ঞার ফলে বরং আরো বেশী করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে।
করোনা সংক্রমণ নিয়ে আমেরিকার অসহযোগিতা করার পাশাপাশি রাশিয়া তাদের টিভিতে চীন বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে বলে চীন অভিযোগ করছে। চীন সরকার সংক্রমণ কমাতে তাদের বিশ হাজার করোনা রোগীতে হত্যা করবে বলে আইনগত অনুমতি প্রার্থনা করেছে-এমন অমানবিক কথাও সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে!
সুযোগ পেলে মানবতার জয়গান আমরা সবাই গেয়ে থাকি। একটু গভীরে গেলে যুগে যুগে এই জয়গানের জন্য কিছু মানুষের মরণপণ চেষ্টার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। ভয়ংকর করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মত জরুরী অবস্থায় আমাদের সবাইকে প্রথমত: প্রতিরোধ ও পরবর্তীতে এর মরণ থাবা থেকে মুক্তির জন্য দ্রæত সম্মিলিতভাবে আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করার কোন বিকল্প নেই। চীনের এই বিপর্যয় তাদের শুধু একার- এটা ভাবলে আমাদের সবার ভুল হবে। এই সবুজ সুশোভিত বিশ্বটা সবার বাড়ি। বিশ্বব্রম্মান্ডের ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা উষ্ণতা নিত্য নতুন প্রাণঘাতী ভাইরাসের জাগরণ সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। শতাব্দী প্রাচীন ভাইরাসগুলো মানুষের কুৎসিত জীবনাচার ও অসতর্কতায় জীবনসংহারী হিসেবে পুন: আবির্ভূত হয়ে ঘাতকের ভূমিকা পালনে প্রতিনিয়ত তৎপরতা চালাচ্ছে।
তাই আমাদের আশু বোধদয় হওয়া দরকার। এই বিশ্ববাড়ির সকল বাসিন্দাদের সুখ-দু:খের ভাগীদার হয়ে সবার জীবন রক্ষা করা আমাদের সমষ্টিগত দায়িত্ব। একটি বাড়িতে আগুন লাগলে তার লেলিহান শিখা পাশ্ববর্তী সকল অলস-অসতর্ক মানুষের বাড়ি-ঘরকেও ক্ষমা করবে না। আধুনিক সভ্যতার চরম শিখরে এসেও মানুষকে ভাবতে হবে তারা প্রকৃতির প্রতিশোধের কাছে কত অসহায়। তাই এখন অহেতুক ভীতি ছড়িয়ে, বিতর্ক করে সময় নষ্ট না করে বিশ্ব মানবতার জীবন রক্ষার্থে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর প্রতিরোধ ও নির্মূলে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য