ডব্লিউএইচও-র অনুমান ও ঢাকা গবেষণায় কোটি সংক্রমণ
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ রিপোর্ট (অক্টোবর ০২, ২০২০) অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার মোট জনসংখ্যা হলো দুই কোটি পাঁচ হাজার আটশত ষাটজন। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কি.মি.-তে ২৮৪১০ জন। ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩.৬০%। এই হার কমে গিয়ে ২.১% হলেও ২০৩৫ সালে এর জনসংখ্যা তিন কোটি পনের লাখে দাঁড়াবে বলে অনুমান করা হয়েছে।
১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল তিন লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার সাতশত ষাট জন এবং ২০১৬ সালে সেটার সংখ্যা গিয়ে পৌঁছায় এক কোটি আশি লাখের কোটায়। এবছর দুই কোটি পার হবার অর্থ হলো- প্রতিবছর পাঁচ লক্ষ নতুন মানুষ ঢাকার মোট জনসংখ্যার সাথে যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ভাসমান মানুষের সংখ্যা এই হিসেবের মধ্যে ধরা হয়নি।
গত ১২ অক্টোবর ২০২০ ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএইড এবং বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন কর্তৃক আর্থিক সহায়তায় করা গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের দেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-র যৌথভাবে করা এক গবেষণার তথ্য প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলা হয়, এন্টিবডি পরীক্ষায় পাওয়া গেছে ঢাকার ৪৫ শতাংশ মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ঢাকার বস্তিগুলোতে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৪ শতাংশ মানুষ। ঢাকার সংক্রমণ দিল্লীর চেয়ে বেশী। কারণ, দিল্লীতে ৩৩ ভাগ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন।
গবেষণার জন্য রাজধানী ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৫টি ওয়ার্ড বেছে নেওয়া হয়। প্রতিটি ওয়ার্ডের মধ্যে একটি মহল্লা বাছাই করে ১২০টি বাড়ি এই জরিপে নেওয়া হয়। জরিপ চলে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত। গবেষকরা বলেন, এই গবেষণা করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, রোগীদের চিকিৎসা এবং ভবিষ্যতে ভ্যাক্সিন দেওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে।
এই গবেষণার তথ্য অনুযায় বলা যায়- ঢাকার প্রায় অর্ধেক মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত। তাহলে তারা সংখ্যায় মোট কতজন? তারা মোট এক কোটি দুই হাজার নয়শত তিরিশ জন। অর্থাাৎ, গত মার্চ থেকে অক্টোবর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ঢাকায় কমবেশী এক কোটির অধিক মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন! আমাদের সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত জানানো হয়েছে- দেশে এখন পর্যন্ত করোনা রোগীর মোট সংখ্যা ৩,৮১,২৭৫ জন। তার মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ২,৯৪,৩৩১ জন। মারা গেছেন ৫,৫৭৭ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার হিসেব অনুযায়ী অক্টোবর ১০, ২০২০ পর্যন্ত মারা গেছেন দশ লাখ সাতষট্টি হাজার এবং আক্রান্ত হয়েছেন তিন কোটি আটষট্টি হাজার মানুষ। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার অনুমান, এপর্যন্ত পৃথিবীর আশি কোটি মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন। বহু মানুষ আক্রান্ত হয়ে নানা কুসংস্কারের ভয়ে নিজেদেরকে গোপন রেখেছেন। অনেকে অজান্তে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে আরোগ্য লাভ করলেও নানা জটিলতায় ভুগছেন।
এর অর্থ দাঁড়ায়- করোনা সংক্রমণের তথ্যে ব্যাপক গড়মিল সব জায়গায়। মানুষের মধ্যে এই রোগ সম্পর্কিত তথ্য প্রবাহের ওপর কোথাও সঠিক হিসেব পাওয়া যায় না। অথবা করোনার প্রভাবে সবাই নানাভাবে নিজেকে লুকিয়ে রাখছে। দেশে বিদেশে করোনা তথ্য নিয়ে লুকোচুরি করার বদনাম সেই শুরু থেকেই পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রকাশিত তথ্যে কোথায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা তিন কোটি আর তাদেরই অনুমান, কোথায় এপর্যন্ত পৃথিবীর আশি কোটি মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন। কেন এত বিভ্রাট? কেন এত বৈপরীত্য?
সরকারীভাবে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে কোথায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখ উনআশি হাজার সাতশত আাটত্রিশ জন আর আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআরবি-এর যৌথভাবে করা গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ঢাকার ক্ষেত্রে কোথায় শুধু ঢাকা শহরেই এক কোটির অধিক !
আমরা এখন কোথায় যাব? করোনা তার কারিশমায় সারা পৃথিবীটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছে। অথচ, মানুষ সেই সংবাদটির সঠিক তথ্য আজ সঠিকভাবে প্রকাশ করতে জানে না! জানলেও ভুল জানে, মিথ্যে জানে। অথবা প্রকাশ করলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিক নয়।
হায়রে মানুষ! হায়রে মানুষের সীমাবদ্ধতা! প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার আশরাফুল মাখলুকাত মারা যাচ্ছে বলে যে সংবাদ বের হচ্ছে সেটাও তাহলে সঠিক নয়, ঢেড় বেশী। কারণ, করোনায় মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করার জ্ঞান ও বাস্তবতা মানুষের ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে বলে উপরিউক্ত তখ্য থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে!
উক্ত গবেষণার মাঠতথ্য (খানা) সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ তথা গবেষণাকাল ছিল- মধ্য এপ্রিল থেকে আগষ্টের শেষ পর্যন্ত। গবেষণাকাল শেষ হবার প্রায় দেড়মাস পরে যখন সাধারণ মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে বাইরে বের হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে তখন এই তথ্য প্রকাশিত হলো। বিশেষ করে ধর্ষনের আন্দোলন শুরুর পূর্বে তা প্রকাশিত হলে মানুষ সতর্ক হতো। অথচ, এই তথ্য প্রকাশিত হলো ধর্ষনের আন্দোলন চলার উত্তাল সময়ে। যখন সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমে আসায় মানুষের করোনাভীতি আপাতত: কেটে যাচ্ছে। তাই এ মুহুর্তের সামাজিক বাস্তবতায় এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ চলছে।
এছাড়া উক্ত গবেষণার তথ্য প্রকাশ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, “দেশ কি হার্ড ইমিউনিটির (গণরোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠা) পথে? আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরি বলেন, হার্ড ইমিউনিটি গড়ে ওঠার কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। সংক্রমিত ব্যক্তিদের শরীরে কত দিন অ্যান্টিবডি থাকবে, তা–ও নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না” (প্রথম আলো ১৩.১০.২০২০)।
করোনায় মানুষের ভ্রমের ঘোরটাও দখল হয়ে গেছে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিকাশ ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে বড়াই করে মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যে লাফালাফি করছে সেটাতেও কোন কার্যকরী সুফল নেই। রোবটকে আইকিউ দিয়ে চাবি টিপে দিয়ে দিলেও ও শিখে দেয়া বুলি অনুযায়ী কিছু সীমাবদ্ধ কাজ করতে পারে মাত্র। কারণ, ওর তো কোন রক্ত নেই, নার্ভ নেই। ও কাউকে খামচাতে পারলেও নিজে প্রাকৃতিক আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। নাচতে পারলেও মদ খেয়ে মাতাল হয়ে কাউকে ধর্ষনের জন্য আক্রমণ করতে অপারগ। রোবট মানুষের নি:সঙ্গতার সাথী হয়েছে বলে বেকুব মানুষ প্রচার শুরু করে দিলেও সে কি বিয়ে করতে পারে? ওদের বাস্তবতা ও প্রাকৃতিক জ্ঞান নেই। ওরা এখনও বিয়ে বা টয়লেট করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। যেদিন তা করবে সেদিন হয়তো ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা শুরু হয়ে যাবে। তখন সমাজে আর কোন মাদক থাকবে না, ধর্ষনকারী থাকবে না, কোন অপরাধীও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পৃথিবীব্যাপী এ ঘোরপ্যাঁচটা তাহলে ধূর্ত মানুষগুলোই তৈরী করেছে। প্রতিনিয়ত মিথ্যে, চুরি-ডাকাতি, অসততা, দুর্নীতি, বেঈমানী করে এমন এক বৈরী পরিবেশ তৈরী করেছে তারা। সেটা থেকে এখন মুক্তি খুঁজতে গিয়েও নাকাল হচ্ছে। ফঁন্দিবাজ মানুষ মিথ্যের বেসাতি সাজিয়ে পৃথিবীটাকে রোজ কিয়ামতের নাগালে নিয়ে গেলেও এখনও সততা ও অসততার মাঝে বিরাট ফাঁরাক নিয়ে হামবরা জীবন যাপন করতে হন্যে হয়ে সামনে চলতে চাইলেও কে একজন যেন সেটা আর করতে দিতে নারাজ! সেই কে-টা কে? তা আর চিনতে দেরী করাটা বোকামী হবে বৈকি? কারণ তিনি প্রচারিত তথ্যের মধ্যে হু-এর আশি কোটি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হবার অনুমান ও এবং ঢাকার গবেষণায় প্রাপ্ত এক কোটি সংক্রমণ কোনটার সাথে এতদিনের প্রচারিত তথ্যের গড়মিল, বৈপরীত্য বা জালিয়াতি পছন্দ করেন না। সবকিছুতে সীমা লঙ্ঘণ করাটা তার বড্ড অপছন্দ। বার বার সীমা লঙ্ঘণকারীর জন্য শাস্তির ধরণটা কী হবে তা এখানে বলাই বাহুল্য। তিনি বার বার বলেছেন- তোমরা জেনেশুনে সত্য গোপন করোনা- আর সীমা লঙ্ঘণ করোনা।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য