আমার করোনাকাল
ফরাজী আহম্মদ রফিক বাবন।।
আলহামদুলিল্লাহ। অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। নমুনা দেওয়ার এক সপ্তাহ পরে মোবাইল ফোনে নেগেটিভ ফলাফলের বার্তা পেলাম। আর এক মাসের গৃহবন্দীকালের অবসান ঘটেছে। তবে আগেই শরীর জানান দিচ্ছিল, আমি কোভিড-১৯ ভাইরাসমুক্ত। মহান আল্লাহ আমাকে দয়া করেছেন। প্রতিদিন কতো মানুষের সংক্রমণ ঘটছে। তাদেরকে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। কৃত্রিম অক্সিজেন নিতে হচ্ছে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল। এসব বিবেচনায় আমি সৌভাগ্যবান। বাড়িতে আইসোলেশনে সময় কাটিয়েছি। পড়াশুনা, কোপা আমেরিকা, কাংখিত ইউরো-২০২০, উইম্বলডন সঙ্গ দিয়েছে। আমাকে সঙ্গ দিয়েছে আমার প্রিয়তম বউ। সঙ্গ না ছাড়াতে শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে করোনাতে। ভালবাসার জয় হলো। আইসোলেশনে থেকে আশ্চর্য হতে হলো, আমার বড় মেয়ে আলভি’র নিজের ডিস্কে সকল খেলা আর খেলোয়াড়দের তথ্য কিভাবে থাকে? আর মাত্র ক্লাস ফোরে পড়ুয়া ছোট মেয়ে মুনতাহা প্রতিদিন নিজের হাতে সবার জন্যে আয়ুর্বেদিক চা বানিয়েছে, বাষ্প বানিয়েছে। ছোট ভাই বাপী বাজারের অভাব পুরন করেছে। অনেকের সমবেদনায় আপ্লুত হয়েছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাড়িতে বিশাল ফলের ডালি পাঠানো হয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্য মোর্শেদ মামা ফুল আর ফলের ডালি পাঠিয়েছেন। শ্বশুড়বাড়ির খাবারে ভরপুর হয়েছে বাড়ি। সংসদ সদস্য শিমুল ভাই নিয়মিত খোঁজ নিয়েছেন। আমাকে সাহস যুগিয়েছেন নাটোর থেকে সদ্য বদলী হয়ে যাওয়া নন্দিত জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ শাহরিয়াজ এবং বর্তমান জেলা প্রশাসক জনাব শামীম আহমেদ। প্রতিদিন ফোন দিয়েছেন বড়ভাই, প্রিয় বন্ধু এয়ার কমোডর মাহবুব আর দরদী বন্ধু আমিনুল আর এলপিআরে যাওয়া জেলা তথ্য অফিসার মিজান ভাই।
তবে বিপরীত অভিজ্ঞতাও আছে। অনেকেই শত গজ দূরে হলেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, জানালাটা বন্ধ করে দিয়েছেন। বাড়ির উঠোনে এসে কাজ করা আমাদের বাড়ির কর্ম সহায়ক আপাকে আল্টিমেটাম দিয়ে কাজ বন্ধ করিয়েছেন কেউ কেউ। আবার অতি উৎসাহী কেউ পারলে আমার বাড়িটাই যেন সীল করে দেয়! বিনিময়ে মহান আল্লাহ আমার ধৈর্য্য আর সহ্য শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছেন।
১৬ জুন ভোরে প্রচন্ড মাথা ব্যথা। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা। একটার পর একটা পেইনকিলার ফেল করতে শুরু করলো। সাথে হাড় কাঁপানো শীত। বুঝলাম, সামথিং রঙ। পরদিন নমুনা দিয়ে হাতে হাতে ফলাফল। আমি পজিটিভ। তিন দিন পরে জ্বর পালালো, সাথে গন্ধ হারালাম। মনেহলো, নাকের মধ্যে কিছু একটা আবর্জনা ঢুকেছে। এই আবর্জনার গন্ধ আছে। আবিষ্কার করলাম, করোনার গন্ধ খানিকটা শুটকি মাছ রান্নার গন্ধের মত। প্রথম দিন পাশের বাড়িতে শুটকি রান্না হচ্ছে মনেকরে, সব জানালা বন্ধ করে দিয়েছিলাম!
বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে পেছনের পুকুর পাড়ে দাঁড়ানো প্রিয় হিজল ফুলের গন্ধ নিতে চাই। কিন্তু গন্ধ নেই। গেটের উপরের মাধবীলতা নামে পরিচিত মধু মঞ্জুরী লতার মাতাল করা গন্ধ এক মাসের বেশী সময় ধরে আর পাইনা। গন্ধের নিইরনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল ? দুই সপ্তাহ ধরে বিরক্তিকর শুটকির গন্ধ বিদায় হলেও স্বাভাবিক গন্ধ তখনো ফিরে আসেনি। তবে এখন মাঝে মাঝে নতুন ধরণের গন্ধ পাই। সুগন্ধ। তবে এই গন্ধ মনেহয় পৃথিবীর নয়! আমি এখনো জানিনা, আমার গন্ধের নিউরনগুলো কবে আমাকে সারপ্রাইজ দেবে। ঢাবিয়ান কাজিন প্রীতি বলেছিল, তীব্র গন্ধের বস্তু থেকে যেন গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করি। সবই বিফল হয়েছে। প্রায় ৪০ দিন হতে চললো আমি গন্ধবিহীন পৃথিবীতে বাস করছি।
আমার করোনাকালে খাবারের স্বাদ-গন্ধ না থাকলেও রুচি কখনো হারাইনি। প্রচন্ড পিপাসায় কাতর হয়েছি। ঐ অবস্থায় অক্সিমিটার রিডিং দিয়েছে, অক্সিজেন লেভেল নীচে নামছে। পানি খাওয়ার পরে সব ঠিক! পানির অক্সিজেন শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণ করেছে কি না জানিনা।
এখন আমি করোনা ভাইরাস আক্রান্তের রহস্য খুঁজে বেড়াই। সাংবাদিকতা কিংবা ব্যবস্থাপনা পড়ানোর সুবাদে প্রায় সব কিছুতেই অব্যবস্থাপনা দেখতে পাই। এভাবে আমার আচরণটা হয়ে উঠেছিল নেগেটিভ এটিচ্যুডের। তাই হয়তো পজিটিভ এটিচ্যুডের হওয়ার জন্যে অথবা বদলে যাওয়া পৃথিবীর উপযোগী হওয়ার জন্যে, করোনায় বাস করার অভিজ্ঞতা পেতে কিংবা অথবা বিস্তৃত হওয়া মৃত্যু চিন্তাকে স্মরণে রাখতে এই আক্রান্ত হওয়া। অকৃতজ্ঞ আমি, মহান আল্লাহ্র নিয়ামতরাজির মধ্যে ডুবে থাকলেও কৃতজ্ঞ হই না। বিনামুল্যের অক্সিজেন যে কত মূল্যবান, পানি যে কত প্রয়োজন কিংবা গন্ধ থাকাটা কত জরুরী-এই বোধে শাণিত হতেই হয়তো করোনাতে আক্রান্ত হয়েছি। মহান আল্লাহ সকলের সহায় হোন।
* ফরাজী আহম্মদ রফিক বাবন: সাংবাদিক ও অধ্যাপক।
সাম্প্রতিক মন্তব্য