দুয়ার খোলার দ্বিমুখী নীতি ও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
গত বছরের জুন মাসের প্রারম্ভে করোনার ঘনঘটার মধ্যেই আমাদের দেশে শিল্প-কারখানা, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা ইত্যাদি সকল প্রতিষ্ঠানের দরজার তালা খুলে কাজকর্ম শুরু হয়েছিল। অর্থনীতি সচল রাখার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। জীবন বাঁচাতে জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে পোশাক শিল্পকারখানাকে খোলার কখা বলা হলেও আসলে পূর্বের নেয়া বড় বড় অর্ডার নষ্ট হবার ভয়টা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পেয়ে বসেছিল। শ্রমিকরা পেটের দায়ে জীবনমায়া তুচ্ছজ্ঞান করে কাজে যোগ দিয়েছিলেন।
একের পর এক ফ্রি-স্টাইলে সকল সরকারী-বেসরকারী অফিসের বদ্ধ দুয়ার খুলে কাজকর্ম শুরু করা হয়েছিল। শুধু খুলেনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বন্ধ ফটক। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অফিস শেষে বাড়িতে ফিরে স্বাস্থ্য বিধি মেনে পরিবারের সাথে বসবাস করে আসছিলেন। শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন পাঠদানের প্রচলণ শুরু করে দেয় বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেটাকে কিভাবে শুরু করবে ভেবে দিশেহারা হয়ে চিন্তা করতেই সাতমাস পার করে দিয়েছিল। এরপর ইউজিসির নির্দেশনায় নানা সুবিধার কথা বলে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয় অনলাইন পাঠদান। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গরীব শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশী হওয়ায় এবং তারা বেশীরভাগ গ্রামীণ দূর-দূরান্তে বসবাস করায় অসুবিধায় পড়ে যায়। বিদ্দুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় এবং প্রয়োজনীয় স্মার্ট ডিভাইস কিনতে না পারায় দরিদ্র গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের হিমশিম কেতে হয়। এভাবে ৬০ ভাগ দরিদ্র গ্রামীণ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাশে অংশগ্রহণ করতে না পেরে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত থেকে যায়।
এরপরও লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত দরিদ্র গ্রামীণ শিক্ষার্থীর কথা বিবেচনায় না এনে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেয়ার প্রবণতা শুরু হয়ে যায়। এটা শহুরে এবং গ্রামীণ সচ্ছল শিক্ষার্থীদের চাকুরীর বয়সসীমা পার হয়ে যাবার আশঙ্কার জন্য মন্দের ভাল বিবেচিত হচ্ছিল। সেটাও হঠাৎ এক এক হঠকারী ঘোষণায় বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে তারা চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে। তখন দেশে করোনার প্রকোপ কমে এলেও পরীক্ষা নেবার ব্যবস্থা না করে এসএসসি ও পূর্বতন অষ্টম শ্রেণির ফলাফলের সংগে-গড় করে অটোপাশ দিয়ে এইচএসসি পাশ সামলানোর চেষ্টা করা হয়। এভাবে ২০২০ সাল পার হয়ে গেলে চিন্তা আরো বেড়ে যায়।
২০২১ সালের শুরুটা ভাল মনে হলেও গত মার্চের ৮ তারিখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেগুলোর বন্ধ ফটক খুলে দেয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। মার্চের শেষে স্কুল-কলেজ ও মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার সরকারী ঘোষণা দেয়া হলেও হঠাৎ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ হানা দেয়ার প্রবণতায় মৃত্যু ও সংক্রমণ বেড়ে যায়। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতে পারে বলে সংশয় তৈরী হয়ে যায়। কিন্তু সেই দুর্বল অটোপাশ এইচএসসি ফলাফল দিয়ে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির চেষ্টা অব্যাহত থাকে। শুরু থেকে সারা দেশের অন্যসকল প্রতিষ্ঠান খুলে কাজকর্ম চলমান থাকলেও করোনা ঝুঁকির দোহাই দিয়ে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুয়ার খোলার দ্বৈত নীতির জুজু চেপে বসে। এভাবে আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা এখন অদৃশ্য ভাইরাসের ন্যায় অজানা শণির দশায় দোদুল্যমানতায় নিপতিত হয়ে গেছে।
এটাকে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখে চলেছেন। নানা বিরুপ সমালোচনা করার নানা হেতু রয়েছে। কারণ, শিক্ষার্থীরা করোনাকালে ঘরে বসে নেই। ফ্রি-স্টাইলে ব্যবসা চালু হওয়ায় গণপরিবহণ, গণঅনুষ্ঠান, পৌরসভাসহ বিভিন্ন ভোটগ্রহণ, পিকনিক, বিয়ে, খাৎনা, জন্মদিন, বৌভাত, জানাজা, পার্ক, সিনেমা, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, মিটিং-মিছিল, বইমেলা ইত্যাদিতে দলবেঁধে ঘুর বেড়াচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় আবহ ও বইমেলা পাশাপাশি শুরু হয়েছে-যা সংশয়ের ব্যাপার। মেলা ও বাজারে গিজ্ গিজ্ করে গায়ে গায়ে ঘেঁষে চলছে কেনাকাটা। বই মেলায় স্বাস্থ্যবিধির কথা বলা হলেও মানুষে মানুষে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা যাচ্ছে না। মেলা চত্ত্বর বাড়ানো হলেও মানুষ বেড়েছে বহুগুণ। মেলার ভিতরে কেনাকাটা ও গান-বাজনা শোনার সময় এত ব্যস্ত মানুষের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করবে কে? তার কোন উপায় ঠিক করা হয়নি। ফলে বই মেলায় স্বাস্থ্যবিধির কথা বলাটা অমূলক বৈকি?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস বন্ধ, কিন্তু দলবেঁধে ক্যাম্পাসে চলছে ঘোরাঘুরি, বসে বাদাম চিবুনো, চা-সিগারেট পান করা। দোকানীর মুখে নেই মুখোশ, সেসব খদ্দেরের মুখে চটপটি, ফুসকা, আইসক্রীম আরো কত কী! অফিস খোলা, নির্মান কাজ চলছে তাই ক্যাম্পাস সবধরণের মানুষের পদচারণায় ভরপুর।
তরুণদের মুখোশ ছাড়া চলাচলে কোন বিধিনিশেধ নেই যেন। স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রণের কথা শুধুু টিভিতে শোনা যায়। একদল মানুষ মুখোশ ছাড়াই ঘেঁষাঘেষি করে গান-বাজনা, নৃত্যগীত করে করোনার ড্রপলেট বাতাসে ছড়াচ্ছে। আরেকদল করোনার ড্রপলেট গ্রহণের ভয় উপেক্ষা করে পাশে বসে হাততালি দিচ্ছে। সেগুলো টিভিতে বারবার প্রচারিত হচ্ছে। অথচ করোনার ড্রপলেট নাকি বাতাসে ১২ ফুট লাফিয়ে বেড়ায়!
সরকারী নীতিনির্ধারকগণ অনুমতি নিয়ে নাকি সেটা করছেন। মানুষ এসব দ্বিমূখী নীতির ব্যবহারিক দিক ঘরে বসে উপভোগ করছে। তাহলে সাধারণ মানুষ কেন মানবে স্বাস্থ্যবিধি পালন করুন নামক দ্বৈতনীতির ওজনহীন কথা?
শহরে হাত ধোয়ার জন্য তৈরী বেসিনের উপর ময়লা জমে পানি বন্ধ হয়ে আছে। পাবলিক টয়লেটেও স্বাস্থ্যবিধি উধাও। সাধারণ পাবলিক বাসে জীবাণুনাশক স্প্রে করা বন্ধ হয়ে গেছে। বাসের ভেতরে ক্ষীরা, আমড়াওয়ালার মাস্কবিহীন অবস্থায় খোলা কাঠির মধ্যে সেসব খাবার বিক্রি করছে।
এপর্যন্ত টিকা শুধু কিছু শহুরে ভদ্রমানুষেরা নিয়েছে। দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে শতকরা কতজন এ পর্যন্ত টিকা নিতে পেরেছেন তা বলাই বাহুল্য। সারা দেশে বাড়ি বাড়ি টিকা প্রদান কর্মসূচি গ্রহণ না করা পর্যন্ত আগামী পাঁচ বছরেও সবাইকে টিকা প্রদান করা সম্ভব নাও হতে পারে। করোনার দ্বিতীয় আবহ শুরু হতে না হতেই সংক্রমণের গতি ও মাত্রা দেখে মনে হচ্ছে প্রথম ঢেউয়ের সময় সব দুয়ার খোলা রাখার প্রভাবে জনগণের মধ্যে যে হার্ড ইমিউনিটি সৃষ্টির কথা ভেবে স্বস্থির ঢেঁকুর তোলা হচ্ছিল তা ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ না পেরুতেই স্বাস্থ্য বিভাগের ডিজি মহোদয় সহ বড় বড় অনেক কমকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। তাই সামনের দিনগুলোর ভয়াবহতাকে মোটেই অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।
কোভিড সাহেবকে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ অবহেলা করে এভাবে স্বাগত জানিয়েছিল। তারা সেটার মারাত্মক প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ব্রাজিল ও ইউরোপেও তাই হয়েছ্ েসেই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার বিষয়কে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তারা প্রতিরোধ করতে পারেনি, এখন প্রতিকারের জন্য হন্যে হয়ে পড়েছে।
করোনার নতুন ধরণ ইউকে ভেরিয়েন্ট আরো বেশী মারাত্মক রূপ নিয়ে জেঁেক বসেছে। মার্চ ১৮ তারিখে গত ১০০ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ সংক্রমণ দেখা গেছে। দেশে ছয় জন ইউকে ভেরিয়েন্ট রোগী শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যুসংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। তাই গণমাধ্যমে শুধু শুধু স্বাস্থ্যবিধির কথা শোনালে চলবে না। যদিও বিষয়টি বেশ কঠিন তবুও বাজার, মেলা ও রাস্তা-ঘাটে চলাচলের বাস্তবতায় জনসমাগমের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাথে মানুষকে নিজেদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু মানুষের চরম অবহেলায় এখন করোনা আর প্রতিরোধের পর্যায়ে নেই। তাই প্রতিকারের জন্য সবাইকে প্রতিশেধক দিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
গত ১৯ মার্চ সারা দেশে বিসিএস প্রিলিমিনারী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে কেন অন্যান্য পরীক্ষা বন্ধ থাকবে? ফ্রিস্টাইলে সব খুলে দিয়ে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা নিয়ন্ত্রণ করলে অপরিহার্য বিষয়কে তর্জনী দেখানো হয় মাত্র। তাই দুয়ার খোলার দ্বিমূখী নীতি পরিহার করে জাতির ভবিষ্যতের কল্যাণে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পরীক্ষার কড়াকড়ি না থাকলে কেউ পড়াশোনা করতে চায় না। ফলে জ্ঞানার্জন শিথিল হয়ে জীবন বিফলে যায়।
একটি সফল জীবনের জন্য স্বাস্থ্য নিরাপত্তা জোরদার করার বিকল্প নেই। এজন্য দেশের সকল মানুষকে দ্রুত টিকার আওতায় এনে সব ডোজের নির্ভেজাল টিকা অতি দ্রুততার সাথে প্রদানের ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীসহ সবার করোনা জনিত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ভীতি থেকে আপাতত: কিছুটা মুক্তি মিলতে পারে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য