কোভিড-১৯ রোখার দায় এখন বিজ্ঞানীদের
ড. মো. ফখরুল ইসলাম।।
রুদ্রমূর্তি কোভিড-১৯ এখন সারা বিশ্বের মানব স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কোভিড-১৯ হচ্ছে করোনাভাইরাস থেকে উদ্ভূত এক ধরনের ‘ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন শ্বাসকষ্টজনিত মহামারী’। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের থেকে বড় হুমকি এখন এই মারাত্মক মহামারী।
বর্তমানে চীন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালালেও তাদের জন্য মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সেখানে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক থেকে রোগীদের প্রতি মানবসেবা কমে গেছে।
চীনের হনঝাউয়ের হোটেলে ‘রিটল পিনাট’ নামক রোবট রুমে রুমে খাবার ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পৌঁছে দিচ্ছে। গুয়াংজুর একটি বাজার এলাকায় যন্ত্রমানব নিয়োগ করা হয়েছে। এসব রোবট কেউ মাস্ক পরে না হাঁটলে তাকে বকুনি দিয়ে সাবধান করে দিচ্ছে।
২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চীনে করোনাভাইরাসের ছোবলে মারা গেছেন ২ হাজার ৪৬১ জন। বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ। হুবেই প্রদেশে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
ক’দিন আগে হংকংয়ের প্রধান জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও চিকিৎসক অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েল লুয়াং জানিয়েছেন- যদি আক্রান্ত লোকের এক শতাংশও মারা যায়, তাহলে সেই সংখ্যা সাড়ে চার কোটি ছাড়িয়ে যাবে! চীনের বাইরে ৩০টি দেশে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। হংকং, ফিলিপাইন, ফ্রান্স ও জাপানে কয়েকজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী মৃত্যুবরণ করেছেন।
চীনের লি ওয়েনলিয়াং নামের যে চিকিৎসক সর্বপ্রথম প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সম্পর্কে বিপদের সতর্কবাণী করেছিলেন, তিনিও এ ভয়ংকর ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা গেছেন। পুলিশ ডাক্তার লি’কে করোনাভাইরাস সম্পর্কে মুখ বন্ধ করে রাখতে বলেছিলেন।
তিনি মুখ খুলে গণমাধ্যমে করোনার সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে দেওয়ায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এজন্য তার কারাবাসও হয়। কেউ কেউ বলছেন, করোনাভাইরাস ভয়ংকর রূপে প্রকাশ পাওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে!
হুবেই প্রদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাসের দ্বারা সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। ডাক্তার ও নার্সদের অমানুষিক পরিশ্রমের পরও সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। অধিকন্তু নার্সরা নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক মারা গেছেন।
একজন নার্স বলেছেন, চারদিকে আমার সহকর্মীরাই রোগী! এখনও করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। এর প্রতিষেধক হাতে পেতে আরও ১৮ মাস সময় লাগতে পারে বলে জানা গেছে।
করোনাভাইরাসের জেনেটিক কোড জানা হলেও ক্ষেত্রভেদে এর বৈশিষ্ট্য দ্রুত রূপ পরিবর্তন করতে পারে। তাই রুদ্রমূর্তি কোভিড-১৯ এখন একটি মহা আতঙ্কের নাম। সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- এ যেন এক মহামানবিক বিপর্যয়।
উত্তর কোরিয়ায় চীনফেরত একজন করোনা আক্রান্ত রোগীকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে বলে সংবাদে জানা গেছে। চীন সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে লুকোচুরি করছে বলে জানা গেছে।
হুয়ান প্রদেশে করোনায় মৃত ১০ হাজার মানুষের লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলে সংবাদে এসেছে। জিআইএসের মাধ্যমে হুয়ানের বাতাসে উচ্চমাত্রার সালফার ডাইঅক্সাইডের পরিমাপ পর্যবেক্ষণ করে এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
চীনের মতো একটি গবেষণাসমৃদ্ধ দেশ যেখানে করোনা সংক্রমণ নিয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে, সেখানে তৃতীয় বিশ্বের গরিব, জনবহুল ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যেন এটি আঘাত হানতে না পারে সেজন্য সতর্ক থাকা বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।
চীনের পক্ষে এমডিজি অর্জন যেমন সহজ হয়েছে, এখন সেটি টিকিয়ে রাখতে ততটাই কঠিন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের ধস নেমেছে।
সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের কাঁকড়া চাষীরা উৎপাদিত কাঁকড়া রফতানি করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। উল্লেখ্য, আমাদের দেশের উৎপাদিত ৮০ শতাংশ কাঁকড়া চীনে রফতানি করা হয়ে থাকে। ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে চাষীরা কাঁকড়া আবাদ করে থাকেন। ফলে দ্রুত নতুন বাজার ধরতে না পারলে পুঁজি হারিয়ে তাদের পথে বসতে হবে।
করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক সারা বিশ্বে যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য বন্ধ দুয়ার নীতি ডেকে আনছে তাতে উদারীকরণের খোলা দুয়ার এ মহাআতঙ্কের বিষবাষ্পের কাছে মাথানত করে প্রকৃতির প্রতিশোধের কাছে মানুষের অসহায়ত্ব আবারও প্রমাণ করছে।
রুদ্রমূর্তি কোভিড-১৯ এখন একটি মহাদুর্যোগেরও নাম। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে করোনা ভয়াবহতার সতর্কবার্তা প্রচারিত হচ্ছে। চীনের করোনা দুর্যোগ গোটা এশিয়াকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দুর্যোগের ঘনঘটায় ফেলে দিয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাব রুখতে সারা বিশ্বের ডাক্তার, জীবাণুবিজ্ঞানীরা রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন।
চীনের এ বিপর্যয় তাদের শুধু একার- এটি ভাবলে আমাদের সবার ভুল হবে। এ সবুজ সুশোভিত বিশ্বটা সবার বাড়ি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা উষ্ণতা নিত্যনতুন প্রাণঘাতী ভাইরাসের জাগরণ সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।
শতাব্দীপ্রাচীন ভাইরাসগুলো মানুষের কুৎসিত জীবনাচার ও অসতর্কতায় জীবনসংহারী হিসেবে পুনরাবির্ভূত হয়ে ঘাতকের ভূমিকা পালনে প্রতিনিয়ত অশুভ তৎপরতা চালাতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না।
ভাবতে দেরি করলে চলবে না যে, এ বিশ্ববাড়ির সব বাসিন্দার জীবন আজ হুমকির মুখে। এ মহাদুর্যোগে সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে সবার জীবন রক্ষা করা আমাদের সমষ্টিগত দায়িত্ব।
আধুনিক সভ্যতার চরম শিখরে এসেও মানুষকে ভাবতে হচ্ছে তারা প্রকৃতির প্রতিশোধের কাছে কত অসহায়। তাই জেগে উঠুন জ্ঞানী মানুষ, জেগে উঠুন তামাম বিশ্বের অগ্রগামী গবেষকরা! প্রাণসংহারী রুদ্রমূর্তি কোভিড-১৯ রুখতে হবে আপনাদের মতো নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানীদেরই।
* ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য