logo
news image

স্বপ্নদের মৃত্যু

- জুলফিকার আলি মাণিক
প্রতিটি মানুষের দেহ ত্যাগ মানেই অগণিত স্বপ্নের মৃত্যু। সাংবাদিকতা আমার কাছে পেশার চেয়েও বেশি কিছু। আমি যদি বুঝি কেউ ভাল সাংবাদিকতা করতে আন্তরিক আমাকে তা আকৃষ্ট করে। প্রকৃত সাংবাদিকতার স্বার্থে, সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে কেউ আমার কোন ভূমিকা প্রত্যাশা করলে আমি সাধারণত দ্বিতীয় প্রশ্ন না তুলে হাত বাড়াই। এটা সাংবাদিকতার সাথে আমার বন্ধুতার হাত। সাংবাদিকতা নিয়ে আমার স্বপ্ন অনেক।সাংবাদিকতা নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি, স্বপ্ন দেখাতেও ভালবাসি। আমার এই ভালবাসাকে সবাই ভালবাসে না। যারা ভালবাসেন তাদের একজন আজ ছেড়ে গেলেন। তিনি জেষ্ঠ্য সাংবাদিক শাহ আলমগীর। বয়সে, পেশাগত অভিজ্ঞতায় আমার চেয়ে অনেক বড়।স্বাভবিকভাবেই আলমগীর ভাই ডাকতাম। বড় হলেও ছিলেন বন্ধু সুলভ, সজ্জন ব্যক্তি। ছিলেন সাংবাদিক নেতাও। আমি যেহেতু সাংবাদিকদের রাজনীতির জগতের বাইরের মানুষ তাই আমার সাথে নির্ভেজাল সাংবাদিকতা নিয়েই সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল। আমি তাঁকে চিনতাম ১৯৯১ সাল থেকে, তখন তিনি সংবাদে। আমি অন্য কারও কাছে কোন কাজে গেলে দেখতাম আলমগীর ভাইকে। তখনও পরিচয় গড়ে ওঠেনি। এখন পর্যন্ত সাংবাদিকতার জগতে আমার ২৮ বছরের যাত্রায় আমি একবারই তাঁকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত আমরা সহকর্মী ছিলাম। আমি ছিলাম প্রতিবেদক, আলমগীর ভাই ছিলেন প্রধান বার্তা সম্পাদক। আমরা ২০০১ সালে শুরু হওয়া চ্যানেল আই সংবাদের যাত্রা শুরু প্রজন্মের সহযাত্রী ছিলাম। ২০০৪ সালে আমি দ্য ডেইলি স্টারে যোগ দেবার পর আর একসঙ্গে কোথাও চাকরি করিনি। তবে যোগাযোগটা ছিল। আমার কোন প্রতিবেদন তাঁর ভাল লাগলে ফোন করে বলতেন। অনুপ্রাণিত হতাম। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রতি আমার যেমন বিশেষ অনুরাগ আছে, আলমগীর ভাইয়েরও ছিল। তাইতো প্রেস ইন্সটিটিউটের মহা-পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেবার পর আলমগীর ভাই দেশজুড়ে সাংবাদিকতার নানা দিক নিয়ে তো বটেই, বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করলেন। দেশের সব পর্যায়ের কর্মরত সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্পর্কে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করার এক দারুণ উদ্যোগ নিলেন তিনি। যখনই তাঁর এই মহৎ উদ্যোগে পাশে চেয়েছেন কখনও না করিনি।অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে আলমগীর ভাইয়ের দু'চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল। এই স্বপ্নে আমাদের মিল ছিল, তাই তাঁর সাথী হয়েছি বার বার, তিনিও সাথী করেছেন আমাকে। গেল ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের আগে সবশেষ ময়মনসিংহে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণে আমরা একসঙ্গে ছিলাম। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান হলেও জীবনের দীর্ঘ সময় ময়মনসিংহে বেড়ে ওঠার সুখস্মৃতি ছিল তাঁর। আমার আবার ময়মনসিংহে বেড়ে ওঠার স্মৃতি নেই, তবে আমার জন্ম সেই মাটিতে। সেই নিয়েও প্রথমবার আমাদের কথা হয়েছে।তাঁর গাড়ীতে করে একসঙ্গে ফিরেছি ঢাকায়। ঘণ্টা চারেকের পথ ছিল। পুরো পথ জুড়ে সাংবাদিকতা, বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে আলমগীর ভাই তাঁর স্বপ্নের কথা বলেছেন, আমার স্বপ্নের কথা শুনেছেন। জীবনের মাত্র বাষট্টিতে চলে গেলেন আলমগীর ভাই। আজ তাঁর অকাল বিদায়ের খবর শুনবার সাথে সাথে আমার চোখের সামনে যেন সাংবাদিকতা নিয়ে আলমগীর ভাইয়ের একঝাঁক সুন্দর স্বপ্নের লাশগুলো ভেসে উঠলো। আমি জানি মানুষের সব সুন্দর স্বপ্ন যেমন নিজে বাস্তবায়ন করতে পারে না তেমনি আমি বিশ্বাস করি কারও কোন সুন্দর স্বপ্নের মৃত্যুও হয় না। অন্য কোনদিন, অন্য কোথাও, অন্য কারও হাত ধরে স্বপ্নগুলো আবার জাগবে, সত্যি হয়ে উঠবে। সেদিন স্বপ্নেরা নিশ্চয়ই আপনাকে খুঁজে বের করে আলিঙ্গন করে আসবে আলমগীর ভাই।
* জুলফিকার আলি মাণিক: সাংবাদিক।  ঢাকা, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, লেখাটি সাংবাদিক জুলফিকার আলি মাণিকের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেয়া। 

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top