ঠিকাদারী সনদের ভাড়া ও ডিগ্রী সনদের বেকারত্ব
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
নিজের নামে ঠিকাদারী সনদ নেই তবুও তিনি ঠিকাদার। বন্ধুরটা, বড় ভাইয়েরটা তিনি ভাড়ায় নেন, চুক্তিতে চলে তার কাজ কারবার। ঠিকাদারী ব্যবাসার লাইসেন্স বা সনদ আরেকজনকে চুক্তিতে ব্যবহার বা ভাড়া দিয়ে উপার্জিত অর্থের ভাগ নেয়ার কালচার আমাদের সমাজে নতুন নয়। এটা কর্তৃপক্ষের কেউ দেখেও দেখেন না, কারণ এই অবৈধ কাজ যিনি দেখভাল করার দায়িত্বে থাকেন তিনিও পরোক্ষভাবে ভাগ নেন। এভাবে ঠিকাদারী কাজকে বানানো হয়েছে এক অলস, অকর্মন্য, একশ্রেণির লোভী পেশীশক্তির অন্যায়মূলক উপায়ে লাভজনক পেশায়। আমাদের দেশে সরকারী কাজের গুণগত মান হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে এই অনৈতিক ঠিকাদারী ব্যবসা। কারণ, কাজের মান নয়- এক্ষেত্রে টাকার ভাগটাই মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করে। অনেক সময় কাজ শুরু করার পূর্বেই কে কত ল্াভ পাবে তার চুক্তি সম্পাদিত হতে শোনা যায়। এছাড়া যার যে কাজের জ্ঞান বা শিক্ষাগত কোন যোগ্যতা নেই সেই আনাড়ি ব্যাক্তি সে কাজের ঠিকাদার হতে যাবেন কেন? এজন্য সরকারী নীতিমালা থাকা দরকার।
টাকা থাকলেই মোট দরের ৩%-৫% জামানত দেখিয়ে অন্যের লাইসেন্স ব্যবহার করে কাজ বাগিয়ে বাহাদুরী করা আমাদের দেশে একটি অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন, গণপুর্ত, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সকল প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য তালিকাভুক্ত ঠিকাদার রয়েছেন। একবার কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য তালিকাভুক্তির সুযোগ পেলেই পোয়াবারো। তারা টেন্ডার ড্রপ করে কাজ পেলে রাজা বনে যান। শুরু হয় ফড়িয়াদের সাথে দরকষাকষি। সনদবিহীন ফড়িয়ারা দরকষাকষির মাধ্যমে কাজের মধ্যে অলিখিতভাবে অনুমতি পেয়ে কাজ শুরু করে দেন। তাদের কাছে লিজ নেন ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান। যেমন, কোন সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব পর্যাপ্ত গাড়ি নেই, লোকবল নেই। তার ৫০টি গাড়ি প্রয়োজন কিন্তু আছে ১০টি। সেক্ষেত্রে তাকে ৪০টি গাড়ি চালকসহ লিজ নিতে হয়। তারা বাধ্য হয়ে বাইরের প্রতিষ্ঠান থেকে গাড়ি ও লোকবল লিজ অথবা ভাড়া নেন। এভাবে একটি জরুরী কাজ চলে যায় প্রান্তিক কোন আনাড়ি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কব্জায়। যেখানে সুষ্ঠু তদারকি ও জবাবদিহিতার বালাই থাকে না। ফলে মূল ড্রাইভার ঘমিয়ে সময় কাটিয়ে হেল্পার বা অদক্ষ কাউকে ভারী গাড়ি চালানোর মত দায়িত্ব দিয়ে দেয়। ফলে ঘটে মারাত্মক দুর্ঘটনা। এসব কাজে সরকারী সুপারভাইজার নিযুক্ত থাকার পরও অবহেলার কারণে বার বার মারাত্মক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে দেখা যায়। নটরডেম কলেজের ছাত্রের সাইকেল গুঁড়িয়ে দিয়ে যে ড্রাইভার তাকে রাস্তায় পিষে মেরেছে সে ওয়ার্কশপের একজন সাধারণ কর্মচারী। যার ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স বা অভিজ্ঞতা ছিল না বলে সংবাদে জানা গেছে। এছাড়া ময়লা সরানোর মত কাজের সংগে জড়িতরা প্রায়শ:ই মাদকাসক্ত থাকেন। তাদের জন্য ডোপ টেষ্টের কোন ব্যবস্থা নেই।
সরকারী, বেসরকারী সব ধরণের কাজের জন্য টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে। এজন্য বহু বৈধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পাশাপাশি, বৈধতার সাথে অবৈধ কর্মকান্ডের প্রচলণ আমাদের প্রচলিত নিয়মকে বহুদূরে ঠেলে দিয়ে এক অনিয়মের রাজত্ব কায়েম করে সময় ও অর্থের অপচয় ঘটিয়ে চলছে যুগের পর যুগ। সরকারী সকল নির্মাণ কাজ যেমন- বাড়ি, রাস্তা, বাঁধ, নদীভাঙন ঠেকানো, ব্রীজ, কালভার্ট, ড্রেন, মালামাল কেনাকাটা, মশা নিধন পর্যন্ত টেন্ডার-কোটেশনের অক্টোপাশের কব্জায় পড়ে জর্জরিত হয়ে অনিয়মের মধ্যে নিপতিত হয়ে পড়েছে। এর সাথে কমিশনখোর ও অনৈতিক রাজনীতি যুক্ত হয়ে এক বিশ্রী ব্যবস্থার মধ্যে নির্ধারিত সময়-কালক্ষেপণ করেও কাজ সমাপ্ত করা হচ্ছে না। অধিকিন্তু বারংবার প্রকল্পের জন্য বাড়তি অর্থ ভর্তুকি বা বরাদ্দের দাবী জানিয়ে কাজ ফেলে রেখে জনদুর্ভোগ বাড়ানো হচ্ছে। অন্যথায় যেনতেনভাবে কাজ সমপ্ত করে অর্থের ক্ষতি করা হচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে আশ্রয়ণ প্রকল্পে এরুপ দায়সারা কাজের উদাহরণ জাতির নিকট দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারদের কাছে একধরণের জিম্মিদশায় নিপতিত।
আমাদের দেশীয় ঠিকাদারদের করা রাস্তার কাজ দ্রুত নষ্ট হয়ে গেলেও কোরীয়ান ঠিকাদারদের তত্ত্বাবধানে তৈরী করা রাস্তার কাজের অংশে এখনও ফাটল ধরেনি। তাহলে কোরীয়ান ঠিকাদারগণ কি ফেরেশতা না জ¦ীন? তাদের করা কাজ বহাল তবিয়তে যুগ পেরিয়ে সেবা দিলেও আমাদের দেশীয়দের করা কাজে এত নিম্নমান ও স্বল্পায়ু কেন? এর উত্তর তারা জাতির কাছে কি দেবেন?
গাড়ি চালকদের ফাস্ট, সেকেন্ড ও থার্ডক্লাশ নম্বরধারী লাইসেন্স ছাড়াও প্রিকোয়ালিফাইড লাইসেন্স দেবার বিধান রয়েছে। অনেকে নতুন গাড়ি কিনে লাইসেন্স পবার আগেই অন টেষ্ট রিখে রাস্তায় নেমে পড়েন। আমাদের দেশে বিআরটিসি নিজেরা গাড়ি চালায় না। তারা ঠিকাদারদের মাধ্যমে দৈনিক বা রুট ভিত্তিতে দায়িত্ব দিয়ে কাজ করান। বিআরটিসি গাড়ি রাস্তায় বেশী বেপরোয়াভাবে চলাচল করে। যারা এই গাড়ির যাত্রী তারা বিষয়টি ভালভাব অনুধাবণ করে থাকেন। এছাড়া রাস্তায় চলাচলের সময় সবচেয়ে বেশী নষ্ট হয় এই গাড়ি। তাই সরকার এই গণপরিবহণ তেকে লাভের মুখ দেখতে পায় না। তবুও ইে গাড়ি রাস্তায় চলাচল করে এবং কিছুদিন পরই নতুন গাড়ি অকেজো হয়ে ডিপোতে ডাম্পিং-এ চলে যায়। সাজঘর থেকে ফেরেনা সিংহভাগ গাড়ি। তখন পুনরায় নতুন দামী গাড়ি বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণ মূল্য দিয়ে ক্রয় করা হয়। সরকারের লোকসানের বোঝা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠানটি। যেমনটি ঘটে চলেছে ডেমু ট্রেনের ক্ষেত্রে।
দেশে অনৈতিকভাবে ঠিকাদারী লাইসেন্স ভাড়া দেয়া বা লিজ দেয়া বন্ধ হলে রাস্তায় আনাড়ি চালকদের মাধ্যমে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি অবৈধ ও ভুয়া সনদ প্রাপ্তির কারবার বন্ধ করা গেলে এবং সকল চালকদের জন্য ডোপ টেষ্টের ব্যবস্থা করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস পাবে। জাপানের মত হাইওয়ে পুরিশের হাতে স্বয়ংক্রিয় মাদক ডিটেক্টর মেশিন সরবরাহ করতে হবে এবং সৎ অফিসারদের মাধ্যমে হাইওয়ে রেষ্টুরেন্ট বা বিশেষ বিশেষ স্থানে হঠাৎ ডোপ টেষ্টের মোবাইল আয়োজন করে সড়ক দুর্ঘটনা শূণ্যের কোঠায় নামানো যেতে পারে। তা করা না গেলে একই পরিবারের সাত ভাইয়ের মধ্যে ছয়ভাইকে একই সাথে হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার বলি হতে হবে বার বার। কারণ, বাংলাদেশ এখন মাদকের বড় ভোক্তার দেশ। এর সিংহভাগ ভোক্তারা দূরপাল্লার গাড়ি চালক। তাদেরকে চিহ্নিত করে সংশোধন করতে না পারলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করে অবসরে পাঠাতে হবে।
এছাড়া ঠিকাদারী পেশায় একজনের সনদ যদি ভাড়ায় খাটে তাহলে বেকার যুবকদের বিভিন্ন শিক্ষাগত ডিগ্রীর সনদ আরেকজনকে ভাড়া দিতে দোষ কোথায়? ঘুষ-দুর্নীতি, জালিয়াতি, ভোট চুরি ডাকাতি, পেশী শক্তিকে লাই দেয়া ইত্যাদি সকল অনৈতিক কর্মকান্ডকে বৈধতা দিয়ে দিলে তো আর কোন কিছুকেই অবৈধ বলে দোষারোপ করার সুযোগ থাকবে না! এসবের জন্য কোন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানেরও প্রয়োজন থাকবে না। প্রতিদিন ঘুষ,দুর্নীতি, অন্যায়, জালিয়াতি, বাটপারী ইত্যাদি নেতিবাচক কথা শুনতে কার ভাল লাগে? বিষয়টিকে কেউ কেউ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। তবে একবার ভেবে দেখুন, দুর্নীতিকে নীতি হিসেবে ঘোষণা দিলে অপরাধ বা বে-আইনী বলে সমাজে আর কিছু বাকী থাকার কথা নয়। ইউপি নির্বাচনে নির্বাচিত হবার পর প্রতিপক্ষের উপর যেমন মাৎস্যন্যায়ের মত একধরনের নির্যাতনের উৎসব চালানো হচ্ছে, হত্যা, লুন্ঠন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে উল্লাস করা হচ্ছে সেসব ঘটনাকে ডিজিটাল যুগের এই সভ্য সমাজে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এ বর্বরতাকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করার উপায় আছে কী? যারা এসব করে থাকেন তারা আজ লজ্জায মুখ লুকিয়ে আছেন। কারণ, এসব ঘৃণ্য ঘটনা পর্যবেক্ষণকারী সত্যিকার ডিগ্রীর সনদধারী মেধাবী, সৎ ব্যক্তিরা এখানে নি:শ্চুপ, বিস্মিত ও নির্বাক। তারা আধুনিক ডিজিটাল যুগের আবরণ ও আভরনে এক অসভ্য আদি যুগের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক ডীন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য