অশ্লীলতা কোন শিল্প নয়
—প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
অশ্লীলতা হল একটি পরিভাষা, ‘যা এমন সব শব্দ, চিত্র ও কার্যক্রমকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যেগুলো সমসাময়িক অধিকাংশ মানুষের যৌন নৈতিকতার দৃষ্টিতে অপরাধ বা দোষ হিসেবে বিবেচিত। এর মূল ইংরেজি শব্দ অবসিনিটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ অবসেনাস থেকে, যার অর্থ "দুষ্ট, ঘৃণিত, রুচিহীন"।’অশ্লীলতা শব্দটি দীর্ঘ সময় ব্যাপী যৌনতা—বিষয়ক সংজ্ঞা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, তবু বর্তমান সময়ে "উস্কামিমুলক ঘৃণ্য কাজ" অর্থেও শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। সাধারণভাবে এটি অভিশাপ অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে, অথবা এমন যে কোন কিছুকে বোঝাতে ব্যবহৃত হতে পারে যা নিষিদ্ধ, অশালীন, ঘৃনিত বা বিরক্তিকর।
অশ্লীলতাকে বলা হয়— জঘন্যতা, কদর্যতা, নির্লজ্জতা, অভদ্রতা ও যৌন বিষয়ক কুৎসিত আচরণ। অশ্লীলতার দ্বারা নির্লজ্জ ও কুরুচিপূর্ণ কথা ও কাজকে বোঝানো হয়। এছাড়া যেসব কুকর্ম ধৃষ্টতাসহকারে প্রকাশ্যে করা হয় সেগুলোকেও অশ্লীল বলা হয়।
দীর্ঘদিন যাবত অশ্লীলতাকে নানা উপমায় অভিহিত করে এবং নানা বক্তব্যের রং মেখে শিল্পের নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অশ্লীলতা ও শিল্পের ধারণা ও সংজ্ঞা সম্পূর্ণ আলাদা। অশ্লীলতাকে যতই পরিশীলিত করে বলা বা প্রকাশ করার চেষ্টা হোক না কেন সেটা সেটা আরো কদর্যভাবে ধরা দেয়।
বহু সংস্কৃতিতে অশ্লীল বিষয়কে সংজ্ঞায়িত করে আইন প্রস্তুত করা হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর বই ফ্যানি হিল বিভিন্ন সময়ে অশ্লীল বিচারের মুখোমুখি হয়েছে (যেমন, চিত্র: প্লেট একাদশ: স্নানের পার্টি; লা ব্রেকিয়েট)।
ব্যক্তি ও পারিবারিক সুস্থতার সাথে অশ্লীলতা মেলে না। কোন ব্যক্তি শারিরীক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হলে তার মাধ্যমে অশ্লীলতা প্রকাশ পেতে পারে।
সামাজিক সুস্থতার সাথেও অশ্লীলতা মেলে না। যে কোন সমাজে অস্থায়ী বিষয় হিসেবে ঢুকে কালক্রমে স্থায়ী রুপ লাভ করে থাকে। এর স্থায়ী হবার কারণ বহুমুখী। প্রথমত: সমাজস্থ মানুষের নৈতিকতায় শীথিলতার উপস্থিতি থাকলে অশ্লীল বিষয় পাত্তা পেয়ে যায়। সমাজে কোনরুপ নৈতিকতার বালাই না থাকলে এটা আস্কারা পেয়ে পেয়ে বেড়ে চলে। যদি কোন দেশে সরকারী মিডিয়াতে অশ্লীল বিষয় প্রকাশিত হবার সুযোগ পায় তাহলে সেটা উদাহরণ কিহসেবে সহজেই সেই দেশের জনমনে জায়গা করে নিতে পারে।
অশ্লীলতা একটি বড় অপরাধ। এটা সমাজের শান্তি—শৃঙ্খলা নষ্ট করে। সমাজকে কলুষিত করে। নিষ্পাপ ও কোমলমতি ছাত্র—ছাত্রীদের চরিত্র হনন করে যুবক—যুবতীদের কুকর্মের প্রতি প্রলুব্ধ করে।
আল্লাহ তায়ালা অশ্লীলতাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ বলেন, “বলুন, আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা।”(সূরা আল—আ’রাফ, আয়াত ৩৩)। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, “প্রকাশ্য কিংবা গোপন অশ্লীল আচরণের নিকটেও যাবে না।”(সূরা আল—আনআম, আয়াত ১৫১)।
অশ্লীল আচরণকারী সকলের নিকট ঘৃণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন— “যার মধ্যে অশ্লীলতা আছে, তা তাকে ত্রুটিযুক্ত করে। আর যার মধ্যে লজ্জাশীলতা আছে, তা তাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে।”(তিরমিযি)।
‘আল কোরআনের আলোকে অশ্লীলতা হচ্ছে, অন্যের মন্দ কথা প্রকাশ করা, অনর্থক বিষয়ে কথা বলা, এমন অপবাদ ছড়ানো যে বিষয়ে নিজেদের জ্ঞান নেই, চারজন লোকের চাক্ষুষ সাক্ষী ব্যাতিত জেনার অপবাদ দেয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ইত্যাদি।
আল্লাহ বলেন, ‘হে মুহাম্মদ (স.) বলুন— আমার রব হারাম করেছেন যাবতীয় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীলতা, পাপ কাজ, অসংগত বিরোধিতা, আল্লাহর সাথে এমন কিছু শরীক করা যার কোন প্রমাণ তিনি নাযিল করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা যা তোমরা জান না। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় রয়েছে আরো ২৩ টি আয়াত। শয়তান মানুষকে অশ্লীল কাজের প্ররোচনা দেয়— আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে মানুষ! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র বস্তু আছে তা থেকে তোমরা আহার কর আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না।’ ব্যভিচার নিঃসন্দেহে অশ্লীলতা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। অবশ্যই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পন্থা।’
অশ্লীলতা মুখের ভাষায় নয়, আজকাল মুখের খাবারের অংশ হয়ে গেছে। মাদকের নিয়ন্ত্রণহীনতা, ব্যাপক ছড়াছড়ি এবং মাদকাসক্তি অশ্লীলতার প্রধান বাহন। একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যাক্ ।
ঢাকা থেকে বহুদূরে নওগাঁর নজিপুরে রাস্তার ধারে দাঁড়ালাম একটু চা খেতে। রাত হয়ে যাওয়ায় চায়ের দোকানের কমীর্রা বাড়ি চলে গেছে। আইসক্রীম ও ঠান্ডা পানীয় খোঁজ করতেই পাওয়া গেল। ওদের ফ্রীজে সবই আছে। কোকাকোলা, স্পাইট,লেমন ড্রিঙ্কস যার যেটা পছন্দ নিতে বলা হলো। হঠাৎ সেখানে এক কম বয়সী ভবঘুরে এসে হাজির। সে তোতলিয়ে কথা বলে তার জন্য এক বোতল স্পি..ট কিনে দিতে আরজি করলো। ভাবলাম সে হয়তো স্প্রাইট খেতে চাচ্ছে। তাই তাকে আমার হাতের স্প্রাইটের বোলটি এগিয়ে দিতে সে না করলো। বললো এটা নয়— স্পি..ট দে।
দোকানদার বুঝেছে তার মুখের ভাষা। সে ওতে দ্রুত সেখান থেকে তাড়ানোর জন্য দেরী না করে একটি অজানা বোতল এনে তাকে দিতেই সে খুব খুশি হয়ে নাচতে লাগলো। এজন বাস ড্রাইভার হঠাৎ এসে সেও একটি নিষিদ্ধ বোতল নিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে ঢক্ঢক্ করে গিলে নিল। মনে হলো দিন বদলের পালায় চালক ও ভবঘুরেদের মধ্যেও নিষিদ্ধ বোতল আমাদের খাদ্য ও পাণীয়ের মধ্যে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। কিন্তু যদি মদ এভাবে তাদের পাণীয় গ্রহণের চিন্তায় জায়গা করে নেয় তাহলে কি হবে?
শিল্পকে বলা হয়েছে— মনের খোরাক। কিন্তু ইউরাপে সেই শিল্পকে কিছু মানুষ কদর্য পযার্য়ে নামিয়ে দিয়েছে। নিজ দেশের গালি পরদেশের বুলি বলে একটা প্রবাদবাক্য খুবই প্রচলিত। পাবলিক ন্যুইসেন্স তৈরী করে এমন অশ্লীলতাকে আজকাল আমাদের দেশ অবাধে প্রমোট করা হচ্ছে। বডি পেইন্টের নামে উলঙ্গ হয়ে ঘুড়ে বেড়ানো ইউরোপের অনেক দেশের সংস্কৃতির অংশ। কেউ বিষভাবে কেউভাবে কিস। বিভাজন সেখান থেকেই উদ্ভব।
অতীতে প্রাচীন গ্রীসে, যৌনতা এবং শরীরের সৌন্দর্যের উপর উল্লেখযোগ্য জনকর্ম একটি মুখ্য অংশ ছিল। সক্রেটিস এবং প্লেটো প্রমিত বিচারধারা উন্নত করে এবং যে ভাবনা দেয় যে দেহের শুচি এবং শারীরিক সৌন্দর্য মানব আত্মার উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষের অশ্লীল কাজে আগ্রহ বা আকর্ষণের পিছনে কিছু কারণ রয়েছে। দুর্বল সামাজিক পরিবেশে মানুষের মনোবিকার তৈরী হয়। এত ব্যক্তিগত মূল্যবোধ পরিবর্তন হতে পারে এবং এটি অশ্লীল কাজে আগ্রহ এবং আকর্ষণের কারণ হতে পারে।
মিডিয়া, সিনেমা, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের মতামত, আদর্শ এবং মনোবৃত্তি আকার নেয়। অসুস্থ মতামত বা স্থায়িত্ব বৃদ্ধির কারণে, মানুষের অশ্লীল কাজে আগ্রহ তৈরি হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা, দিনের কাজে স্ট্রেস এবং মোহ পরিস্থিতিতে অশ্লীল কাজে আগ্রহের কারণ হতে পারে।
অশ্লীলতা দূর করার জন্য সমাজ, শিক্ষা, পরিবার, সরকার এবং ব্যক্তিগত স্তরে প্রয়াস প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদেরকে সঠিক জ্ঞান এবং উচ্চ মরাল মূল্যবোধ দেওয়া উচিত। শিক্ষা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক মরাল তৈরী করে এবং অশ্লীল আচরণ থেকে দূরে থাকার মাধ্যম তৈরি করে। মিডিয়াতে শৃংখলা এবং সঠিক তথ্যের মধ্যমে অশ্লীলতা সংবাদ থেকে দূরে থাকার উপায় প্রদান করতে হবে।
সরকার বা নীতি নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অশ্লীলতা প্রতিরোধে দক্ষ আইনগত ব্যবস্থা প্রয়োজন। সরকারীভাবে যৌন উপাদান ব্যবস্থাপনা এবং যৌন শিক্ষার মধ্যে সহযোগিতা দেয়া উচিত, যাতে অশ্লীলতা দূর করার প্রয়াসে সাহায্য করা যায়।
প্রতিটি মানুষের জন্য ব্যক্তিগত সতর্কতা, নৈতিক শক্তি অর্জন এবং স্বাস্থ্যগত জীবনে সেই নৈতিক অবস্থান ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের যৌন আদর্শ এবং মূল্যবোধ পরিবর্তনে প্রভাব বিস্তারকারী খারাপ উপাদানগুলোকে প্রতিরোধে সক্ষমতা থাকতে হবে। অশ্লীলতা দূর করতে সমাজের সচেতনতা, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে কোন সম্প্রদায়ের মানুষদের আন্তরিক সমর্থন আদায় করা প্রয়োজন। এই সমস্যার সমাধানে সবার ইতিবাচক সমথর্ন থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
অশ্লীলতা যে কোন সমাজের জন্যই শিল্প নয় কারণ, এটি সামাজিক সুস্থতার সাথে মিলে না। উদাহরণস্বরূপ, শিল্পের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যাগুলি সমাধান করার চেষ্টা করা যায়, মানবাদিক মূল্যের উন্নতি সাধন করা যায় এবং মানবিক সংবাদ প্রয়োগ করে একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা যায়। কিন্তু অশ্লীলতার মাধ্যমে মানুষ আদিম, বর্বর ও বেপরোয়া হয়ে উঠে। ফলে সমাজের প্রচলিত উন্নত শিল্প খুব দ্রুত ধ্বংস হতে পারে।
অশ্লীলতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা যা কোনো কারণেই যে কোন সমাজে প্রবেশ করতে পারে। মৌলিকভাবে এটি একটি নির্দিষ্ট শিল্প নয়, বরং এদিয়ে চরম উন্নাসিকতার ও একধরণের হঠকারীতা শুরু হয়ে অনৈতিক ফসল উৎপাদিত হতে থাকে। তাই সামাজিক স্তরে অস্থায়ী বা স্থায়ী ক্ষতি আসবার উপায় হিসেবে এর ক্ষতিকর প্রভাব আপামর জনগোষ্ঠীকে কষ্ট দেয় ও হতাশ করে। ফলত: দ্রুত সামাজিক ভাঙ্গন শুরু হয়ে সামাজিক অসততা তৈরী হয়। মানুষ অন্যায় কাজকে ঘৃণা করতে ভুলে যায় এবং অন্যায় ও গর্হিত কাজকে উপরে উঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে পছন্দ করে। তাই অশ্লীলতা এবং অসৎ শিল্পের প্রতি আমাদের সমাজে সম্পূর্ণ প্রতিবাদ থাকা উচিত, যাতে আমরা একটি সুস্থ এবং উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হতে পারি।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য