logo
news image

তবে সে কোন শয়তান?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
দিনটা এপ্রিলের প্রচন্ড খরার। সময়টা সকাল গড়িয়ে দুপুরের কাছাকাছি। যতই অনলাইন পত্র-পত্রিকা  দেখি না কেন দিনে অন্তত: একবার ছাপানো খবরের কাগজে চোখ না বুলালে তেষ্টা মিটে না। কাজের ফাঁকে দৈনিকটা হাতে নিতেই একটা খরাপ সংবাদের দিকে নজর গেল। খুলনায় চালককে হত্যা করে ইজিবাইক ছিনতাই। রাফি ইসলাম নামের ২৫ বছর বয়সী এক ইজিবাইক চালকের লাশ নগরীর লবণচরা থানার ডেসটিনির পরিত্যক্ত মাঠ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সাতক্ষীরার শুকদেবপুরের তেঁতুলিয়া গ্রাম থেকে খুলনায় এসে ইজিবাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। যাত্রীর ছদ্মবেশে নির্জনে নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে গেছে দুবৃত্তরা। এমন সংবাদ হরদম চোখে পড়ে। তাই খারাপ লাগলেও পাতা উল্টিয়ে ভিন্ন দিকে চলে গেলাম।
ভেতরের পাতায় তাকাতেই লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ থানার সাবেক উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু মুসা ছোটনকে খুন করার সংবাদ চোখে পড়লো। তাকে আগের দির ইফতারের পর জরুরী কথা আছে বলে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে নিকটস্থ জমিরবাড়ি সরকারী বিদ্যালয় মাঠে পেটের মধ্যে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়া হয়। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পরে তিনি মারা যান।
মন খারাপ করে পরের পাতায় চলে যেতেই দেখলাম নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজারে মাহবুব আলম নামক একজনকে সিএনজিতে তুলে নিয়ে স্বজনদের সামনে চোখ তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি চাষাড়া ইউনিয়নের যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক। জমির জন্য বায়নার টাকা নিয়ে তর্কাতর্কির জের থেকে নির্মমভাবে পেটানোর পর চোখ উপড়ে ফেলে তাকে হত্যা করা হয়।
পাতা উল্টাতেই পর পর তিনটি খুনের খবর দেখে পত্রিকা সরিয়ে রেখে টিভির রিমোটে চাপ দিলাম। রোজার দিন। তাই কিছুটা ক্লান্তি লাগছিল। সেখানেও খবর। একটি সংবাদের দিকে নজর যেতেই বিষয় শুনে ক্লান্তি ছুটে গেল। একজন ডাক্তার অভিযোগ করছেন, তাঁর কাছে ষাট লক্ষ টাকা ঘুষ দাবী করেছেন একজন ট্যাক্স-এর উপ-কমিশনার। এজন্য সেই মহিলা ডাক্তারের ট্যাক্সের টাকা কমিয়ে দেয়া হবে বলে দাবী করা হচ্ছে। প্রথম দফায় দশ লাখ টাকা প্রদান করার কথা ছিল। সংবাদ পেয়ে দুদকের লোকজন সেদিন সকালে দশলক্ষ টাকা অগ্রীম ঘুস নেয়ার সময় ফাঁদ পেতে তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। অনেকগুলো চ্যানেলে তা প্রদর্শণ করা হচ্ছিল। জায়গাটা অফিসেই হবে হয়তো। কারণ, তাকে গ্রেপ্তারের সময় অফিসের কিছু মানুষ দুদকের লোকজনের উপর হামলাও চালিয়েছে বলে সংবাদে বলা হচ্ছিল।
টিভিতে এমন সংবাদ দেখতে দেখতে পুনরায় দৈনিকটি হাতে নিয়ে একটি উপসম্পাদকীয়-তে চোখ গেল। সেটি রমজানের পবিত্রতার উপর লেখা। সেখানে বলা হয়েছে প্রতিবছর রোজা শুরুর সাথে সাথে শয়তানকে শেকলবন্দি করে রাখা হয়। একথা আমরা অনেকে জানি ও বিশ^াস করি। মনে হলো রোজা শুরু হবার কয়েকদিন হয়ে গেছে। শয়তান বাঁধা আছে, কোমরে শেকলসহ। কিন্তু আজকের এই পবিত্র রোজার দিনে এতগুলো হত্যাকান্ড, ঘুস নেবার দায়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার এগুলো তাহলে কাদের প্ররোচনা, সে কোন শয়তানী?
লাউঞ্জে কয়েকজন সহকর্মী এসে ঢুকলেন। তাঁরা আমার পাশের সোফায় বসে গেলেন। টিভিতে ঘুসের জন্য কর কর্মকর্তা গ্রেপ্তারের সংবাদের কথা জানাতেই একজন বলে উঠলেন রোজায় ইবলিস শয়তানের কোমরে শেকল পড়ানো আছে সেজন্য আজ মানুষরুপী শয়তানকেও শেকল পড়ানো সম্ভব হয়েছে!
উত্তরটা অনেকটা কৌতুকের মতো মনে  হলো। কিন্তু সেজন্য তাকে পাল্টা কিছু না বলে জিজ্ঞেস করলাম তাহলে দৈনিকটা দেখুন। ভেতরের পাতায় কতগুলো হত্যাকান্ডের সংবাদ আছে। তাদের হত্যাকারীরা এখনো ধরা পড়েনি। হয়তোবা শেকল ছেঁড়ার চেষ্টা করছে কেউ কেউ। তিনি জানালেন কি দিয়ে শেকল ছিঁড়বে?
আরেকজন বলে উঠলো কেন, ঘুস দিয়ে! প্রথমজন সংগে সংগে বলে উঠলেন, ঘুস দিয়ে শয়তানের সাগরেদ বা মানুষরূপী শয়তানদেরকে ছাড়ানো যেতে পারে তবে ইবলিসকে নয়। কারণ, ইবলিস রোজার মাসে বন্দি থাকবেই।
আলোচনা এভাবে জমে উঠলো। তবে রমজান পেরুলে ইবলিস ছাড়া পেয়ে গেলে তখন কি হবে? এজন্য উত্তর দিতে গিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলেন তিনি।
টিভিতে বঙ্গবাজারের অগ্নিকান্ড নিয়ে প্রতিবেদনের ছবি দেখানো হচ্ছিল। আরেকজন কথা কেড়ে নিয়ে বঙ্গবাজারের অগ্নিকান্ডের দিকে চলে গেলেন। একজন বড় ফায়ারকর্মী বলছিলেন, ‘বঙ্গবাজারের নাজুক অবস্থা নিরুপণ করে তারা ২০১৯ সালে সেখানকার ব্যবসায়ীদেরকে নিরাপত্তার কথা জানিয়ে নোটিশ দিয়েছেন মার্কেট ছাড়ার। সেই অবধি এপর্যন্ত অন্তত: দশবার নোটিশ হয়েছে। কিন্তু কেউ কথা শোনেনি।’এ ব্যাপারে সেদিনই টিভিতে আরেকজন বক্তা বাজার তদারককারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘তারা তদন্ত করতে যায় কিন্তু রিপোর্ট দেয় দেরীতে। দেরীতে রিপোর্ট দেবার আশ^াস দিতে পারলে ঘুসের টাকার পরিমাণও বেড়ে যায়। এভাবে ঘুসের লেনদেনে কাছে আজ সবার চোখের সামনে বঙ্গবাজার পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল।’ সবাই হা করে চেয়ে চেয়ে দেখলো কালো-সাদা ধোঁয়া। তারপর ৫০টি ফায়ারইউনিট, বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার, পুলিশ আনসার, ব্যবসায়ী কারো কোন তৎপরতাই কাজে লাগলো না! আগুনের উৎস কি তা জানা গেল না। যে সেখানে আগুন দিয়েছে- সে কোন শক্তিধর? সে কোন শয়তানের বংশবদ?
আসল শয়তান ইবলিস, বড় শয়তান। সে ঘটনাস্থলে কখনো থাকে না। আসল শয়তান নিজে শয়তানী করতে মাঠে আসে না। সে সাগরেদ বা মানুষরুপী শয়তানশিষ্য মানুষকে দিয়ে শয়তানী করায়। মানবদেহে ও সমাজে ইবলিসের কার্যক্রম সর্বগ্রাসী। ভাল মানুষের পূণ্যকাজে ইবলিসের গায়ে আগুন লাগে, জ্বালা ধরে যায়। তখন সে মরিয়া হয়ে তার শিষ্যদের দেহ-মনে আশ্রয় নেয়। ইবলিসের প্রলোভনে ভুলুন্ঠিত সেসব মানবাত্মা ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য নিরুপণ করতে পারে না। মিথ্যা, খুন, ঘুস, দুর্নীতি, চুরি-ডাকতি, পাপের ব্যবসা ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলণের কারণে আমাদের সমাজে ইবলিস অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সেসব মানুষরুপী শয়তানেরা রোজার দিনে শেকলবন্দি আছে কি?
তা-না হলে তাদেরই কাজ পবিত্র রমজান মাসেও এসব ইজিবাইক চালককে হত্যাকরা, ডাক্তার ম্যাডামের নিকট ঘুস দাবী করা, দুর্নীতি আর বঙ্গবাজার, নিউসুপার মার্কেট বা দেশের অন্যান্য স্থানে ধরিয়ে দেয়া অগ্নিকান্ড ঘটানোর জন্য।
শয়তান ইবলিস মাটির তৈরী মানুষকে সেজদাহ্ না করার অপরাধে বরখাস্ত হয়েছিল। তাই মানুষকে দিয়ে সে সব খারাপ কাজ করাতে সদা তৎপর। যেসব মানুষ আল্লাহ্র নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ইবলিসের ডাকে সবসময় সাড়া দেয় তারাই আজকের পৃথিবীতে সকল অন্যায় কাজের ধারক-বাহক, অনুঘটক সবকিছুই। এরাই শয়তান ইবলিসের ‘ওয়াসওয়াসা’ বা পীড়াপীড়ির শিকার হয়ে শয়তানে আজ্ঞাবাহক ও তল্পিবাহক হয়ে পড়ে। এরা মুখে ভাল কথা বলে, কাজে ‘মুনাফেকের’ ভূমিকা রাখে। রমজানের পবিত্রতার মাঝেও এরাই সেই ইবলিস শয়তানের আজ্ঞাবাহক রূপে সারা পৃথিবীতে অন্যায় কাজে লিপ্ত।
তবে সে কোন জাতের শয়তান? তারা হলো সেই শয়তান-
যারা অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জন করে, ভোগ করে নিজের শরীরের, নিজ বংশবদদের তাজা করে তাদের রক্তেই ইবলিস ঢুকতে পারে, দৌড়াতে পারে। অন্যায় কাজে তাদের অন্তর কাঁপে না। তারা বেশী চায়, লোভী, কপট হয়ে শুধু খাই খাই করে এবং আরো চায়। এরা সেই শয়তান, যারা পবিত্র রমজানেও আত্মশুদ্ধি করে না, যারা ন্যায় অবজ্ঞাকারী কিছু ভেজাল-বিপথগামী মানুষের রক্ত ও স্নায়ুধারায় ঢুকে সদা-সর্বদা ভাল মানুষের ক্ষতি করার জন্য তৎপর রয়েছে। এসব শয়তানের ক্ষতিকর তৎপরতা থেকে পবিত্র রমজানেও সাধু সাবধান!

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top