logo
news image

আধুনিক যুগে ট্রেনের নৈরাজ্য

-ড. মো. ফখরুল ইসলাম।।
আধুনিক যুগে ট্রেনের ভেতর যাত্রীর কাছে গিয়ে টিকিট চেয়ে নিয়ে যাচাই করার নিয়ম উঠে গেছে। নেহাত বড় কোনো সমস্যা না হলে যাত্রীদের কাছ থেকে টিকিট দেখতে চাওয়া হয় না। এমনকি কোনো সভ্য দেশে রাস্তায় গাড়ির হর্ন বাজানোর নিয়ম নেই। পথে চলতে গিয়ে কেউ হর্ন বাজালে সবাই তার দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে দেখে—বেচারা কোনো বিপদে পড়েছে কি না। কোনো চালক রাস্তার আইন অমান্য করে গাড়ি চালালে তাকে কড়া হর্ন বাজিয়ে সতর্ক করে দেয় পেছনের বা পাশের গাড়িগুলো। রাস্তায় কর্কশ স্বরে কেউ হর্ন খাওয়ার অর্থ গালি খাওয়া।
ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে টিকিটধারী বা বৈধ যাত্রী ছাড়া অন্য কোনো মানুষের ঢোকার অবকাশ নেই। সাধারণত সেটাই নিয়ম। উন্নত ও উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশে একটি আরামদায়ক ট্রেন ভ্রমণব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এমনকি ইথিওপিয়ার মতো দেশে বহু বছর আগে উন্নত ট্রেন-ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সেখানে প্ল্যাটফর্মে ঢোকার আগে টিকিট বা কার্ড মেশিনে ঢুকিয়ে রিড করা হয়। এরপর যাত্রীরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে পারে এবং নির্দিষ্ট ট্রেনে উঠতে পারে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডেও তাই। কোথাও টিকিটের অর্ধেক ফিরিয়ে দেয়, আবার কোথাও টিকিটটি ফুটো করে দেওয়া হয়। একেক দেশের রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একেক ধরনের মেশিন চালু রয়েছে।
আমাদের দেশে ব্রিটিশদের তৈরি রেলস্টেশনগুলোতে বহুবার সংস্কারকাজ করা হয়েছে। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া মোটেও লাগেনি। ডিজিটাল যুগে এখনো সেই মান্ধাতার ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চলন্ত ট্রেনের ভেতরে টিকিট যাচাই করা হয়। কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর অবৈধ যাত্রী পাওয়া গেলে তখন কিছুই করার থাকে না। তাকে চলন্ত ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়াও যায় না অথবা এমন অসহায়-দরিদ্র যাত্রী উঠে পড়ে, যাদের জেল-জরিমানা করারও উপায় থাকে না। এগুলো অহরহ ঘটে চলেছে।
যেমনটি দেখা গেল ঈদের দুদিন আগে দেশের সবচেয়ে বড় কমলাপুর রেলস্টেশনে। টিকিটধারী যাত্রীরা ট্রেনে উঠতে পারেনি, কিন্তু টিকিটবিহীন যাত্রীরা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছে দলে দলে। ট্রেনের ছাদে, ইঞ্জিনে, জয়েন্টে, হ্যান্ডেলে ঝুলে ঝুলে হাজারো যাত্রী বাড়ি যাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল।
আমাদের দেশের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় অথবা রেলের কর্মরতরা কেউ কি কখনো বিদেশে গিয়ে ট্রেনে ভ্রমণ করেননি? এমনকি ভারতেও ট্রেনে ভ্রমণ করেননি? তাহলে আমাদের দেশের রেলের প্ল্যাটফর্মে যাত্রীসেবার জন্য আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি কেন? ভারতে চার দশক আগে থেকে সব এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীদের নামের তালিকা ও সিট নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এখন যাত্রীদের সুবিধার্থে সেটা অনলাইনেও আপলোড করা হয়। আমরা ততটুকুও তো এখনো অগ্রসর হতে পারিনি।
প্রতিবছর ঈদ এলেই শুরু হয় বিড়ম্বনা। ঈদের জন্য ট্রেনের টিকিট বিক্রি কেন এক মাস আগে শুরু হয় না? বাসেরও তা-ই হওয়া উচিত। এক মাস আগে টিকিট কিনলে কিছু মূল্যছাড় দিলে মানুষ পরিকল্পনামতো ঈদ ভ্রমণ সাজিয়ে নিতে পারবে এবং ট্রেন ভ্রমণ হবে আরামদায়ক ও আনন্দদায়ক। উন্নত বিশ্বে শুধু নয়, অনেক দরিদ্র দেশেও এক মাস বা তিন মাস আগে ট্রেনের টিকিট কাটা যায়। জাপানে এক বছর আগেও ট্রেনের টিকিট অগ্রিম কেটে ব্যবহার করা যায়। সেটা কার্ড সিস্টেমে কাজ করে।
আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করলাম অথচ এখনো কী ভয়ংকর আমাদের ট্রেন চলাচলব্যবস্থা। প্রতিবছর বিশ্ব ইজতেমা বা ঈদের সময় চলন্ত ট্রেনকে চেনা যায় না। কিলবিল করা মানুষ। সবাই ঠেসে ঠেসে ট্রেনে চেপে বসে। মনে হয় মানুষের মাথাগুলো ট্রেনের ওপর সাজিয়ে রেখে কেউ দোলা দিচ্ছে। ছাদের ওপর যাত্রী—আদমের সংখ্যার ভিড়ে ট্রেনের চেহারাকে দেখা যায় না। দেখা যায় শুধু মানুষের মাথা। ইউনেসকো হেরিটেজে ঠাঁই পাওয়ার মতো আমাদের ‘মানব-রেলগাড়ি’র ছবি।
এ ছাড়া আমাদের দেশে বন্যার পানিতে লাইন ডুবে গেলেও পানিতে ট্রেন চলার নজির আছে। এ বছরও চলেছে। কারণ দেশের এক প্রান্তে বন্যা শুরু হলেও অন্য প্রান্তের মানুষের সহানুভূতিটুকুও লোপ পেয়ে যায়। তারা আনন্দ-উল্লাস করে। সেসব তথ্য উপযুক্ত জায়গায় সঠিকভাবে প্রকাশিত হয় না। রেল কর্তৃপক্ষের কাছে আপটুডেট তথ্য থাকে না। ফলে যাত্রা করতে গিয়ে পথে ডুবন্ত রেললাইনে ট্রেন চালাতে গিয়ে বিপদের মুখে ঠেলে দেয় যাত্রীসাধারণকে।
সেদিন একজন যাত্রী ২৪ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পরদিন টিকিট পেয়ে খুশিতে নাচতে থাকল। অনলাইনে চেষ্টা করে সে ঢুকতে পারেনি। পরে জেনেছে অনলাইনের টিকিট দু-তিন ঘণ্টায় শেষ। কারা যেন সব টিকিট কিনে ফেলেছে। ওর আফসোস ছিল—মানুষ ঘরে বসে না হয় অনলাইনে একসেস নিয়েছে। কিন্তু রেলের হঠাৎ এত ডিজিটাল ক্ষমতা হলো যে মাত্র দুই-তিন ঘণ্টায় লাখ লাখ টিকিট বিক্রি করে ফেলল? নাকি মাত্র কয়েকজনের কাছে সব টিকিট বিকিয়ে দিল? ওদের তো সব সময় নেটওয়ার্ক স্লো থাকে। আমরা সেখানে ঢুকতেই পারিনি। এ বিষয়টি তদন্ত হওয়া দরকার। তাই প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে টিকিট কেনার জন্য। টিকিট পেয়ে সে খুশি। ঈদে বাড়ি যাবে।
আসলে বাড়ি তো যেতেই হবে। এটা সব দেশের কালচার। যেমন জাপানে ‘ওবন’ উৎসবের দীর্ঘ ছুটিতে সবাই কর্মস্থল ছেড়ে নিজ ‘ফুরুসাতো’ বা গ্রামের বাড়িতে ছুটে যায়। সেখানে পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করে। এ জন্য রাস্তায় যথেষ্ট ভিড় হয়। তবে ছয় মাস বা তিন মাস আগে থেকেই টিকিট কেনা যায় বিধায় তারা সাজানো পরিকল্পনামাফিক ‘ওবনের’ ছুটিকে কাজে লাগাতে পারে। ওদের ট্রেন ব্যবস্থাপনায় এতটাই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকে যে কোথাও এক মিনিট বা কয়েক সেকেন্ড দেরি হওয়ার নজির নেই। দৈব দুর্ঘটনায় কোথাও দেরি হলে সে জন্য রেল কর্তৃপক্ষ ‘বাউ’ বা কুর্নিশ করে বারবার ক্ষমাপ্রার্থনা করে। আমাদের দেশে শিডিউল ট্রেন লাপাত্তা হয়ে গেলেও সে ধরনের ক্ষমা চাওয়ার কৃষ্টি সৃষ্টি হওয়ার নজির নেই।
প্রতিবছর উৎসবের আগে ও পরে যাত্রীর চাপ এত বেশি যে কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হয়। ঈদযাত্রা, করোনাযাত্রা, ইজতেমাযাত্রা, ঢাকা অবরোধ ইত্যাদি নানা অবস্থায় ঢাকা থেকে আসা-যাওয়ার গতি বেড়ে যায়। সে জন্য মেট্রোরেল চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরপাল্লার ট্রেনের সব প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে অটোমেটিক টিকিট চেকিং মেশিন স্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ঈদুল আজহার আগে কমলাপুর স্টেশনে টিকিটধারী নারী যাত্রীদের যেভাবে জানালা দিয়ে টেনেহিঁচড়ে বগিতে তুলতে দেখা গেছে, তা খুবই অমর্যাদাকর এবং ভোক্তা আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। হঠাৎ ট্রেন ছেড়ে দেওয়ায় কেউ ট্রেনের ছাদ থেকে লাইনে পড়ে গেছে আবার কেউ কেউ শত ঠেলাঠেলি করেও ট্রেনে উঠতে না পেরে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে বাসায় ফিরে এসেছে। এই ছবিগুলো যখন সারা পৃথিবীর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়, তখন আমাদের মাথা হেঁট করা ছাড়া আর উপায় কি? তাই অচিরেই ট্রেন চলাচলের এসব নৈরাজ্য নিরসন হওয়া প্রয়োজন।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top