ধরি মাছ না ছুঁই পানি-চরিত্রে আঁধার ঘুচবে না
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
পেটের ভেতর অর্ধেক কথা রেখে অনেকে মুখে বলেন অর্ধেক। কোনকিছু জেনেও না জানার ভান করেন অনেকে। কলমের ঠোটে সত্য কথা বেরিয়ে এলেও ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে জটিল ও অবোধ্য করে তোলেন অনেকে। কেউ ভয়ে সেটা করেন কেউ নির্ভয়ে। কেউ বোকামী করে সেটা করে ফেলেন, কেউ জ্ঞানপাপী হয়ে করে ফেলেন নির্দ্বিধায়, অকপটে। পরেরটাই আজকাল বেশী। কারণ, স্বার্থ রক্ষা করে চলতে গিয়ে সত্য-মিথ্যার জোড়াতালি দিয়ে চলতে শেখায় আমাদের সমাজ। রাতকে দিন ও দিনকে রাত করার জন্য ন্যায়-অন্যায়ের বালাই মানতে চান না তৃণমূল থেকে অত্যাধুনিক দাবীদারকৃত কিছু মানুষ। চুরি-ডাকাতি করা বিত্ত ও অবৈধ উপার্জনের অর্থ দিয়ে দানবীর হওয়া বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরী করে বাহাদুরী দেখানোর মধ্যে কোন সার্থকতা নেই। কিন্তু এই জাতীয় চরিত্রের মানুষেরা আজকাল সংখ্যায় অগণিত। তাদের প্রভাবে মূলত: যে কোন সমাজের বিজ্ঞজনেরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে লোভের চোরাবালিতে পা রেখে ডুবে যান। তারা সাধারণ প্রজার কাতারে নেমে ক্ষমতাশীলদের তল্পিবাহক হয়ে জি¦-হুজুর চরিত্রে রূপায়িত হয়ে পড়েন।
এভাবে একটি সমাজে মানুষ ভুলুন্ঠিত হয়ে সঠিক সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। সামাজিক ও পারিপাশি^ক শিক্ষা যদি অন্যায় কাজ করাটাকে উস্কে দিয়ে বাহবা দিতে শেখায় তাহলে সেটা যে কোন দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। তখন কেউ করো কথাকে বিশ^াস করতে চায় না। গ্রাহ্য করে না দেশের আইন কানুন ও নির্দেশনা, ভয় করেনা শাস্তি ও জরিমানা।
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সারা বিশ্বের মানুষ যখন ভয়ে কাতর হয়ে বাঁচার জন্য একটি শৃংখলার মধ্যে চলাচল শুরু করে নিজেদেরকে বাঁচাতে তৎপর তখন আমাদের দেশে বার বার লকডাউন দিয়েও কাজ হচ্ছে না। ঘরের বাইরে বের না হবার কঠোরতর ঘোষণা দিয়ে একজন উচ্চপর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা যখন বন্ধুদের নিয়ে জন্মদিন পালন করে, একজন এমপি যখন হাওড়ে দলবল নিয়ে নৌ-বিহার করে তখন সাধারণ মানুষ সেগুলো দেখে কী শিক্ষা লাভ করবে?
যারা কথা ও কাজে দ্বিমুখী চরিত্র ধারণ করে তারা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চরম মোনাফেক। যারা ধর্মগ্রন্থ হাতে জনকল্যাণের শপথ নিয়ে জনক্ষতিকর কাজে লিপ্ত হন তারা আরো বেশী খারাপ, বড় মোনাফেক বা ধড়িবাজ, বেঈমান প্রকৃতির মানুষ। তাদেরকে অসহায় ব্যক্তির জন্য কোন উপকার করার কথা বললে বা আবেদন করা হলে মুখে হাম্বরা ভাব দেখিয়ে আজ-কালের মধ্যে সমস্যা সমাধান করার কথা বলে আশ^াস দেন। কিন্তু আসলে তারা ফাটা কেষ্ট। দায়িত্বে থেকেও ‘বিনামূল্যে’ কাউকে কোন উপকার করেন না। এই মূল্য হলো অবৈধ আর্থিক দুর্নীতি, ঘুষ ইত্যাদি। তা দিতে না পারলে শুধু কালক্ষেপণ ও হয়রানী জুটে উপকারপ্রার্থীর কপালে।
কয়েকমাস আগে সুগারমিল থেকে অবসর নেয়া একজন অসুস্থ কর্মচারীর বকেয়া ফান্ডের বেতন-ভাতা নিয়ে আহাজারি শুনে খুব মর্মাহত হয়েছিলাম। তার হার্টের বাইপাস সার্জারী হয় ৮ বছর পূর্বে। নিজের জমিজমা বিক্রি করে চিকিৎসার খরচ চালিয়ে এখন নিয়মিত ঔষধ কেনা ও খাবার কেনার অর্থ নেই। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে তার টাকাটা পাবার জন্য দেন-দরবার করে অনেক আশ^াস পেয়েছি। কিন্তু নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অদ্যাবধি তিনি সে টাকা হাতে পাননি। একটি দেশে সব কর্মকর্তা- কর্মচারী যদি সামান্য রুটিন কাজ করতে গিয়ে মন্ত্রী বা তার চেয়ে বড় উপরওয়ালাদের দোহাই দেন তাহলে অসহায় মানুষেরা দ্রুত উপকার পাবে কীভাবে? ছোটখাটো রুটিন কাজের জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না মেনে উপরওয়ালার দোহাই দিয়ে অহেতুক হয়রানী করা কি কোন সভ্য দেশের কাজ?
যুগ এখন ডিজিটাল। সব জায়গায় চাটুকার, দালাল ও লালফিতায় ফাইল বেধে অবৈধ অর্থ আদায়কারীদের দিন এখন শেষ হতে চলেছে। দলবাজ ও দলকানাদের মাস্তানী ও দৌরাত্ম্য খর্ব হবার পথে। মানুষ আসল তথ্য জানার জন্যে খুব দ্রুত একটির সাথে দশটি মিডিয়ার মুদ্রিত খবরকে যাচাই করে, তুলনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পায়। ফলে ডিজিটাল সংবাদ মাধ্যমের জন্য এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ যথাযথ সমাযোজন বা ‘এডাপ্টশেন’ প্রক্রিয়া অবলম্বন করার। তা না হলে ‘অতিকায় হস্তি লোপ পেয়ে ক্ষুদ্র তেলাপোকা স্থান দখল করে নেবে’ অচিরেই।
অন্যদিকে যারা সমাজের দর্পণ, বলা যায় যাদেরকে দেখে দুর্নীতিবাজরা কিছুটা ভয় পেত সেই প্রিন্ট মিডিয়ার দিনও শেষ। তারা বিকল্প উপায়ে পেশা বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। আজকাল ব্যঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে অনলাইন ওয়েব পোর্টাল ও সংবাদপত্র। সাথে বিকাশ লাভ করেছে শত শত প্রাইভেট টিভি চ্যানেল। কোন ঘটনা ঘটলেই তা মিনিটেই ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি কোণায়। মুহূর্তেই মানুষ জেনে ফেলছে সব তথ্য। মিনি পর্দায় এখন সংবাদপত্রের সরব অবস্থান। হাত হাতে মোবাইল ডিভাইস দিয়ে তর্জনীর স্পর্শে যে কোন জায়গা থেকে অ্যাকসেস্ পাচ্ছেন সব ঘটনা ও সংবাদের। তাই কেউ তথ্য গোপন করলে বা তথ্য নিয়ে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি অবলম্বন করলে তার দিন শেষ। তাদেরকে প্রাচীন মানসিকতা পরিবর্তন করে আধুনিক উদারনীতি অবলম্বন করতে হবে। অচিরেই ঘোলা পানি ছেড়ে স্বচ্ছ মিঠা পানির ধারায় ফিরে আসতে হবে।
একথা চরম সত্য যে, সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই। কারণ, পৃথিবীর সব মানুষ অসৎ প্রকৃতির নয়। অগণিত সৎ ও ভাল মনের মানুষ আছেন এই ধরণীতে। হয়তো তাদের বদান্যতায় নিরীহ, অসহায় মানুষগুলো এখনও নি:শ^াস নেবার ফুরসৎ খুঁজে পাচ্ছেন।
করোনাকালটা বড় কষ্টের। কিন্তু এর একটা বড় সুফল হলো- করোনার করাল গ্রাস ডিজিটাল পদ্ধতির দ্রুত বিকাশ সাধন করে সাধারণ মানুষের জন্য তথ্যপ্রাপ্তির সুবিধাকে কয়েকধাপ এগিয়ে দিয়েছে। দু’বছর ধরে ঘরবদ্ধ মানুষ একই সাথে বহু ডিজিটাল সংবাদ মাধ্যম পাঠে ও দেখায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় করোনা চলে গেলেও ছাপানো খবরের কাগজ পুনরায় ঘরের পছন্দের তালিকায় রাখবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাই পোর্টালের গ্রাফিক্স বদলিয়ে চরম প্রতিযোগিতা শুরু হবে মানুষকে আকর্ষণ করার। এই আপটুডেট প্রতিযোগিতায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি জয়ী হয়ে যাবে। প্রতি ঘন্টায় নয়-প্রতি মুহূর্তেই আপডেট দিতে হবে নতুন তথ্যের। পণ্যের বিজ্ঞাপন- সে তো যে কোন জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিনরাত চলছেই। এমনকি ইউটিউবে একটি জনপ্রিয় গানে লক্ষ মানুষ ক্লিক করতে গিয়ে বিজ্ঞাপন দেখে ফেলছে।
প্রিন্ট মিডিয়ার অস্তিত্বের বিতর্ক নিয়ে কয়েক মাস ধরে চোখে পড়ছে বহু লেখার। যুগের টানে মান্ধাতাকে হটিয়ে জায়গা দখল করে ফেলেছে ডিজিটাল গণমাধ্যম। বিপদ ঘটে গেছে, সামনে আরো ঘটবে। এখন করণীয় হলো- সংবাদপত্রের দলীয় ‘সিলমারা চরিত্র’ থেকে বেরিয়ে আসা। ডিজিটাল যুগে সাধারণ উদারনীতির পাঠক পাঠক বিশ^ব্যাপী বিস্তৃত। তাই ‘একজন আমি’ যা চায় বা সরকার যা চায় শুধু তা নয়, সাধারণ মানুষ যা প্রত্যক্ষ করেছে, যা ভালবাসে, যা প্রত্যাশা করে তাই গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করতে হবে, তাই আপডেট করতে হবে। তাহলে গণমানুষের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়ে অনলাইন পাঠক ও বিজ্ঞাপন বাড়বে। ব্যবসা ও আয় বাড়বে, চাকুরীর ক্ষেত্রও বাড়বে।
আরেকটি উপায় হলো প্রিন্ট মিডিয়াকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর জন্য সরকারী বার্ষিক স্থায়ী অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা। এ দাবী আদায়ে দল-মত নির্বিশেষে একজোট হয়ে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা। তা করতে না পারলে এখন যারা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ করে সন্তর্পনে নানা কায়দায় একা একা সুবিধা পাচ্ছেন তারাও একদিন উল্টো পরিস্থিতির শিকার হয়ে যেতে পারেন। তখন সবার ক্ষতি হবে, চরম ক্ষতি হবে এই পেশার এবং তার সংগে জড়িত পরিবারগুলো ও তাদের পোষ্যদের।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য