‘কান ধরে পেটটারে ঠিক করে কিলিয়ে’
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
অনেক আগে উত্তরের এক গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার সাথে ছিল ক’জন সহচর। কার্তিকের এক রোদেলা দুপুরে নিভৃত সেই পল্লীর ঘনবসতির মধ্যে এক বাড়ির বাইরের উঠানে বহু নারী-পুরুষ, শিশু একজন জটাধারী ব্যক্তির চারপাশে জটলা করে ঘিরে রেখেছে। তার পাশে অদ্ভুত পোশাকে ঘুঙুর পায়ে চারজন কিশোরী ঘুর ঘুরে নেচে চলেছে। জটলার ঠিক মাঝখানে একটি খাটিয়ার ওপর একজন নিশ্চল বৃদ্ধার শরীর কাঁথা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কৌতুহল বশত: আমরা এগিয়ে গেলাম। জনভীড় ঠেলে সেখানে কি হচ্ছে জানতে চাইতেই গ্রামের একজন মহিলা বলে উঠলেন, বড় অসুখ ঝেড়ে সারানো হচ্ছে সেখানে। ব্যাটা ছেলেদের আর ভেতরে না ঢুকতে তিনি নিষেধ করলেন।
ঢোল-বাদ্যের তালে তালে জাতি নিমগাছের পাতার গোছা হাতে নিয়ে কিশোরীরা অসুস্থ বৃদ্ধার চারপাশে ঘুরছে এবং প্রতিবার ঘোরা শেষে একবার বৃদ্ধার মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিমপাতার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। কড়া রোদের মধ্যে কাঁথা দিয়ে ঢেকে রাখায় তাঁর প্রাণ ওষ্ঠাগত সেদিকে কারো নজর নেই। পরে জেনেছি বৃদ্ধা দীর্ঘদিন বাঁশলিয়া রোগে (প্যারালাইসিস) ভুগছেন। অনেক কবিরাজ তার রোগ সারাতে বিফল হয়েছেন। এবার এটাই তাঁর শেষ চিকিৎসা! শারীরিক ও মানসিক নানা প্রকার নির্যাতনের মাধ্যমে বাঁশলিয়া রোগের চিকিৎসা করার প্রথা অনেক গ্রামে এখনও লক্ষ্যণীয়।
বিশেষ করে জ¦ীন-ভূতের আঁছড়, দেও-দৈত্য ছাড়ানো, কালোবাতাস, পাগলামো তাড়ানো ইত্যাদির ক্ষেত্রে শিকল লাগানো, ছ্যাঁকা দেয়া, বলপ্রয়োগ করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা প্রচলিত অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতির রীতির অর্ন্তভুক্ত। মুসুর ডালবাটা, জোড়া কালো মুরগী, সাদা কবুতর, ইত্যাদির মাথা এককোপে কেটে সেই রক্ত দিয়ে প্যারালাইসিস রোগীকে তপ্ত রোদে গোসল করানো হয়। পাগলের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নির্দয় ও নিষ্ঠুর পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে জ¦ীনে ধরা ব্যক্তির চিকিৎসায় তা বেশী নিষ্ঠুর হয়। স্কুলে পড়ার সময় একবার এক গভীর রাতে জ¦ীনে ধরা এক রোগীর জ¦ীন তাড়ানোর দৃশ্য দেখেছিলাম। রোগীর মুখে যেসব বেসুরো গান শুনেছি তা আজও কানে বাজে। জ¦ীন সেগুলো তার মুখ দিয়ে নিজে গেয়েছে কিনা অথবা সেটা সত্যি জ¦ীনে কন্ঠ কিনা তা তখন ভয়ে জানা হয়নি। এমনকি বড় হয়ে আজও জানার চেষ্টা করা হয়নি।
এধরণের অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা রীতির কারণে এজন্য কোন কোন সময় রোগী প্রাণ হারালে এক মর্মান্তিক উপাখ্যান সৃষ্টি হয়ে যায়। বর্তমানে আমাদের দেশে এসব কুপ্রথা অনেক কমে গেলেও আফ্রিকার অনেক উপজাতির মধ্যে কষ্টকর অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা ট্যাবু ও রিচ্যুয়াল হিসেবে বিবেচিত।
এসব ঘটনার বহুদিন পর হঠাৎ সেদিন টিভিতে আদাবরের মাইন্ড মেন্টাল হাসপাতালে একজন সিনিয়র এএসপিকে চিকিৎসাসেবা দেবার পূর্বেই যেভাবে এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি মেরে হত্যা করা হলো তা’তে অতীতের সেই অপহৃতি নতুন করে জেগে উঠলো। মনে পড়লো স্কুলের বাংলা বইয়ের সফদার ডাক্তারের কথা। যিনি তার চেম্বারে রোগী এলে খুশীতে চারবার ডন আর কুস্তি দিয়ে নিতেন। ম্যালেরিয়া রোগী এলে কেঁচো গিলিয়ে দিতেন। আমাশয় রোগী এলে কান ধরে পেটটারে কিলিয়ে ঠিক করে দিতেন।
চিকিৎসায় প্রতারণার ক্ষেত্রে আমরা দিন দিন যেন বিরাট অগ্রগতি সাধন করে চলেছি। যেন চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছি, এখন নোবেল পাবার পালা। অথচ করোনার ভুয়া সনদ বিক্রি করার কালো দাগ এখনও কারো মন থেকে মুছে যায়নি।
আমাদের দেশের ভয়ংকর বিষয় হলো- চিকিৎসা সেবার জন্য প্রধান অনুষঙ্গ হাসপাতালগুলোর অর্ধেক অনিবন্ধিত, ভুয়া। সংবাদে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে অর্ধলক্ষাধিক ক্লিনিক ও হাসপাতাল অনিবন্ধিত। তার অর্থ- এগুলোর নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে নেই। ব্যঙের ছাতার মত ক্লিনিক ও হাসপাতালের সিংহভাগই রাজধানী ঢাকা শহরের আশে পাশে। খোদ রাজধানীতে সুদৃশ্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে চালানো হচ্ছে ভুয়া হারবাল ক্লিনিক। আমেরিকা, চায়না, জার্মানী ইত্যাদি নানা দেশের নাম ভাঙ্গিয়ে বেনামী ভুয়া হারবাল চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছে শত শত নিরীহ মানুষ। পাশাপাশি ফুটপাতে, ট্রেনে, বাসে, স্টীমারে, লঞ্চে, সারা দেশের গ্রাম-গঞ্জে, হাটে বাজারে চিকিৎসার নামে চলছে প্রতারণা। বিশেষ করে বিভিন্ন যৌনবর্ধক মাদক, শ্রীপুরের ট্যাবলেট, কাশ্মীরি ফলের সিরাপ ইত্যাদি সহ আরো অনেক নানা নামের বিষাক্ত, অবৈজ্ঞানিকভাবে তৈরী সিরাপ, বড়ি, ওষুধ, প্রতিদিন ফেরী করে বিক্রি করা হচ্ছে সব জায়গায়। এগুলোর কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই, নেই কোন নিয়ন্ত্রণ। সারা দেশ তো বটে, কোটি কোটি জনতার ভীড়ে নুব্জ্য রাজধানী শহরে কে রাখে কার এসব ভন্ডামীর খোঁজ!
জানা গেছে- আদাবরের মাইন্ড মেন্টাল হাসপাতালে যারা ওয়ার্ড বয় তারাই চিকিৎসা দেন। কিছু ক্লিনিকে এইট পাশ ব্যক্তি ভুয়া ডাক্তার সেজে জটিল অপারেশন করেছেন মর্মে সংবাদে জানা গেছে। হয়তো সেজন্যই আধুনিক যুগের আধুনিক চিকিৎসার বদলে একজন উচ্চশিক্ষিত উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তার কপালে জুটেছে চিকিৎসার নামে কিল-ঘুষি! কেন? মানসিক রোগীর হঠাৎ অতি-আবেগ শিথীল করার জন্য সাময়িক কোন ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থা ওদের ক্লিনিকে কি ছিল না? বৈজ্ঞানিক উপায়ে রোগীকে নিবৃত্ত করতে না গিয়ে সবাই হামলে পড়ে কিল-ঘুষি মেরে দমন করতে হবে?
তারা কেউ চিকিৎসক নন। তাই সেখানে এধরণের অপ-ব্যবস্থাপনা নেয়া হয়েছে। ওনাদের চিকিৎসকের জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা থাকলে হয়তো এমন নির্দয়-নিষ্ঠুর ঘটনার জন্ম হতো না।
আমাদের দেশে জটিল যন্ত্রযুগের প্রভাবে মানুষের ওপর পারিবারিক সাপোর্ট ভীষণভাবে কমে গেছে। অফিসেও নানা ধরণের নির্যাতনের শিকার হতে হয় অনেককে। বিশেষ করে অফিসের মধ্যে দলাদলীর শাসন কোন একদলের সমর্থকদের জন্য অতি-আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে চাটুকারীতার প্রাবল্য তৈরী করায় ভিন্ন মতালম্বীদের কপালে প্রমোশনহীনতা, ওএসডি নামক ভুত চেপে বসেছে। এছাড়া ঘুষ-দুনীতি, বদলী বাণিজ্য, মনের মতো জায়গায় পোস্টিং না পাওয়া, রাজনৈতিক চাপে সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে জুনিয়রদেরকে প্রমোশন দেয়া, ফলে চাকুরীক্ষেত্রে মেধাবীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা। এভাবে চাকুরেদের মধ্যে হতাশার আধিক্য থেকে মানসিক সংকট তৈরী হচ্ছে। করোনাকালে এই সংকট আরো বেশী ঘণীভূত হয়ে সমস্যা বাড়াচ্ছে।
বিশেষ করে করোনাকালে এ পর্যন্ত শুধু আমাদের দেশে শতাধিক মূল্যবান অভিজ্ঞ চিকিৎসককে হারিয়ে আমরা চিকিৎসাসেবায় অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছি। এ দিকটাতে নজর দেয়ার মত রাষ্ট্রের শক্তিশালী ভূমিকা চোখে পড়ছে না। এই গ্যাপ ও ক্ষতি পূরণের জন্য বিশেষভাবে নজর না দিলে সাধারণ চিকিৎসা ছাড়াও মানসিক চিকিৎসাক্ষেত্রে আরো অনেক বড় ক্ষত তৈরী হতে পারে। করোনাকাল দীর্ঘায়িত হতে থাকলে চিকিৎসাব্যবস্থাপনার দিকে সুনজর বাড়ানোর বিকল্প নেই। তা না হলে ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোতে দালাল ছাড়াও রোগীর কান টানা, পেটে ঘুষি মারা ভুয়া চিকিসৎকরা এই ক্ষত বাড়িয়ে ভীষণ কর্কট রোগের বিস্তার ঘটাবে অচিরেই।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য