কামায় এদেশে জমায় বিদেশে
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
কিছু মানুষের আয়ের প্রধান উৎস দু’টি। একটি বৈধ উপায়ে অর্জিত আয়, অন্যটি অবৈধ উপায়ে অর্জিত আয়। একটি প্রকাশ্যে করে অন্যটি গোপনে করে। একটির বৈধ হিসাব থাকে, অন্যটির হিসেবের মধ্যে চাতুরী ও গরমিল থাকে। কিছু মানুষ আছে যারা যে কোন উপায়ে অর্থ-সম্পদ পেতে ভালবাসে। শুধু জমা করে নামে-বেনামে। দেশে-বিদেশে। অনেক সময় তারা সেইসব অর্জন নিজেরা ভোগ-দখল করতে পারে না। সেগুলো কে পাবে, কে খাবে, কীভাবে ফিরে পাবে তাও জানে না। অধিকাংশ সময় তারা সেগুলো ফিরে পায় না। উপরন্তু, অবৈধ সম্পদ অর্জন করে একসময় ধরা পড়ে কলঙ্কিত হয়ে লজ্জাজনক ইতিহাস তৈরী করে ফেলে। এটাই তাদের নিয়তি।
আগেকার দিনে অত্যাচারী রাজা-বাদশারা প্রজাদের সম্পদ লুন্ঠন করতো। তা দিয়ে বিলাসী জীবন যাপন শুরু করতো। এই সুযোগে তাদের রাজ্যে ডাকাত, দস্যু, বর্গী, লুটেরা, সৃষ্টি হয়ে অন্যায়ভাবে মানুষের জান-মাল হরণে ঝাঁপিয়ে পড়তো। এভাবে মাৎস্যন্যায় তৈরী হয়ে অরাজকতার মাধ্যমে প্রজা নিপীড়ণ চলতো এবং মানুষের দু:খ-কষ্টের সীমা থাকতো না। এরফলে অভাব হতো, যুদ্ধ সংঘটিত হতো ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে। একসময় মহামারী শুরু হতো। অনেক মানুষ মারা যেত। সেসব জনপদ, সভ্যতা ধ্বংস হতো। বহু শতাব্দী পরে প্রাকৃতিক নিয়মে আবার নতুন সভ্যতা সৃষ্টি হতো। বাংলার ইতিহাসে ১০০ বছরের একটা অধ্যায় মাৎস্যন্যায় হিসােেব পরিচিত।
মধ্যযুগে এমন বহু ঘটনার ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। আধুনিক যুগে অনেক ভূমিদস্যু, জলদস্যু, স্বৈরাচারী সরকারের দমন নিপীড়নের ফলে এধরনের জুলুম ও অনাচার তৈরী হতে দেখা গেছে। গরীব দেশের সম্পদ সুইস ব্যাংকে পাচার করে পরবর্তীতে ক্ষমতা হারিয়ে জনরোষে পড়ে জানের মায়ায় ভিনদেশে পালিয়ে যাবার বহু উদাহরণ রয়েছে।
মানুষের অর্থ-সম্পদ চৌর্যবৃত্তির এই প্রবণতা যেন চিরন্তন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এসে মানুষ চুরি-ডাকাতিতে ডিজিটাল কায়দা রপ্ত করে ফেলেছে। নিত্যনতুন কৌশলে চলছে এই চুরি।
আধুনিক ডিজিটাল চোরেরা এ ব্যাপারে খুবই কৌশলী। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলো থেকে তারা আগেভাগে সন্তান ও পরিবারকে বিদেশে পাচার করে নানা অপকৌশলে। কয়েক দশক আগে শুধু অতি মেধাবীরা বিদেশে স্কলারশীপ নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে যেত। এই ধরনের বিদেশ যাত্রা এখন হাতে গোনা। যে সন্তান দেশে কোথাও ভর্তির সুযোগ হয় না সে বাবার টাকার জোরে বিদেশে পড়তে যায়। সেইসব বাবারা-মায়েরা, অভিভাবকগণ তাদের সন্তানকে বিদেশে পড়ানোর এত টিউশন ফি কোত্থকে দেয়? সেসব আলালের ঘরের দুলালেরা সেখানে ‘অড জব’ করেনা বরং ব্যবসা করে। তারা অনেকেই দেশের বিত্তশালী ঘরের সন্তান, নেতাদের সন্তান অথবা চাকুরেদের সন্তান। তাদের সিংহভাগের বিদেশে খরচ করার টাকার উৎস কী? বিদেশে পড়াশুনা করতে গিয়ে ড্রপআউট হয়ে দেশের অর্থ নিয়ে গিয়ে সেখানে যেনতেন ব্যবসা করার হেতু কী? দেশের সরকারী চাকুরী হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে বিদেশে চলে যাবার পিছনে বিদেশের ব্যাংকে গচ্ছিত দেশ থেকে পাঠানো অবৈধ অর্থের ব্যাপারটা কেউ কখনো খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেননি। দেশের যে কোন সরকারী চাকুরী ছেড়ে এভাবে হঠাৎ কাউকে দেশান্তরী হতে দেয়াটা মোটেই সমীচিন নয়। এজন্য কড়া বিধিনিষেধ থাকা দরকার।
অবৈধভাবে অজ্র্তি অনেক ধনী দেশে যাবার জন্য বড় অংকের টাকা বা ব্যাংক ব্যালান্স দেখাতে পারলে ভিসা পাওয়া যেমন সহজ তেমনি সেসব দেশে ঢুকে সে টাকা দিয়ে ব্যবসা করার অনুমতি বা লাইসেন্স পাওয়াটাও অতি সহজ। আমাদের মত দরিদ্র দেশের নাগরিক হয়েও অনেক অভিভাবক তাদের পরিবার-পরিজনকে এভাবে বিদেশে থাকার জন্য পাঠিয়ে দেন। এর পিছনে কাজ করে মানি লন্ডারিং নামক অদৃশ্য মামদো ভূত। এগুলো দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অবৈধ অর্থ নিশ্চয়ই?
আমাদের দেশের মধ্যপ্রাচ্য ও কিছু দেশে যাওয়া প্রবাসী শ্রমিক ছাড়া ইউরোপ-আমেরিকা ও অন্যান্য উন্নত দেশে চলে যাওয়া প্রবাসীরা সবাই সেখানে মনের মত কিছু করার সুযোগ পাচ্ছেন না। তারা অনেকে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া টাকাকে বৈধ টাকা হিসেবে দেশের আত্মীয় স্বজনদেরকে পুনরায় ফেরত পাঠাচ্ছেন! ওগুলো আমাদের দেশের চুরি হয়ে যাওয়া অর্থ। এভাবে বৈধতা দিয়ে অনেকে ‘টাকার উৎস বিদেশ’ বলে দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষের নিকট গা বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এছাড়া আরো নিত্যনতুন ডিজিটাল প্রতারণা তো আছেই।
একবার প্রাইমারীতে পড়ুয়া এক বাচ্চা একবার গোপনে ব্যাংক থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে টাকা ট্রান্সফার করে দিয়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। সে একটি হিসাব হ্যাক করেছিল। আধুনিক যুগে হ্যাকারদের স্কুল রয়েছে। অনলাইন গোয়েন্দাগিরি করতে হ্যাকিং একটি অতিরিক্ত যোগ্যতা বটে। এজন্য প্রোগামিং-এ বিশেষ জ্ঞান ও যোগ্যতা থাকতে হয় এবং ‘স্মার্ট’ হতে হয়। কিন্তু কিছু অসৎ মানুষ দিন দিন স্মার্ট হয়ে উঠে স্মার্টনেসের সংজ্ঞা পাল্টিয়ে দিচ্ছে।
স্মার্টনেসের অর্থ হলো- বুদ্ধিমান ও দক্ষ, চটপটে, করিৎকর্মা, কেতাদুরস্ত ইত্যাদি। আমাদের দেশে কিছু মানুষ এর সবগুলো একসংগে আয়ত্ব করে অতি স্মার্ট হয়ে উঠে ইতোমধ্যে বেশ ভয়ংকর রূপ ধারণ করে ফেলেছে। কিছু মানুষ বহুদিন পূর্বে স্মার্ট ডিভাইস হাতে পেলেও অদ্যাবধি মোটেও হয়নি। তারা অনলাইনে ট্রেনের টিকিট না কিনে পুনরায় স্টেশনের টিকিট কাউন্টারে গিয়ে জটলা করছে। কারণ একটাই। সেখানে টিকিটের কালোবাজারির সুযোগ তৈরী করা থাকে। অথবা তারা এই পদ্ধতিতে অজ্ঞ। হয়তো এখনও ডিজিটাল ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হতে পারেনি তাই। এছাড়া কালোবাজারীদের ব্যবসা তো আছেই। আবার অনেক দক্ষ, সৎ মানুষও ডিজিটাল টিকিট পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। কিছু মানুষ তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হলে যে কোন কাজে বাধা দেয়। এই ধরনের মানুষের বাধার মুখে সরকারী সেবার জন্য অফিস-আদালতে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষিত, সচেতন মানুষগুলো কী করছি আমরা?
ব্যাংকে জালিয়াতি, ঘুষ-দুনীতি, প্রতারণা করে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার চলছে। সীমান্তে পাহারাদারের দায়িত্বে থেকে নিজে মাদক পাচার করে, মাদকের ব্যবসা করে অনেকে বিত্তশালী হচ্ছে কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে। থানায় নিরীহ মানুষকে ধরে এনে মাদকের মামলা দিয়ে মৃত্যুভয় দেখিয়ে ঘুষ নিয়েও ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হচ্ছে। দেশের সামাজিক সেবাদানের বেড়াগুলো এভাবে রাক্ষস হয়ে উঠলে মানুষ ‘স্যোসাল সেফটি নেট’ বলতে কী বুঝবে, আর নিজেকে কোথায় গেলে নিরাপদ মনে করবে? অপরাধের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স শব্দটি গ্যাং মালিক ও হিরোদের জন্য প্রযোজ্য হচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে। তাহলে এই শব্দটিকে কি আপাতত: যাদুঘরে পাঠিয়ে দিতে হবে? এভাবে সেবা খাতের সব জায়গায় অবৈধ অর্থ আয়ের হিড়িক দেশকে পঙ্গু করে ফেলেছে। এরা ভয়ানক রাক্ষসে পরিণত হয়ে সেই অবৈধ অর্থ গোপন ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেশের বাইরে পাচার করে দিচ্ছে। এই খাই খাই স্বভাবের চরিত্রগুলোর অভাব আজীবন থেকে যায়, এরা দেশ ও দেশের মানুষকে মোটেও ভালবাসে না। এরা নিজেরা দায়িত্বে থেকে চরম নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি তৈরী করে বলে দেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই তাই সন্তানদেরকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি!
একসময় বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সময় মাঝে মাঝে আমার স্কলারশীপের অর্থ বাঁিচয়ে ছোটবোনদের লেখাপড়ার জন্য পাঠানোর জন্য সেখানকার ব্যাংকে যেতাম। একজন দেশী ফেলো আমার গাড়িতে ব্যাংকে যেতেন তার টাকা পাঠাতে। একবার লক্ষ্য করলাম তিনি দেশে টাকা না পাঠিয়ে প্রতিবেশী এক দেশে তার ব্যাংক হিসাবে টাকা পাঠালেন। কৌতুহল বশত: তাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দিলেন- সেখানে মেদিনীপুরে তার শ^শুর বাড়ির নিকট তিনি একটি বাড়ি তৈরী করছেন। জেনে বেশ খারাপ লেগেিেছল, বাংলাদেশী পাসপোর্টধারী হয়ে স্কলারশীপ নিয়ে পড়াশুনা করে তিনি বিদেশে বাড়ি বানানোর জন্য টাকা পাঠান।
সম্প্রতি একজন এমডির দু’টো নাগরিক কার্ড দেখে মনে পড়লো আমাদের দেশে এধরনের বহু কার্ডধারী যে কতজন আছে তার কি কোন হিসেব আছে? ডিজিটাল যুগে দ্বৈত পাসপোর্ট, দ্বৈত এনআইডি, দ্বৈত সীম কাড ব্যবহার করা কোন ব্যাপারই না বলে একজন স্মার্ট মানুষ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ডিজিটাল চুরি-ডাকাতি করতে টাকা লাগে না, সংখ্যার হেরফের করলে মুহুর্তেই মিলিয়ন, বিলিয়ন সরিয়ে ফেলা যায়-তখন বাকী থাকে শুধু শুন্য!
বর্তমানে ফেসবুকে কতশত ফেক আইডি রয়েছে তা কে নির্ধারণ করবে? অনেক সরকারী কর্মকর্তা নিজেরা ফেসবুক একাউন্ট খুলেননি কিন্তু স্ত্রী, সন্তান ও পিওনের আইডি বেনামে ব্যবহার করে থাকেন। যেমন- একজন ওসি ব্যবহার করতেন তার বডিগার্ড ও আর্দালীর ফেসবুক ও মোবাইল ফোনের নম্বর। যতদিন ফেসবুক বা সামাজিক সকল যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের কার্ড পাঞ্চ করে অথবা আঙ্গুলের ছাপ পাঞ্চ করে কোন ব্যক্তির লাইভ থাকাসহ ব্যবহারের পদ্ধতি চালু হবে না ততদিন ফেক আইডির মাধ্যমে জালিয়াতি চলতে থাকবে বৈকি? চারদিকে অতি স্মার্টনেসের ঘোল খাওয়ানো কারবার চলছে। এসব অনৈতিকতার ছড়াছড়ি রূধিবে কে, কখন, কীভাবে? প্রবাদ আছে না- ‘খায় দায় পঙ্খী, মনের ভেতর আঙ্খি!’ দেশের খাব, দেশের নেব, দেশের ক্ষতি করে মনে মনে বিদেশের গোলামী করবো আর বিদেশে দেশের সম্পদ পাচার করবো, নৈতিকভাবে তা তো হয় না। যারা এমন তাদেরকে পরকীয়া দেশপ্রেমিক বলা যায়। এমন মানসিকতার জন্যে পরকীয়া সেইসব নেতা, আমলা, শিক্ষক, ব্যবসায়ীদেরকে চিহ্নিত করে পরিবার পরিজন সহ চিরতরে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলে আমরা গরীবরা দেশে নুনভাত খেয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারবো বলে মনে হয়।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য