logo
news image

বোরো মৌসুমে চালের দাম চড়া কেন?

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
ফিবছর বোরো ধান ঘরে তুলতে তুলতে বর্ষাকাল এসে যায়। পানিতে তলিয়ে যাওয়া ক্ষেত থেকে ধান কাটতে হয় অনেক জায়গায়। কেউ কেউ ডুবন্ত ক্ষেতের ধান শ্রমিকের অভাবে কাটতেই পারেন না। কেউ সেই দান কেটে ঘরে আনরেও অতি বৃষ্টিúাতের ফলে দীর্ঘদিন মাড়াই করতে পারেন না। ফলে ঢিবির আটিতেই ধান নষ্ট হয়ে যায়। আবারে করো ধান রোদে শুকানোর অভাবে ঘরের মেঝেতেই চারা গজিয়ে নষ্ট হয়ে যায়।
বোরো মৌসমে যেসকল ধারে আবাদ করা হয় সেসব ধান উচ্চ ফলনশীল, হাইব্রীড ও উন্নত জাতের। সারা বছর এসব ধানবীজের অঙ্কুরোদগম হয়। তাই দ্রুত কেটে শুকিয়ে ঘরে সংরক্ষণ করতে না পারলে এই আবাদ থেকে লাভের মুখ দেখা বেশ কঠিন। তা চাড়া একই সময়ে সব কৃষকের বোরো ধান পেকে যায় বলে বাজারে হঠাৎ করেই ধানের দরপতন ঘটে। বসন্তকালে বোরো ধানের চারা লাগানো হয় বলে এর চারার গোড়ায় বেশী কুশি জন্মে, থোড় মোটা হয় এবং বেশী শীষ আসে। তাই এই ধানের উৎপাদন বেশী। এ ধানের চাল সিংহভাগই মোটা। তাই বাজারে দাম কম। এসব মোটা চালের ভাত কিছুটা শক্ত। তাই শ্রমজীবি বা কায়িক পরিশ্রমী মানুষের জন্য ভাল। অনেকে বলেন বোরো ধানের ভাত কেলে দ্রুত ক্ষুধা লাগে না। তাই কিছুটা হলেও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বোরো-ইরি চালের বেশী উপাদনে অনেক স্ব¯িত লক্ষ্য করা যায়। একদিকে কমদামে বাজার ঠান্ডা থাকে অন্যদিকে সাধারণ মানুষের পেট ঠান্ডা থাকে।
অবস্থাশালী কৃষকরা আমন ধান সংরক্ষণ করে সারা বছরের ভাত খাবার জন্য। কিন্তু বোরোধান মাড়াই করার পর বাজারে বিক্রি করে দেন। কারণ ভেজা ধানের আটি মাড়াই করা, শুকানো চাল বানানো এবং সংরক্ষণ করা কঠিন। আবার অনেকের পরিবারে মোটা বোরো চালের ভাত পছন্দ নয়। সেজন্য প্রতিবছর রোরো মৌসুমে গ্রামের বাজারে এসব মোটা চালের দাম কমে যায়। সহজলভ্য হয় দরিদ্র মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পথ।
কিন্তু এই পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে অটোমেটিক রাইস মিলগুলো। অসাধু মিল মালিকরা মোটা বোরো ধান স্বল্পদামে ক্রয় করে গুদামে সংরক্ষণ না করে সরাসরি অটো রাইস মিলে প্রসেস করেন। তারা মোটা চাল কয়েকবার ছঁটাই করে চিকন চালে রুপান্তর করেন। সেই চালে সুগন্ধি কেমিক্যাল মিশ্রিত করে বাহারী নাম দিয়ে চাকচিক্যময় বস্তায় ভরে বাজারজাত করেন। প্রায় পনের-বিশ বছর আগে এই ব্যবসায়িক প্রবণতা শুরু হবার পর থেকে চালের বাজার চলে গেছে কিছু অসাধু অটো রাইসমিল মালিকদের নিয়ন্ত্রণে। যেমন, আমাদের দেশে মিনিকেট নামে কোন ধানের আবাদ হয়না। কিন্তু বোরা-ইরি ধানকে উচ্চতাপে পারবয়েল করে সে চালকে বার বার ছাঁটাই করে চিকন বানিয়ে মিনিকেট নাম দেয় হয়। এরপর প্রতারণা করে বেশী দামে বিক্রি করা হয়। মিনিকেট, চিকনশাইল ইত্যাদি বাহারী নামের এসব প্যাকেট বা বস্তার চালের ভাতে নেই কোন স্বাদ, নেই কোন তৃপ্তি!
একইভাবে নকল পোলাও চালের প্যাকেটে বাজার সয়লাব। এসব ইরি-বোরো চাল চিকন করে কাটা নকল পোলও চালে প্যাকেট খুললেই উৎকট সুগন্ধির গন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু রান্নার পর কোন সুগন্ধ থাকে না। পোলাও ঘেমে ভর্তা হয়ে যায়। বিশেষ করে রাইস কুকারে এসব চালের ভাত রান্না করে একবারের বেশী খাওয়া যায় না। বাড়িতে উৎপাদিত আমন চালের ভাত রাইস কুকারে রান্না করার পর তিন-চার দিন পর্যন্ত গরম রেখে খাওয়া গেলেও নকল চালের ভাত-পোলাও সেই সুবিধা দিতে পারে না।
ভোগ্যপণ্যে চালে নামে নকল-ভেজাল খাদ্যের প্রতারণার কত যে রূপ তা ভুক্তভোগীরা আমার চেয়ে ভাল বলতে পারবেন। জাপানে ছাত্র থাকাকালীণ আমি সপ্তাহে একদিন রাইসকুকারে ভাত রান্না করতাম বেশী করে। সাতদিন পর্যন্ত সে ভাত একই মানের স্বাদ ও তৃপ্তি দিত। সেই জাপানীজ রাইস কুকার দেশে আনার পর আমাদের দেশের বাজারে থেকে কেনা চালে রান্না করা ভাত একবারের বেশী খাওয়া দুষ্কর। হয়তো ভাত শুকিয়ে চালভাজা হয়ে যায়-নয়তো একটু বেশী পানি দিলে ভর্তা হয়ে যায়। এর প্রধান কারণ, চালে ভেজাল। যাক্ সেকথা।
এখন মুল কথা হলো বাজারে সেই চালেরও আকাল সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ চালের অগ্নিমূল্য ভোক্তাকে ভোগাচ্ছে। বাজারের ছোট ব্যবসায়ীরা জানালেন, কিছু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে মোটা ধান কিনে নিয়ে যাবার ফলে হঠাৎ করে মোটা ধানের দাম বেড়ে গেছে। ধান কিনে গুদামে মজুদ করার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতেছেন তারা। মিলারদের দৌরাত্ম্য হলো- তারা ধান কিনে মজুদ করলেও  চাল উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন।
অপরদিকে চাল ব্যবসায়ীরা চাল আমদানী বন্ধ করে দিয়েছেন। আমদানী শুল্ক কমানোর দাবী তাদের। এ ফাঁকে বাজারে একদিনের ব্যবধানে কেজিতে ৬১ টাকায় মিলরেটে থাকা মিনিকেট নামের নকল-ভেজাল চাল ৬৮ টাকা এবং নাজির শাইল নামের চাল ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দামের উঠানামার ব্যাপারে সরকারী কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ীরই সব দাম নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।
আরো বিপদের কথা হলো- প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবছর সারা দিশে বোরো ধানের আবাদে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বোরো দানের ডিপো হিসেবে খ্যাত হাওড়গুলোতে ফ্লাশফ্লাড, দিনাজপুর, রংপুর, শেরপুর, জামালপুরে অতিবৃষ্টির ফলে পাকা ধান দীর্ঘদিন পানিতে তলিয়ে থেকে পঁচে যাওয়ায় খাদ্য সংকটের সৃষ্টি করবে। এছাড়া বার বার ঝড়-বৃষ্টিতে শুধু নওগাঁ জেলাতেই বোরো ধানের সাড়ে চার লাখ মেট্রিক টন ফলন কম হয়েছে।
চালের দামে উর্ধ্বমুখিতার জন্য দরিদ্র মানুষ দিশেহারা। সরকার দায়ীদের চিহ্নিত করে মজুতদারীদের বিরুদ্ধে এ্যকশান নেবার কথা বললেও তা কিভাবে নেয়া হবে জানা যায়নি। যারা চাল ব্যবসায়ী নন তারা আনঅথারাইজড্ ব্যবসা করছেন কি-না সেজন্য পর্যাপ্ত তথ্য পেতে পেতে বাজারের লাগাম টেনে ধরার কোন উপায় আছে কী?
প্রয়োজনে আমদানী শুল্ক কমিয়ে দ্রুত চাল আমদানীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বাজারে কিছুটা স্বস্তিভাব আসতে পারে। তবে চাল ব্যবসার সথে জড়িত তথা মানুষের মৌলিক চাহিদার সাথে জড়িত সকল প্রকার ব্যবসায়ীদেরকে অতি লাভের অঙ্ক ভুলে মানুষের জন্য উদার হওয়াটাই এসময় সবচেয়ে জরুরী। তা-না হলে ইরি-বোরো ধানের ভরা মৌসুমে মোটা চালের দামও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থেকেই যাবে। আর নিয়ন্ত্রণহীন খাদ্য বাজারের পিছনে বিকট অট্টহাসির শব্দ শুনে কাঁদতে থাকবে মানবতা!

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top