পোষা বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধা যায়
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
করোনাকালে আমাদের একটি হুলো পোষা বিড়ালের গলায় হঠাৎ একদিন একটি রঙ্গীন সুদৃশ্য বেল্ট পরানো দেখে কিছুটা অবাক হলাম। দেখতে ভালই লাগছে তাকে। সংগে গলার নিচে একটি ছোট্ট কাঁসার ঘন্টার মত জিনিষ ঝুলছে। সে হাঁটলে ঝুমঝুমির মত ঝংকার বেজে উঠে। তবে মনে হয় ওর সেটা পছন্দ হয়নি। তাই আমাকে দেখে দৌড়ে কাছে এসে বসে তার পা দিয়ে গলায় চুলকাতে চুলকাতে করুণ চাহনি দিয়ে তাকিয়ে থাকলো। সবচেয়ে বড় বিড়ালের গলায ঘন্টা বাঁধা দেখে বললাম ওটা কে বাঁধলো? আর এ সময় জিনিষটা পেলোই বা কোথায়?
বিড়ালগুলোর একজন বড় মালিক আছেন। তিনি বললেন, কেন? ইন্টারনেটে আজকাল সবকিছুই অর্ডার দিয়ে কেনা যায়। পেটস্-এর জন্য নির্ধারিত পেজে যাও দেখবে বিদেশে ওদের জন্য কত খাবার, কত সাজুগুজু করার জিনিষ রয়েছে। আমদের দেশে তো ওদেরকে ছেই ছেই করে তাড়িয়ে দিই। কত অমানুষ আমরা। ওরা ক্ষুধার জ¦ালায় মিউ মিউ করলেও আমাদের বোঝার সাধ্য নেই সেসব ভাষার। অথচ ওরা নিজেদের একেক প্রয়োজনে একেক ধরণের শব্দ বের করে গলা থেকে। তুমি কি জানো, মোট ১৯ ধরণের ভিন্ন ভিন্ন অর্থের শব্দ করতে জানে ওরা। ওদের মনে আনন্দ হলে গড় গড় করে, গলা ঝাকি দেয়। একটু প্রশংসা করলে মুখ হা করে হাই তুলে সাড়া দেয়। তুমি তো শুধু লিখ আর লিখ। অথচ এসবের কিছুই জানো না!
আমি এতগুলো কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না তবু শুনে কিছুটা জ্ঞান হলো বলে মনে হলো। তাই নিজেকে বোকা ভেবে সামলিয়ে নিলাম। ভাবলাম, বিড়ালের গলায়ও তাহলে ঘন্টা বাঁধা যায়। মানুষ বেঁধে সেটা ব্যবহার করে প্রমাণও করেছে। কিন্তু প্রবাদে যে বলে- বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধলে ইঁদুর সেটার শব্দ শুনে পালিয়ে যাবে। আর ইঁদুর বেড়ে গেলে জমির উঠতি ফসল, ঘরের গোলার ধান, হেঁসেলের তৈরী খাবার সবকিছুই উজাড় হয়ে যাবে অল্পদিনেই। সেজন্য কেউ বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে রাজী নয়। এতসব ভাবতে ভাবতে চা-টা শেষ করে উপরে উঠে গেলাম। ভাবলাম আমি অনেক কিছুই জানি না। পৃথিবীতে কত অজানা জিনিষ রয়েছে। সবকিছু মানুষের জানার সাধ্যের বাইরে।
টেবিলে বসে ভাবলাম দৃশ্যমান পোষা বিড়ালের গলায় বেড়ি পরানো যাবে, পোশাক পরানো যাবে। ওদের গলায় ঘন্টা বাঁধা গেলেও অদৃশ্য বিড়ালদের গলায় কীভাবে ঘন্টা বাঁধা যাবে? যেমন অদৃশ্য করোনার জন্য টিকা যদি প্রতিরোধের ঘন্টা সদৃশ হয় তাহলেও টিকার কার্যকারীতা কতদিন সেটা আমাদের এখনও অজানা।
অদৃশ্য জীবাণুর আঘাতের ফলে করোনাকালে পৃথিবীটা কেমন যেন পান্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে। সবাই অনেকটা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। দয়া-মায়া কমে গিয়ে আসল-নকল ভুলে ভেজালদারিত্ব কায়েমের জন্য ফন্দি তৈরী করেছে। ঘরে বসেই প্রতারণার নিত্য-নতুন ফাঁদ তৈরী করে মানুষকে বিপদে ফেলে দিচ্ছে।
বায়বীয়, ইথার, সনিক বুম সবকিছুর উর্দ্ধে উঠে ’ই’যেন অতিপ্রিয় কিছু একটা হয়ে গেছে। সবকিছুই যেন ‘ই-ই-দেসো’। অর্থাৎ, সামনে একটা ’ই’ জুড়ে দিলেই হলো। অবশ্য কোন কোন দেশে ’ই’ বা ইয়ো’ শব্দগুলো ভাল কিছু অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। জাপানীজে ‘ই-ই-দেসো’কথাটির অর্থ ‘খুব ভাল’। কিন্তু বাস্তবতা ও ভার্চুয়াল এ দুটো জিনিষের তফাৎ তখনও কেউ ভাবেননি। ফলে ভার্চুয়াল চোর-জালিয়াতরা এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের পোয়াবারো অবস্থা সূচিত করে নিচ্ছে। এরা মুহূর্তেই নিজেদের রং বদলায়, প্রোগ্রাম পরিবর্তন করে বা হ্যাক করে সবকিছু গুটিয়ে সটকিয়ে পড়তে পারে। বিপদে পড়লে তাদের নেওটা অদৃশ্য বিড়ালদেরকে এক মিনিটেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে। বা জেলখানা যাবার আগেই হাজতখানা থেকে ছাড়িয়ে আনার মহাশক্তি প্রদর্শন করে কার্য উদ্ধার করতে সক্ষম তারা বা তাদের নেটওয়ার্ক।
প্রচলিত ভাইরাস প্রতিরোধ সিস্টেম তাদের কাছে কিছুই নয়। সব সিস্টেমের পাহাড় পেরিয়ে যেতে অতি পারঙ্গম তারা। আজ এক, কাল দুই, পরশু তিন করে নতুন ই-প্রতারক প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশিত হয়েই চলেছে প্রতিদিন। সেই ই-ভ্যালী দিয়ে শুরু হয়ে, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, আলেশা মার্ট, রিংআইডি, কিউকম- কেউ কম যায়নি প্রতারণার ডালি সাজাতে। ই-ক্যাব তাদের সদস্যপদ বাতিল করেছে তাতে কী? গলায় তো আর ঘন্টা পরাতে পারেনি। শুধু নজরদারী করলে তো কাজ হবে না। তাদের কার্যক্রম ‘ই’ পদ্ধতিতে চলে আর তাদের ওপর নজরদারী করা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলে ‘এফ’ পদ্ধতিতে। এগুলো হলো অত্যাধুনিক কম্পিউটারাইজড বিষয়ভিত্তিক ব্যবসা। থাক্ এসব কথা। এখন আসি কিছু সেঁকেলে কিন্তু বর্তমান সময়ে আরও গুরুতরভাবে বেড়ে যাওয়া বিড়ালদের তৎপরতা নিয়ে।
সম্প্রতি চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়াদের ধরতে দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। বছরে ৭৬টি চলন্ত ট্রেনে ১১০ বার পাথর ছুঁড়ে ১০৩টি জানালার কাঁচ গুড়ো করে দেয়া হয়েছে। আহত হয়েছে ড্রাইভার, যাত্রী অনেক। এই দুবৃত্তদের দেখা যায়, কিন্তু ধরা যায় না। ঢিল ছুঁড়ে নিমিষেই তারা অদৃশ্য হয়ে যায়। বিশেষ করে রেল লাইনের ধারে বস্তি উচ্ছেদ করার ফলে সেসব এলাকায় পাথর ছোঁড়ার প্রবণতা বেশী। গ্রামের কিছু এলাকায় শিশুরা মজা করে ট্রেনে ঢিল ছুঁড়ে থাকে। তাদের সামাজিক শিক্ষা বা পারিবারিক শাসন নেই। এসব বিড়াল রাত হলে বাড়িতে বাবা মা-অভিভাবকদের সাথে ঘুমায়। সকালে কেউ কেউ স্কুলে যায়। বাবা মা-অভিভাবক, স্কুলের শিক্ষক কেউ তাদেরকে ট্রেনে ঢিল ছোড়ার ব্যাপারে সতর্ক করে না, শাসায় না। এখন স্কুলের শিক্ষকগণ কেউ তাদের ছাত্রদের কুকর্মের ব্যাপারে শাসাতে চায় না। কারণ, সেজন্য হিতে বিপরীত হতে পারে, মামলা বা চাকুরীও চলে যেতে পারে তাদের। স্কুল কমিটির সভাপতি বাজারের মধ্যে প্রধান শিক্ষকের গালে থাপ্পর দিয়ে অপমান করার খবরও শোনা যায়। আমরা এখনও ততটা সভ্য হইনি।
আমাদের নদী সমুদ্র থেকে ইলিশ চুরি করে ধরে নিয়ে যায় বিদেশী জেলেরা। দেশে ধরা মাছ বিদেশে পাচার হয়ে সেখানে দেশের চেয়ে স্বল্প দামে বিক্রি হয়। দেশের বাজারে ইলিশের চড়া দামে কারো আপত্তি থাকলেও নব্য প্রজেক্ট পাওয়া ও ঘুষখোররা সেটা বেশী দামে কিনতে পারে। স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষ ইলিশ কিনতে না পেরে কোন প্রতিবাদ করারও সুযোগ না পেয়ে ঠোট-মুখ চেটে পুঁটিমাছ কিনে বাড়ি ফেরে।
নদী বা সরকারী জমি দখলকারীরা দলবদ্ধভাবে যোগসাজশ করে অপরাধ করে। বড় অপরাধ করে তারা ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে গোপনে সর্বনাশ না করে প্রকাশ্যে দখলবাজি করে অবৈধ সম্পত্তির ভাগ নেয়। তাদের চেনা যায়, ধরা যায়-কিন্তু শাস্তির বিধান নেই। কারণ তারা সংঘবদ্ধ জালিয়াত ও প্রতারক। এই চক্র রাজনৈতিক দল বদল করে এবং সব সময় অবৈধ সুবিধা নেয় ও দেশের ক্ষতি করে। এদের গলায় ঘন্টার বদলে সাইরেন বেঁধে দেয়া উচিত। যাতে জনগন তাদেরকে দেখলেই চিনতে পারে ও ঘৃণা করে থু থু নিক্ষেপ করতে পারে।
ঋণ জালিয়াতি, ব্যাংক জালিাতি, গণপরিবহনে নৈরাজ্য, মাদক ব্যবসা ইত্যাদির কথা না হয় আজ নাইবা লিখলাম। দেশের সব জায়গায় বিড়ালরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। তপস্যা করছে কখন ইঁদুর তাদের সামনে দিয়ে নড়াচড়া করবে। নাগালের মধ্যে এলে খপ করে ধরে ফেলবে। নতুবা চোখ বুঁজে ভান করে ঘুমিয়ে থাকবে। অথচ, তাদের গলায় ঘন্টা থাকার কথা। আমাদের দেশে কোন সেক্টরেই এসব পোষা বিড়ালের গলায় ঘন্টা নেই। সীমাহনি দুর্নীতি ও পুকুর-নদী চুরি ঠেকাতে পোষা বিড়ালের গলায় আগে ঘন্টা বাধুন। কারণ, পোষা বিড়ালরা নিয়মিত মাসোহারা পাবার পরও দেশের সম্পদ চুরি করে, বিদেশে পাচার করে আরো মোটাতাজা ও অলস হয়ে সাধুতার ভান করছে ও দেশরূপী গৃহস্থের ক্ষতি করছে।
এই ঘন্টা হলো প্রতিরোধমূলক সমস্যা সমধান প্রক্রিয়ার আধুনিক কৌশল। সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সেবকদের গলায় ঘন্টা পরিয়ে দিলে অপরাধীরা সতর্ক হবে এবং অপরাধ এমনিতেই কমে আসবে। অথচ, আমাদের দেশে কোন সাধারণ সমস্যা বা ঘটনা যতক্ষণ মহা-দুর্ঘটনায় রূপ না নেয় ততক্ষণ কারো বা কোন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। তাই জনসেবকরূপী সকল বিড়ালদের গলায় আগাম ঘন্টা বেঁধে দেয়া হোক। তাহলে আসল-নকল চেনা যাবে। নকল বা ভূয়া পুলিশ-ডিবি, ভূয়া ম্যাজিস্ট্রেট-মেজর, প্রতারক সরকারী কর্মচারী সবাইকে কর্মস্থলে আলাদা করে জানা যাবে।
আমার বাসার সেই হুলো বিড়ালটির মত এসব ভিজা বিড়লরূপী ই-জালিয়াত, ই-প্রতারক এবং শরীরি-অশরীরি মাধ্যমে অন্যায়ভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠা অবৈধ বিত্তশালীদেরকে ঠেকাতে না পারলে দেশে আয় বৈষম্য আরো প্রকট হবে। এভাবে নিত্যপন্যের বাজারে আগুন লেগে মধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্ত হবে এবং নিম্ন আয়ের মানুষেরা দিন দিন ধূলোয় মিশে যেতে পারে। তাই বন্য বিড়ালের আগে সকল মানুষরূপী পোষা বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধা জরুরী। এবং আগেই বলেছি শুধু প্রবাদ বলে নয়- এখনও নষ্ট মানুষরূপী পোষা বিড়ালের গলায় ঘন্টার বদলে সাইরেন বাঁধার জন্যও আমাদের সমাজে কিছু নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ অবশিষ্ট আছেন। তাদের সততাকে পুঁজি করে দেশের ইতিবাচক আর্থ-পরি-সামাজিক পরিবর্তন আনয়ন করা জরুরী।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য