এত উন্নত যুগে কলেরা-ডাইরীয়া কেন
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
কলেরা- ডাইরীয়া গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের পেটের অসুখ। এক সময় এগুলো মহামারী আকারে ছড়াতো এবং শহর-গ্রামের মানুষ দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। একসংগে কয়েকটি গ্রামের মানুষ কলেরার আক্রমণে উজাড় হয়ে যাবার কথা এখন শুধু গল্প। দূষিত পানি পান পরিহার ও সামান্য স্যালাইন পানির আবিষ্কারে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। সরাসরি হাওড়, পুকুর, নদীর পানি পান করা থেকে মানুষ সাবধান হয়েছে তারপর এর প্রতি মানুষের ভীতি কমে গেছে।
কিন্তু কলেরা-ডাইরীয়ার সংক্রমণ থেমে যায়নি। এখনও বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর এসব রোগে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে সারা বছর কোথাও না কোথাও ডাইরীয়ার প্রকোপ বেড়ে যেতে দেখা যায়। গরম শুরু হলে এর প্রকোপ শুরু হয় এবং বড় বড় শহরের দরিদ্র ও জনবহুল এলাকায় এর সংক্রমণ বেড়ে যায়। এবছর মার্চের শুরু থেকে রাজধানীর নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বস্তি এলাকাগুলোতে এর প্রকোপ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে।
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে মহাখালীর আসিডিডিআরবি-র কলেরা হাসপাতালে রোগী ভর্তি শুরু হতে থাকে। সেখানে যাত্রাবাড়ী ও সায়দাবাদ এলাকার রোগী বেশী এসেছেন বলে জানা গেছে। এসব রোগী শরীরে মারাত্মক পানিশুণ্যতা নিয়ে মুমূর্ষূ অবস্থায় ভর্তি হয়েছেন। নিয়ন্ত্রণহীন পাতলা পায়খানা, ঘন ঘন বমি, জ¦র, অবশ শরীর নিয়ে এসেছেন অনেকে। তাদেরকে পর পর চারটি করে স্যালাইন দিতে হচ্ছে। গত ১৮ মার্চ থেকে প্রতিদিন ১০০০-এর বেশী ডাইরীয়া রোগী ভর্তি হয়। সাত দিনের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে ১৩০০ প্লাস হতে থাকলে হাসপাতালে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় চিকিৎসা নিয়ে সংকট তৈরী হতে থাকে। এ অবস্থায় ২টি বড় তবু টাঙ্গিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় চিকিৎসা সেবা দেয়া শুরু হলেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
মার্চ ২০ তারিখ বিশ্ব পানি দিবস। সেই দিন আসিডিডিআরবি-র কলেরা হাসপাতালে প্রতি ঘন্টায় ৫০-৬০ জন রোগী মারাত্মক পানিশুণ্যতা নিয়ে মুমূর্ষূ অবস্থায় ভর্তি হয়েছেন। সুজলা-সুফলা পানির দেশ বাংলাদেশ, বন্যার সময় দেশটির সিংহভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে পানি উধাও হয়ে যায়। মিঠা পানির উৎস নদী, খাল, বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। গ্রামের মানুষ টিউবওয়েলের পানি পানে অভ্যস্ত হলেও শহরের মানুষ ওয়াসার পাইপে সরবরাহকৃত পানি পান করেন। ওয়াসার অতি পুরাতন পানির পাইপ লাইনে ত্রুটি থাকায় সে পানিতে ময়লাসহ মারাত্মক দূষণ পাওয়া গেছে। অধুনা গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় পানি ফুটিয়ে পান করার প্রবণতা শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে কমে গেছে। বস্তিতে বসবাসরত মানুষ কোনমতে সংগ্রহকৃত পানি না ফুটিয়েই পান করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।
গরমকাল শুরু হলে আমাদের দেশের শহরগুলোতে মশা বেড়ে যায়। সারা দেশে কলেরা, ডাইরীয়া আমাশয়, টাইফয়েড ইত্যাদি অসুখের প্রকোপ বাড়ে। গত আড়াই বছর ধরে করোনার কারণে মানুষের এসব অসুখের কথা কেউ ফোকাস করেনি। হয়তো করোনার ভয়ে এগুলার কথা মানুষ পাত্তা দেননি। এছাড়া করোনার সময় মানুষ ঘরবন্দী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় বাইরের খাবার ততটা খাননি।
এবছর করোনার সংক্রমণ কমে যাবার সাথে সাথে মানুষ ঘরের বাইরে বের হয়ে পড়ে। খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে চরম অসতর্ক হয়ে যায়। বিশেষ করে স্কুল কলেজসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার সাথে সাথে শিক্ষার্থীরা পুনরায় খোলা খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিশেষ করে স্কুলের বাচ্চারা ভ্যানে খোলা দোকানের খাবার- আচার, নকল আইসক্রীম, জুস, বেলের শরবৎ, চটপটি, আখের রস, ঝালমুড়ি ইত্যাদি খেতে খুব পছন্দ করে। শরবতের মধ্যে দূষিত পানি দ্বারা তৈরী বরফ ব্যবহার করা হয়। পুরাতন বোতলে ট্যাপের দূষিত পানি ভরিয়ে ফ্রীজে ঠান্ডা করে নকল লেবেল লাগিয়ে ফেরী করে বিক্রি করে এক শ্রেণির অসাধু মানুষ। জীবিকার তাগিদে এটাই তাদের ব্যবসা।
নিম্ন আয়ের মানুষ রাস্তার পাশের খোলা দোকানের ভাত, বাসি-পঁচা খাবার, এলোভেরা ভেষজ পাতার নেলপা শরবৎ, লেবুর শরবৎ, বেলের শরবৎ ইত্যাদিতে অভ্যস্ত। সেসব দোকানে একই গ্ল্াস না ধুয়ে সবাইকে পরিবেশন করা হয়। অথবা ময়লা বালতির পানিতে একবার চুবিয়ে গ্লাস, থালাবাটি ধোয়া হয়। বাসস্টান্ডে, ফেরীঘাটে, অনেক জনপ্রিয় রেষ্টুরেন্টে পানির অভাবে একই পদ্ধতিতে গ্লাস, থালাবাটি ধোয়া হয়।
বর্তমানে করোনার ভয় কমে যাওয়ায় বিত্তবান পরিবারের মানুষ ভ্রমণে বের হয়ে পুনরায় দোকানের ফাষ্টফুড খেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। সমুদ্র সৈকত, পর্যটন কেন্দ্র এবং শহরের দামী রেস্তোরাগুলোতে পাশের্^ল অর্ডার এবং সশরীরে গ্রাহকদের গণভীড় দেখে তাই মনে হয়। এগুলোতেও ভাজা-পোড়া খাবার বিক্রি হয় বেশী যা অস্বাস্থ্যকর।
হঠাৎ বাইরের খাবারের প্রতি আকর্ষণ ও নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ায় ডাইরীয়া-কলেরার মতো পেটের পীড়া বেড়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এছাড়া শহরের দরিদ্র এলাকাগুলোতে সুপেয় পানি সরবরাহে ঘাটতি থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে দূষিত পানি ব্যবহার করছেন। দ্রব্যমূল্যস্ফীতির ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমে গছে। পথের পাশের্^ কমমূল্যে পাওয়া যায় এমন খাদ্য তারা গ্রহণ করছেন। ফলে বহুদিন ধরে নোংরা ড্রামে রক্ষিত পানি ও নিম্নমানের ভাজা-পোড়া, পঁচা, বাসি খাবার খেয়ে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন বেশী।
তাই সভ্যতার উন্নত শিখরে উঠার ধ্বজাধারীদের একটু পাশেই দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের সাথে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও বিশুদ্ধ পানি, সুখাদ্য, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গত আটদিনে আসিডিডিআরবি-র কলেরা হাসপাতালে ভর্তিকৃতরা রিক্সাচালক, শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের ক্ষুদ্র পেশার মানুষ। আর সংগে স্বচ্ছল কিন্তু অসচেতন পরিবারের স্কুলগামী অবাধ্য বা অবুঝ শিশু।
এদের সবাইকে পথের খাবার গ্রহণ থেকে বিরত রাখাও বেশ কঠিন কাজ। তবে ভাসমান খাদ্যের দোকানগুলোকে বিকল্প ব্যবস্থায় সরিয়ে দিতে হবে। নতুবা মানসম্মত খাবার বিক্রি না করার জন্য জরিমানা করে সজাগ করে দিতে হবে। তাদেরকে বোতলজাত বিশুদ্ধ পানি বিক্রি অথবা বিনামূল্যে সরবরাহ করার জন্য বাধ্য করতে হবে। হজ্জ্রে সময় যেভাবে আরব সমাজের বিত্তশালীরা পানি ও জুসের বোতল বিনামূল্যে সরবরাহ করেন আমাদের সমাজের ধনীরা সেভাবে বস্তিবাসী ও পথমানুষদের পেটের অসুখ ঠেকানোর জন্য সুপেয় পানি, স্যালাইন প্যাক, জুসের বোতল ইত্যাদি সরবরাহ করার জন্য উদার হতে পারেন।
বিশেষ করে আসন্ন রমজান মাসে একাজটি করতে পারলে অতি উপকার হবে এবং ক্রমবর্ধমান কলেরা-ডাইরীয়ার সংক্রমণ ঠেকানো সহজ হতে পারে। তা না হলে এত উন্নত যুগে বাস করেও আমাদের দেশে বার বার কলেরা-ডাইরীয়ার মারাত্মক প্রকোপ কেন ঘটে -তা আমাদের চলমান হতদারিদ্রবস্থা নিরুপণের একটি বড় সূচক হিসেবে বিবেচিত হতে দেরী হবে না।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য