logo
news image

গৃহবাস শেষে ঘুরে দাঁড়াব কবে?

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
করোনা সংক্রমণ নতুন হলেও এর চেয়ে বড় বড় মহামারীর আক্রমণ বিশ^মানবতাকে আগেও বিপদের মুখোমুখি করেছিল। রোগ-শোকে প্রাকৃতিকভাবে প্রলয়ঙ্কারী মানবনিধন ঘটনা নতুন কিছু নয়। গত তিনশ বছরে চারটি বড় বড় মহামারী এই বিশ^বাড়িটাকে আক্রমণ করেছে। কথা হলো, শতাব্দীর বিশসাল এলেই পৃথিবীটা এমন অশান্ত হয়ে উঠে কেন? এরূপ নিত্যনতুন জীবনসংহারী মহামারীর ভয়ঙ্কর থাবায় মানুষগুলো ছিন্নভিন্ন হয় কেন? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন। এটাকে প্রকৃতির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য অথবা চরম প্রতিশোধ নেয়ার খেয়াল বলা যেতে পারে। তবে ঠিক শতবর্ষ পর পর এই মহাদুর্যোগ ঘুরে ঘুরে কেন মানব সভ্যতাকে আঘাত করে তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
মানুষ অপরের জন্য ভাবার পূর্বে নিজেদের অবস্থা নিয়ে ভাবছে। ক’মাস পূর্বে চীনের উহান যখন মৃত্যুভয়ে কাতরাচ্ছিল তখন আরকেটি বড় দেশ নানা ধরণের উস্কানী দিয়ে তাদের দু:খ কষ্টকে তাচ্ছিল্য করে সংবাদ ছড়াচ্ছিল। অন্যদিকে, ইউরোপ, আমেরিকা তথা বিশে^র ২০৯টি দেশ এখন মৃত্যুভয়ে কাতর। যুক্তরাষ্ট্রে এপ্রিল ৮ পর্যন্ত ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৫৩৭ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১২,২৭২ জন। দেশটির জন হফকিন্স বিশ^বিদ্যালয়ের আজ রাত সাড়ে আটটার পর্যন্ত দেয়া তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন আরো দু’হাজার। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক এখন ভয়াবহ মৃত্যুপুরী। মাংস পরিবহনের ফ্রোজেন গাড়িতে গাদাগাদি করে লাশ রাখা হচ্ছে এবং জানাজা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে সংবাদে জানা গেছে।
সামাল সামাল রব চারদিকে। এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগের ঘনঘটার মধ্যে বিশ^মানবতার কাতর গোঙ্গানীর মধ্যেই উহানে আতশবাজি পোড়ানো শুরু হয়েছে! এটাকে কি বলা যায়? বিশ^ব্যাপী বিপদের মধ্যে উহানে আতশবাজি ফুটানোর ঘটনাকে অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। ইতোমধ্যে চীনের অন্যান্য জায়গায় নতুন করে সংক্রমণ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
শধু কি তাই? এমন বিপর্যয়ে যিনি করোনা রোগীকে শুটিং স্কোয়াডে দিয়ে দিতেন বলে সংবাদে এসেছে- সেদেশে বিশে^র এমন নাজুক সময়ে প্রজেক্টাইল ক্ষেপনাস্ত্র ছুড়ে শক্তি প্রদর্শণের বিষয়টি বিবেকবান মানুষ কেমন করে গ্রহণ করবেন আমার জানা নেই। উত্তর কোরীয়া জাপান সাগরের ৪১০ দুরে কি:মি: অর্থনৈতিক এলাকায় ৫০ মিটার উচ্চতায় প্রজেক্টাইল ক্ষেপনাস্ত্র ছুড়ে উল্লাস করছে গত ২৯ মার্চ। এর কিছুদিন পর আবারো ক্ষেপনাস্ত্র ছুে ছে এবং করোনা সন্দেহে গুলি করে মানুষ মেরেছে। হায়রে মানুষ! ওরা জনেনা, গুলিতে করোনা রোগীকে মেরে ফেলা হলেও করোনাকে মারা যায় না!
দেশের ভেতর আসা যাক্। আমাদের দেশে একদিকে করোনা আতঙ্কিত মানুষকে ঘরের মধ্যে সাবধানে থাকতে বলা হচ্ছে। অন্যদিকে ভোটকেন্দ্রে ভোটের আয়োজন করে ভোট কেন্দ্রে আহব্বান করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষ কোনটিকে বেছে নেবে? করোনায় বিচলিত মানুষ ঢাকার ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে না গেলেও (মাত্র ৫.৮%)  ভোটগ্রহণের প্রহসন করে নির্বাচিত প্রার্থীর নামও ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে।
গত ৪ এপ্রিল গার্মেন্টস কারখানা খুলে দিয়ে রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় এক বিশৃংখল অবস্থা সূচিত হয়েছিল। গার্মেন্টেস-এর কর্মীরা ঢাকায়  এসেছেন পায়ে হেঁটে। এসই শুনেন পুনরায় তদের কারখানা বন্ধ করে দেয় হয়েছে। তাদের মেস ও বাড়িওয়ালারা করোনার ভয়ে তাদেরকে বাড়িতে ঢুকতে বাধা দিয়েছে। সেটা আরেক অমানবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এই কঠিন সময়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন- তাঁকে এসব সিদ্ধান্তের কিছুই জানানো হয় না। গণতন্ত্রের আধুনিক যুগে ব্যবস্থাপনার এই ধরণের সমন্বয়হীনতাকে বিবেককান মানুষ ক্ষমতার দেউলিয়াত্ব মনে করে। এই ধরণের বিশৃংখল প্রশাসনিক যোগাযোগহীন আচরণকে মানুষ ভাল বলে কখনও মেনে নেয় না। এভাবে সামাজিক ঘৃণা জমা হয় ও একসময় ঘণীভূত হয়।
অনেকেই নিজেরটা বগলদাবা করে অজ্ঞানতার নিকষ অন্ধকারে ব্যাপক পদচারণা শুরু করেছেন। এপ্রিল ৮ তারিখে হাতিবান্ধায় যৌতুকের জন গৃহবধূকে শ^াসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। টেকনাফে মাদক চোরাকারবারীদের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহতের কথা জানা গেছে। দেশে-বিদেশে এত বিপর্যয়ের মুখেও মানুষর মধ্যে নৈতিক দিকগুলোর চরম অবনতি যেন শেষ বিচারের দিনকেই আহব্বান করছে!
কিছু মানুষ নির্বোধের মত আচরণ শুরু করেেছ। স্বার্থপরের মত কেনাকাটা করে বাজারদর বাড়িয়ে হতাশা তৈরী করছে নির্বোধ মানুষ। তারা ভুলেই বসেছে যে শুধু- গুদামভরা খাদ্য ও ব্যাংক ভর্তি টাকা মানুষের জীবনকে বাঁচাতে পারে না। এই নির্বোধ মানুষের হেয়ালী আচরণের জন্য করোনার কাছে আমরা হেরে যেতে পারি।
একজন পাঁচ টাকার মাস্ক পঞ্চাশ টাকায় কিনে অত্যন্ত ক্ষোভের স্বরে বলেছেন- আমরা লোভী ও নির্মম জাতি। করোনার আতঙ্কে পরেও শিক্ষা হচ্ছে না আমাদের। টাকার কুমির হয়ে যারা পদ-পদবী কিনে হিরো হয়েছেন তারা করোনা ঝড়ে হঠাৎ জিরো বনে গিয়ে ফতুর হতে পারেন সেই বোধোদয়টিও তাদের মনে জাগছে না। অতি সুদখোর-মুনাফোখোররাই আমাদের সমাজের করোনা ভাইরাস।
যুগে যুগে সুদখোর-মুনাফোখোরদের নির্মম আচরণ সামাজিক বঞ্চনার পাহাড় গড়ে তুলে যুদ্ধের ডামাডোল বাজিয়ে তোলে। এদের জন্য কখনও অভাবী মানুষেরা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে কলেরায় মারা যায়, কখনও প্লেগে জীবন দেয়।
আপাতত: গত তিনশ বছরের পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব ভয়ঙ্কর মহামারী হয়েছিল সেগুলোর ইতিবৃত্ত থেকে জানা যায়- ১৭২০ সালের গ্রেট প্লেগে একলক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ফ্রান্সের মার্সেই বন্দরে উৎপত্তি হওয়া সেই প্লেগে সেখানে ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এজন্য পরবর্তী ৪৫ বছর পর্যন্ত ফ্রান্সে জন্মহার কম ছিল। এশিয়াটিক অতি কলেরা জন্ম নিয়েছিল কলকাতায় বৃটিশ সৈন্যদের শিবিরে ১৮২০ সালে। এরপর অর্ধেক বিশে^ কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। কত লক্ষ মানুষ যে প্রান হারিয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। শুধু ব্যাংকক শহরেই ৩০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। এরপর স্পেন থেকে সারা বিশে^ ছড়িয়ে পড়া ১৯২০ সালের স্পানিশ ফ্লুতে ১৭ থেকে ৪৫ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল বলে জানা যায়। অর্থাৎ, ২০২০ সালের করোনা মহামারী প্রাদুর্ভাবের পূর্বে এই বিশ^বাড়িটা অনেক ভয়ঙ্কর মৃত্যুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল। তাই করোনার ভয়াবহতা নতুন হলেও এর মত দানবীয় মৃত্যুদূতেরা আগেও এস মানব সভ্যতাক নির্মমভাবে হানা দিয়েছে। মহমারীগুলো নির্বিচারে মানুষ কমিয়ে ফেললেও এত কিছুর পরেও পৃথিবীটা ঘুড়ে দাঁড়িয়েছে।
ইতোমধ্যে অনেক দেশেই করোনা ভাইরাস নির্মূলের জন্য টিকা আবিষ্কার করেছে এবং সেগুলোর কার্যকারীতা যাচাইয়ের জন্য ট্রায়াল চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকগণ  মুখে খাবারের জন্য বড়ি তৈরী করে এর কার্যকারীতা যাঁচাইয়ে সফল হয়েছেন বরে এপ্রিল ৮ এর প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে। এই বড়ির নাম ইআইডিডি- ২৮০১। গবেষকগণ দাবী করেছেন এই বড়িটি গিলিয়াডের ওষুধের চেয়ে সফলভাবে করোনা ভাইরাসকে ঠেকাতে পারবে।
আমাদের দেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ। উন্নত বিশে^র দেশগুলো যেখানে নির্দেশনা মেনেও হিমশিম খেয়ে ঘরে ঢুকে নাজেহাল হয়ে পড়েছে- সেখানে আমরা কে শুনছি কার কথা? এখন পর্যন্ত মাত্র চার হাজার দুইশত উননব্বই জন রোগীর করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। আমরা নির্দেশনা না মেনে হরদম বাজারে ঘুরছি, বাইরে আড্ডা দিচ্ছি। দেশে গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে ৫৪ জন আক্রান্ত হয়েছে। এই গতি ভয়াবহ। এজন্য আমাদেরকে ভয়ংকর মাসুল দিতে হবে!
তাই এখন প্রয়োজন ধৈর্য্যর সাথে স্বাস্থ্য-সতর্কতার নির্দেশাবলী অনুসরণ করে নিজে মেনে ও পরিবারের সদস্যদেরকে মানার পরামর্শদান ও এ বিষয়ে অপরাপর সবাইকে বিশেষ সহায়তা করে দিনগুজরান করা। গুজব ও উত্তেজক বক্তব্য না দিয়ে সবাই একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করার মধ্যে কল্যাণ নিহিত থাকে।
অভিজ্ঞতা বলে- প্রতি বিশসালে বিশ^বাসী মহামারীর কারণে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে নৈতিকতায় শাণিত হবার শিক্ষা নিয়ে পুন: ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি খুঁজে পায়। সেজন্য সবাই যার যার ধর্ম ও অবস্থান থেকে প্রার্থনা করুন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রার্থনা আমরাও যেন অচিরেই সেই শক্তি খুঁজে পাই।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top