logo
news image

নেবোনা-দেবোনা করোনা

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
ব্রাজিলে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে যিনি ঠাট্টা করেছিলেন, মাস্ক পরা নিয়ে যার অনীহা পরে আবার তিনিই বলেছেন- ‘করোনা হলো বৃষ্টির মতো। এতে সবাই ভিজবে।’ নিজের মত পাল্টানো এই স্বনামধন্য ব্যক্তি হলেন, ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বল সেনারো। তিনি এখন আরো বলেছেন - সবাইকে মাস্ক পরে বাইরে বের হতে হবে। কি দারুন উপলব্ধি ফিরে এসেছে তাঁর মনের মধ্যে!
যারা বলতেন করোনা একটা ছোট্ট ফ্লু, তেমন ভয়ের কিছু নেই ওতে। তাঁরা অনেকেই এখন এর মরণ কামড়ে কুপোকাত। ক্ষমতাধরদের অনেকেই এই ছোট্ট অনুজীব প্রোটিনকে অবজ্ঞা করে নিজেদের ঘরে ঢুকতে দিয়েছেন। এই অদৃশ্য শেয়ানা অতিথি এখন ওনাদের ঘর থেকে চলে যেতে চাচ্ছেই না! বরং অগণিত বাচ্চা ফুটিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে স্থায়ী বসতি স্থাপনের ফন্দি করে চলেছে দিনরাত।
তাইতো এদের প্রভাবে আমরা নিত্য নিচ্ছি করোনা, দিচ্ছি করোনা। এই নেয়া দেয়া চলছে অবিরাম। চলবে কি অনন্তকাল? এখন পর্যন্ত সঠিক দিনক্ষণ সর্ম্পকে কেউ ওয়াকেফহাল নন। সেটাই বড় ভাবনা, সেটাই মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে পড়েছে অনেকের মধ্যে।
কেন এমন হলো? দিনরাত বলা হচ্ছে- কোরোনা কেউ স্বাস্থ্যবিধির নিয়ম ভঙ্গ কোরোনা। এই ভয়ানক অতিমহামারীকে কেউ নেবোনা, কেউ প্রশ্রয় দেবোনা পণ করে আমরা কত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি দিনরাত। এরপরও দিন দিন এর দাপট বেড়ে চলেছে। আমরা ক্লান্ত ও নাজেহাল হয়ে পড়ছি। আমরা অনেকেই এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছি।
করোনার প্রতিশেধক বা টিকা এসে গেছে বলে প্রতিদিন আমরা আশার বাণী শুনেই যাচ্ছি। সেই যাদুকর এখনও নেপথ্যেই রয়েগেছে। তাই যাদুকরী সমাধানও এ মুহুর্তে নেই।
এদিকে সংক্রমণ ভয়ানক গতিতে বেড়ে চলেছে। বিশেষত: দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় এর গতি লাগামহীন। হার্ড ইম্যুনিটি ধারণাটি মার্কিনীদের মধ্যেও কার্যকর হচ্ছে না, বরং সংক্রমণ শুরুর চারমাস পেরিয়ে গেলেও উল্টোটা ঘটছে। জুন ৯ তারিখে এসেও ওদের দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুসংখ্যা পুনরায় বেড়ে দ্বিগুণ হচ্ছে। একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ৬০ হাজারেরও বেশী।
আমাদের দেশে সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। রাজধানী ও বড় বড় শহরগুলো পেরিয়ে জেলাশহর ও গ্রামে-গঞ্জে সংক্রমণ ও মৃত্যু দু’টোই বেড়ে গেছে। করোনায় মৃত্যুসংখ্যার সঠিক তথ্যের হিসেব রাখা কঠিন। গ্রামে-গঞ্জের সবাই হাসপাতালে ভর্তি হবার সুযোগ পান না। যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মৃত্যুবরণ করেন শুধু তাদের হিসেবটা সরকারীভাবে রাখা হয়। বাড়িতে যারা মারা যান তাদের হিসেব সঠিকভাবে রাখার কোন ব্যবস্থা নেই। কারণ, অনেকেই নানা ভয়ে করোনা রোগীর তথ্য গোপন রেখেছেন। হাসপাতালে সঠিক সেবা নেই, ভর্তি হলেই রোগীর সাথে আপনজনদেরও সংক্রমণের ভয়, সামাজিকভাবে হেয় হওয়া, করোনাক্রান্ত হয়ে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যাপকভাবে প্রাণহানি আমাদের জনজীবনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ফেলেছে।
এছাড়া ভেজাল রিপোর্ট, ভেজাল মাস্ক, ভেজাল ওষুধ, কিট, ভূয়া সনদ ইত্যাদি মানুষের মধ্যে হতাশা ও ঘৃণার জন্ম দিয়েছে।
 এদিকে রিজেন্ট হাসপাতালের ‘বালতি টেষ্ট’ মানুষের কষ্টেভরা দুর্বল মনকেও বিষিয়ে তুলেছে। ছয় হাজার করোনা নমুনা নিয়ে এই হাসপাতালটি সেগুলো বালতিতে রেখে তার ওপর ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করে সেই নমুনাগুলো ডাষ্টবিনে ফেলে দিয়ে চিকিৎসাসেবার মুখে ঐতিহাসিক কলঙ্কের দাগ এঁকে দিয়েছে। যার ঢেউ আজ সারা পৃথিবীর মানুষ জেনে গিয়ে আমাদেরকে জাতি হিসেবে বিশ^ দরবারে চরম হেয় করে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। বিশেষত: ইটালী প্রবাসীরা দেশ থেকে ইটালীতে ফেরত যাবার সময় টাকা দিয়ে ভুয়া করোনা ছাড়পত্রের রিপোর্ট কিনেছে। প্রতিটি নমুনা দেয়ার সময় পাঁচ হাজার ও টেষ্ট না করিয়ে ঐ নমুনার ওপর ভুয়া রিপোর্ট গ্রহণের সময় সাত-আট হাজার টাকা করে আদায় করেছে। এসব ভুয়া রিপোর্ট দেখিয়ে বিমানে উঠার ক্লিয়ারেন্স নিয়ে অনেক প্রবাসী ইটালীতে ঢুকে পড়লেও সেখানে গিয়ে পুনরায় টেষ্ট করিয়ে করোনা পজিটিভ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। এই ঘটনায় একদিকে যেমন আমাদের দেশের চিকিৎসার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে-অন্যদিকে জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের ভেজাল রিপোর্ট বিক্রির খবর জানাজানি হওয়ায় সারা দনিয়ায় দুর্নীতিবাজ জাতি হিসেবে আমাদের পরিচিতি নতুনভাবে উস্কে দিয়েছে।
জুন ৮ তারিখে ইটালীতে পৌঁছানোর পরও ১৬৭ জনকে রোমের ফিউমিনসো ও মিলানের মালপেনসা এয়ারপোর্ট থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এজন্য আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে থেকে সব ফ্লাইট ও যাত্রী বহন নিষিদ্ধ করেছে ইতালী কর্তৃপক্ষ। কারণ, এর আগের ফ্লাইটগুলোতে ইটালীতে ঢুকে পড়া বাংলাদেশীদের মধ্যে ৪০ জনের দেহে করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে। ইটালীতে করোনার প্রকোপ কমে গেলেও এখন তারা খুবই সতর্ক অবস্থায় পরিস্থিতি যাচাই করছে। এখন বাংলাদেশকে তারা করোনা হটস্পট হিসেবে বিবেচনা করছে।
করোনার এই কঠিন সময়ে নৈতিকতার স্খলন যেন কয়েক ডিগ্রী নিচে নেমে গিয়ে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে পৈশাচিকতার উল্লম্ফন শুরু হয়েছে। অপরাধীরা চরমভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। নৈতিকতার চরম ধ্বস আমাদের অস্থি-মজ্জায় জমে থাকা ময়লাকে খোলামাঠে মেলে ধরেছে। এক শ্রেণির ধড়িবাজ বাটপার ও বিত্তবান মানুষ তাদের কর্মীদের বকেয়া বেতন দিচ্ছে না। ছাঁটাই করে দিচ্ছে অমানবিকভাবে। এরা জমি, গাড়ির ট্যাক্স, গ্যাস, বিদ্যুৎবিল ইত্যাদি সঠিকভাবে দেয়ার সামর্থ্য থাকলেও অফিসের দুর্নীতিবাজ ও অনৈতিক দালালদের সাথে যোগসাজশ করে ফাঁকি দেয়। এরা হীন রাজনীতির ছত্রছায়ায় অতি দ্রুত বড়লোক হয়ে যায়। এই দরিদ্র দেশে কয়েক বছরের মধ্যে অল্পবয়সী চালচুলোহীন পাতিনেতা দুই ভাইয়ের একশত আটাশটি ফ্লাটবাড়ি ও কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া কি খুব সহজ ব্যাপার? তিলে তিলে মানুষকে চুেষ খেয়ে বেড়ে ওঠা এসব মানবতার শত্রুরাই আমাদের মজ্জার ময়লা। রাজপথের ধারে মন্ত্রীর সাথে ব্যানারে-বিলবোর্ডে টাঙ্গানো সুন্দর চেহারার ছবি ও টিভিতে টকশোতে বসে হম্বিতম্বি করে বক্তৃতা দেয়া লোকগুলো যখন অর্থের নেশায় ভুয়া করেনা রিপোর্ট বিক্রি করে কোটি টাকা কামাই করার ধান্ধা করেন তখন আমাদের মজ্জার ময়লাগুলো পচে-গলে আরো বেশী দুর্গন্ধ ছড়ায় বৈ কি?
করোনার মরণ কামড়ে কর্মহীন হয়ে শহরে বাস করা নিম্ন আয়ের মানুষগুলো অভাবের তাড়নায় নিজ গ্রামে ভিটেমাটিতে দু:খিনি মায়ের আঁচলে শান্তির ছোঁয়া পেতে নিরুপায় হয়ে মলিন বদনে ফিরে যাচ্ছে। ওদের কারো কারো নিজ গ্রামের ঠিকানা থাকলেও সেই ঠিকানায় ঘর-বসতি নেই। জমি-জমা নেই, আপনজনও নেই। তারা কোথায় গিয়ে উঠবে, কার কাছে থাকবে?
এই ভাসমান মানুষগুলোর শহরের বস্তি জীবনে এতদিন ঠাঁই হতো। এখন শহরগুলোতে এসব মানুষেকে আর কেউ কাজে নেয় না। সেজন্যই অগত্যা গ্রামের পথে ফিরে যাবার যাত্রা। এদের এই যাত্রাকে ইতিবাচকভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে করোনার মতো ‘আর দিচ্ছি না, নিচ্ছি না’ বলে ভাগিয়ে দিলে চলবে না।
অতি-মহামারী কোভিড-১৯ ঠেকানোর জন্য নেবো না করোনা দেবো না করোনা আমাদের শ্লোগান হওয়া উচিত। কিন্তু এই অতি-মহামারীর প্রভাবে ইতোমধ্যে যে অর্থনৈতিক অতিমন্দা আমাদের দুয়ারে এসে হাজির হয়েছে সেটা সফলভাবে মোকাবেলা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। মানবতার কল্যাণের জন্য এসকল করোনা-ভিকটিমদেরকে নিচ্ছি না, দিচ্ছি না করা যাবে না । এই কঠিন সময়ে এদেরকে ঘৃণা, অবজ্ঞা ও উপহাস কোনটিই, করা উচিত হবে না।
পশুত্বে নেমে যাওয়া মানুষগুলোর মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে আজকে দরকার রিজেন্ট ও জেকেজি হাসপাতালের ‘বালতি টেষ্ট’ কেলেঙ্কারীর হোতাদেরকে গ্রেপ্তার করে কঠিন শাস্তির আওতায় এনে উদাহরণ সৃষ্টি করা। তারা কখনোই মানুষের জীবন নিয়ে এমন ঘৃণ্য অপরাধ করতে পারেন না। এদেরকে যারা নেপথ্যে থেকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও করোনা টেষ্ট করার অনুমতি লাভে সহায়তা করেছেন সেসকল কুলঙ্গারদেরও মুখোশ উন্মোচন করে বিচারের আওতায় আনার সময় এসেছে। অমানুষ ঠেকাতে না পারলে দেশের ভাল মানুষগুলো ওদের প্রভাবে অচিরেই হতাশ হয়ে অমানুষের তালিকায় নাম লেখাতে থাকবে।
এভাবে বাকী সবাইকে বলি আত্মশুদ্ধি করে নিজ নিজ সুপ্ত মনের মানবিকতাকে মেলে ধরুন। বিপর্যয়ের এই ঘোর অমানিশায় ধৈর্য্য ধরুন। মানুষের বিপদ লাঘবের জন্য হাত বাড়িয়ে দিন- বিপর্যয়কে আরো বাড়ানোর জন্য নয়। এই পৃথিবীতে মানুষ মানুষের জন্যই জন্ম নিয়েছে।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top