ওগুলো অতি ব্যবহারে কত ক্ষতি?
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
ক’বছর আগে থেকে বাসার পাশের সংযোগ নালাগুলোতে মশার লার্ভা খেয়ে ফেলার জন্য তেলাপিয়া ও টাকি মাছ ছেড়ে ওদের বংশ বিস্তার করা হয়েছিল। তেলাপিয়ারা বড় হয়ে ভেসে থাকতো, মৌসুমী চ্যাং, খলিসা, ডানকানা ইত্যাদি মাছের সাথে বাদামী ব্যাঙ ও নানা জলজ পোকা মাকড় চোখে পড়তো সেখানে। এলাকার ডানপিটে বাচ্চারা ভেসে থাকা মাছ দেখতে পেয়ে ছোট ছোট ছিপ নিয়ে ভিড় জমিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করে সেসব মাছ ধরে নিয়ে যেত। বিশেষ করে জ্যান্ত চ্যাং মাছ ও বাদামী ছোট ব্যাঙের বেশ কদর। বড় মাছ ধরার টোপ হিসেবে বেশ দাম দিয়ে সেগুলো বিক্রি হতো। কারণ, সেগুলো দিয়ে নদীতে সৌখিন মৎস শিকারীরা রাঘব বোয়াল, গজার প্রভৃতি বড় বড় রাক্ষুসে মাছ শিকার করে থাকে।
আমাদের এলাকাটা নিরিবিলি হওয়ায় করোনার স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রিত সময়েও পাশের রাস্তাগুলো হাঁটাচলা করার জন্য বেশ উপযুক্ত। এবারের বর্ষায় বৃষ্টির পরিমাণ বেশী। নালাগুলোতে পানি ভর্তি। তবে কচুগাছ, আগাছা প্রভৃতি জন্মেছ। প্রতিবছরের মত পাড়ার ছোট ছেলেরা ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে ভিড় করতে আসছে না। এক রোদেলা বিকেলে হঠাৎ ওদের দু’জনের সাথে দেখা হলো। ছিপ নিয়ে এদিক সেদিক যাচ্ছে ও নিজেরা কথা বলছে। ওদের চোখে আগের মত সেই আনন্দ নেই। হাতে মাছ রাখার থলে দেখতে চাইলে বললো- স্যার এবার নালাগুলোতে মাছ নেই। অনেক পানি, দেখতে টলটলে। মাছ, ব্যাঙ, বক, কিছুই নেই কেন?
হাঁটতে হাঁটতে ওদের কথায় সাড়া দিতে দিতে ভাবলাম দেখিতো বিষয়টা কী?
হ্যাঁ, নালার পানি দেখতে বেশ পরিষ্কার। তবে পানির ওপরে এক ধরনের স্তর পড়েছে। সাবান, ডিটারজেন্টের মত একটা ঘ্রাণ বোঝা যাচ্ছে। ফিরতে ফিরতে লক্ষ্য করলাম, বাসার একবারই পাশের ড্রেনটাতে আগের মত মাছি, মশা, ব্যাঙ কিছুই নেই।
ক’দিন ধরে এক ডাহুক দম্পতিকে ছোট কালো ছানা সংগে নিয়ে বাসার ভেতরের বাগানে বিচরণ করতে দেখছি। তাহলে কি ওরা বাইরে স্বাভাবিক খাবারের অভাবে বাগানে খাদ্য খুঁজতে আসে?। হয়তো বা তাই।
মাঝে মাঝে মনে হয় করোনার সময়ে বনের বড় প্রাণিরা বাইরে বের হয়ে লোকালয়ে ভীড় করছে খাদ্যের জন্য। পত্রিকায় এসেছে বিভিন্ন দেশে এই প্রবণতা দেখো গেছে। বাড়ির কাছের ছোট জলজ প্রাণিরা তাহলে ভিন্ন এক সংকটে নিপতিত?
তাই হতে পারে। করোনায় দৈনন্দিন স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে আমরা সবাই ক’বার হাত ধুচ্ছি? বেশী বেশী সতর্কতা অবলম্বন করতে গিয়ে বহুবার সাবান, ডিটারজেন্ট ব্যবহার করে চলেছি। সংগে নানা ব্রান্ডের জীবাণুনাশক স্প্রে ঘরে-বাইরে ছিটানো হচ্ছে হরদম।
করোনা সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই পেতে আমাদের প্রতিরোধ প্রচেষ্টার শেষ নেই। টিভিতে, ইন্টারনেটে এগুলোর প্রচার ও ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপণের বাহার দেখে মানুষ আরো বেশী সতর্ক হয়েছে। পাশাপাশি নকল ও ভেজাল ও মানহীন জীবাণুনাশকের উৎপাদন ও বিপণন আশঙ্কা ও সন্দেহকে আরো বেগবান করেছে।
এগুলোর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার হচ্ছে কি-না তার কোন মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেই।
ধরুন, একটি দশতলা বাড়িতে ত্রিশটি ফ্লাটবাড়ি রয়েছে। প্রতিটিতে কমপক্ষে তিনজন সদস্য বাস করেন। করোনা সংক্রমণ ভীতি ছড়ানোর আগে গোসলের সময় একবার এবং খাবারের সময় দৈনিক তিনবার সাবান ব্যবহার করতেন। কোন জীবাণুনাশক স্প্রে অথবা স্যানিটাইজার তখন ব্যবহৃত হতো না।
করোনা সংক্রমণ ভীতি ছড়ানোর পরবর্তী সময়ে সাধারণ তিনবারের সংগে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত অন্তত: তিনবার। এছাড়া যারা বাইরে কজে যাচ্ছেন তাদের জন্য এই সতর্কতা আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দৈনিক ছয়বার, নয়বার বা কার্যক্ষেত্র ভেদে আরো বেশী বার সাবান, ডিটারজেন্ট, জীবানুনাশক স্প্রে ইত্যাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক বাসায় আসবাবপত্র ও পোষা প্রাণি সুরক্ষার জন্য অনেক বেশী জীবাণুনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে।
মজার ব্যাপার হলো- শুধু ঘন ঘন হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজ করাই নয়, সংসারের অতি প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিষের মধ্যে করোনার ভয়াবহ জীবাণু থাকতে পারে এই ভয়ে অনেক পরিবারে প্যাকেটজাত খাবারের পাশাপাশি কাঁচা বাজার সমগ্রী যেমন- সব্জী, ফলমুল, ডিম, পান-শুপারী, চিঠিপত্র সবকিছুই নিয়মিত স্প্রে করে ঘরে ঢুকানো হয়। এরপর সাবান বা তরল জীবাণুনাশক দিয়ে ভিজিয়ে ধুয়ে নেয়া হয়। খাদ্যসামগ্রীর ওপর এত নির্দেশনা স্বাস্থ্যবিধিতে আছে কি-না জানা নেই। তবে করোনাতঙ্কে মানুষ একজনের দেখোদেখি আরেকজন এইসব অনুশীলন করে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সব জীবাণু ক্ষতিকর বা প্রাণ হরণকারী নয়। প্রাণিদেহের জন্য অনেক উপকারী জীবাণু তথা ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস রয়েছে। অথচ আমরা করোনার জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে গিয়ে প্রাণ রক্ষাকারী বহু জীবাণুকে ধ্বংস করে চলেছি। পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত, মানহীন ও মাত্রাতিরিক্ত সাবান ও অন্যান্য জীবাণুনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নিজের ও পরিবেশের ক্ষতি করে চলেছি।
এর ফলে আমাদের ত্বক, চোখ, খোলস প্রাণির খোল, রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। পুকুর, নদী-নালায় পানির সারফেস নষ্ট করছে। পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে মাছসহ জলজ প্রাণি, শৈবাল নষ্ট করে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া ধ্বংস করছে। মাছ, ব্যাঙসহ উপকারী পোকারা পানিতে ডিম ছাড়তে পারছে না। সারা পৃথিবীতে এভাবে উপকারী প্রাণির বিলুপ্তি ঘটে প্রাকৃতিক জীব-বৈচিত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। করোনাকালীণ বসতবাড়ি থেকে ব্যবহৃত ও অপসৃত মাত্রাতিরিক্ত সাবান, ক্ষার ও জীবাণুনাশকের মিশ্রণ আশেপাশের ডোবা, পুকুর, নালা, জলাধারে মিলিত হয়ে ভয়াবহ পানি, মাটি ও বায়ুদূষণ বাড়াচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ক্লিনিক, হাসপাতালের অপরিশোধিত মেডিকেল বর্জ্য তো আছেই। এর সংগে যুক্ত হয়েছে মনুষ্যরূপী লোভী, চোর-বাটপারদের ন্যক্কারজনক কিছু কাজ। সবমিলিয়ে করোনা আমাদেরকে নাস্তানাবুদ করে তুলেছে।
অন্যদিকে আমাদের মত অসম পেশা ও জনবিন্যাসের দেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরীর জন্য প্রচেষ্টা ভবিষ্যতে নিছক আরো বেশী শ্রেণি-বিভাজন তৈরী করবে। এই প্রচেষ্টায় যারা মাঠে-ঘাটে নিত্যদিনের জীবিকা সংগ্রহে সংগ্রাম করছেন তারাই আক্রান্ত হয়ে নির্মূল হতে পারে। যিনি কাঁচের এসি ঘরে বসে হাতে-মুখে বেষ্টনী দিয়ে এই নির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি বা তাঁর শ্রেণির মানুষেরা নিজেরা নিরাপদে বেঁচে থাকার অপচেষ্টা করছেন। কারণ, ‘হার্ড ইমিউনিটি’-র মূল কথা হলো, ঘরের বাইরে যাও কাজে মিশে যাও, বাঁচার চেষ্টা কর। তারপর ’মইরা-টইরা যা থাকে’। ইংরেজি ‘হার্ড’ কথাটির মাধ্যমে ‘পশুর পাল’ বা দলভূক্ত প্রাণি বুঝায়। একই গোত্রের প্রাণিদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ তৈরী করা অর্থে এটা বেশী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অপরদিকে, আমাদের দেশ থেকে করোনা এমনি এমনি চলে যাবে এমন কথার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যেসব দেশ এমনটি ভেবে অগ্রসর হচ্ছিল তাদের তৃতীয় সংক্রমণ শুরু হওয়ায় বিপদ বেড়ে গেছে। অথচ এজন্য আমাদের দেশজ প্রচেষ্টায় করোনা নিয়ন্ত্রণে এপর্যন্ত কোথাও কোন ইতিবাচক রূপরেখা চোখে পড়ছে না।
তাহলে এই ছোট্ট অদৃশ্য অনুজীবের সামান্য কাহিনী মোকাবেলার জন্য মানুষের শক্তি কি এতটাই সীমিত? কোভিড-১৯ নির্মূলের একটি কার্যকরী টিকা আবিষ্কার করতেই মানুষের গলদঘর্ম অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য দেশে দেশে কর্তৃপক্ষগুলোর ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া বড়ই বিশৃংখল প্রতীয়মান হচ্ছে। করোনা আগামী শীতে দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় ঢেউ ছড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অনেক দেশের গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে শীতকাল শুরু হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে জানা গেছে। করোনা প্রতিরোধের জন্য যেসব জীবাণুনাশক দ্রব্য, ওষুধ ও উপায় ব্যবহার করা হচ্ছে তা আরো কতদিন ব্যবহার করতে হবে তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না। ওগুলো দীর্ঘসময় ধরে অতি ব্যবহারে কত ক্ষতি হবে সে সম্পর্কে এক্ষুনি সতর্কতা অবলম্বন না করলে পৃথিবীতে আারেকটি ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য