logo
news image

করনাতঙ্ক মানুষের সুনামি থামবে কোথায়-কখন?

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
বিশ্বের ১৯৫টি দেশে সংক্রমিত হয়েছে করোনা ভাইরাস। আক্রান্তদের শতকরা ৪-৫ জন সংক্রমণে মারা যাচ্ছেন। এক-দুই করে এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৫১৪ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। এজন্য সারা বিশ্বের মানুষ আতঙ্কিত, দিশেহারা। পৃথিবীটা একটা আবদ্ধ হাসপাতাল, মানুষগুলো সবাই মাস্ক পরা একই রোগের রোগী! প্রতি শতবর্ষে এটা ঘটার নজির আছে, সচরাচর এই ঘটনা দেখা খুব বিরল। মানুষের মুখে মুখে মাস্ক ও চোখে দারুন উৎকন্ঠা একজন অবিচল শান্ত মানুষকেও হঠাৎ অজানা শঙ্কায় আতঙ্কিত করে তুলছে। ঈদের মত অতি কেনাকাটার বহর দেখে মনে হচ্ছে-কেউ এখনই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত নই। আসলেও তাই!
সাধারণত: রোগ-শোকে বিচলিত মানুষ হাসপাতালে যায়, ভাল চিকিৎসা সেবার জন্য অভিজ্ঞ ডাক্তারের সন্ধানে তৎপর হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে চিকিৎসকদের নিজেদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও সুবিধা না থাকায় তাঁরা নিজেরাই বিপদে পড়ে গেছেন বলে সংবাদে প্রচারিত হচ্ছে। তাই চিকিৎসা সেবার নৈতিকতার কথা চেপে রাখতে না পেরে আমাদের চিকিৎসকগণ খোলাখুলি নিজেদের নাজুক অবস্থা দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। এটা মানুষের ভরসাকে নড়বড়ে করে দিয়ে আরা বেশী হতাশায় ফেলে দিয়েছে। আমাদের দুর্বার মানুষগুলো এতে দমবার পাত্র নয়। তারা এমনিতেই জীবনের সব জায়গায় ধাক্কা-ধকল খেতে খেতে অভ্যস্ত। তারা সব সময় বঞ্চিত হয়ে সৃষ্টিকর্তাকেই সাক্ষী রাখতে অভ্যস্ত। সুতরাং করোনার ভয়াবহতাকে সামনে রেখে বিচলিত না হয়ে এক্ষেত্রে আল্লাহ্কেই শেষ ভরসা মনে করে স্বস্তি পাচ্ছেন। তবে মনে রাখার বিষয়-বিপদ যত বড়ই হোক না কেন মহান আল্লাহ্র রহমত বিপদ থেকে অনেক বড়।
অনেক মানুষের যতক্ষণ নিজে করার ক্ষমতা থাকে ততক্ষণ মহান সৃষ্টিকর্তার কথা স্মরণে আসে না। নিরুপায় হয়ে গেলে তখন সৃষ্টিকর্তার কথা স্মরণে আসে। আসলে এবার আমরা নিরুপায় হয়ে গিয়েছি। কারণ মৃত্যু কারো কথায় থেমে থাকে না, এতে কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই চিরন্তন সত্যকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। এই ভয়কে জয় করার জন্য আগাম প্রস্তুতি দরকার। যে প্রস্তুতির দ্বারা মানুষ শান্তিতে মৃত্যুবরণ করার জন্য আগ্রহী থাকে। এর ব্যত্যয়ে হতাশা বেড়ে গিয়ে সব কিছুতে অস্থিরতা তৈরী হয়। এটাই সামাজিক ভয়। এজন্য সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
করোনা ভাইরাস নির্ণয়ের জন্য সামান্য ব্যবস্থা সর্বসাধারণের নাগালের বাইরে রয়েছে। কয়েক লাখ বিদেশফেরত মানুষ মার্চের ০২-২২ তারিখের মধ্যে দেশে ঢুকে নিজ ঠিকানায় না থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তাদেরকে খুঁজে বের করে কোয়ারাইন্টাইনে রাখার প্রচেষ্টা কঠিন কাজ। সম্প্রতি সারা দেশ থেকে তাদের সামান্য কয়েকজনকে খুঁজে বের করে বাড়িতে আলাদা কক্ষে নির্বাসিত জীবন-যাপন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বড্ড দেরী হয়ে গেছে। অদূরদর্শী রাখালের গরুর পালে বাঘ আসার গল্পের মত সত্যি সত্যি বাঘের হামলায় মালিকের হেঁয়ালী ও নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। ইতোমধ্যে বিদেশফেরত মানুষ তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি, বাজার, মাঠ-ঘাট ঘুড়ে চারদিকে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের সংগৃহীত তথ্য থেকে ‘সামনে আরো ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে’-বলে সংবাদ বের হয়েছে। যেটা মানুষের আতঙ্কের মাত্রাকে আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মত মনে হচ্ছে।
এদিকে সময়মত সঠিক তথ্যের অভাব আমাদের জনজীবনকে বেশী ঘাবড়িয়ে দিয়ে নাজেহাল করছে। দুদিন ধরে মৌলভীবাজার ও ভৈরবে দু’জন বৃটেন ও ইটালী ফেরত মৃত ব্যক্তিকে করোনায় আক্রান্ত রোগী বলে জানানো হয়েছিল। এতদিন পরে নমুনা পরীক্ষা করার পর আজ (২৪.০৩.২০২০) দুপুরে জানা গেল তারা আসলে করোনায় সংক্রমিত হননি। এর অর্থ দাঁড়ায়-‘চিলে কান নিয়ে যাবার’ মত অবস্থা হয়েছে নিয়ন্ত্রকদের ব্যবস্থাপনায়। ডাক্তার, গবেষক ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যদি নিজেরাই বেশী অস্থিরতায় ভুগেন তাহলে তাদের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে স্বেচ্ছায় বাড়িতে আলাদা কক্ষে নির্বাসিত জীবন-যাপন করতে চলে যাওয়া উচিত।
দেশে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা হয় একমাত্র আইইডিসিআর বা সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠনে। চরম বাস্তবতা হলো- ষোল কোটি মানুষের এই দেশে দু’হাজার মাত্র কিট্স আছে। বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়া বা চাহিদার সাথে সেবাদান করার সক্ষমতা এই প্রতিষ্ঠানের নেই। আক্রান্ত অসহায় মানুষ সেবা পেতে চাইলে যাবে কার কাছে?
আমাদের দেশে সেবাকাজে নিযুক্ত পেশাদারীগণ নিজ দায়িত্ব পালন না করে কার ভরসা করে কাজ করেন সেটা আজ বড় প্রশ্নের মুখোমুখি করিয়েছে। জনস্বার্থে যে কোন জন্য কল্যাণমূলক পেশাদারী সেবা শরু করার পূর্বে রানৈতিক নেতাদের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করে সময় ক্ষেপন করা মোটেও উচিত নয়। কোথাও করোনা রোগীকে ভয়ে ভর্তি করানো হয়নি, কোথাও ভুল চকিৎসা দেয়া হয়েছে! আবার কোন রাজনৈতিক নেতা আগেভাগেই বলে দিয়েছেন-‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী’! এ সব হাস্যকর বক্তব্য এই দুর্দিনে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। আমরা জানি মানুষ অদ্যাবধি করোনার চেয়ে নিজেকে সবল প্রমাণ করতে পারেনি তাই সারা পৃথিবীতে টালমাটাল অবস্থা তৈরী হয়েছে। ছোট্ট মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আজও মানুষ যেমন অসহায়- করোনার কার্যকর ভ্যাকসিন আবিস্কৃত না হওয়া পর্যন্ত মানুষকে করোনার চেয়ে দুর্বলই ভাবা ভাল।
এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লম্বা ছুটি পেয়ে প্রথমেই মানুষজন বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সমুদ্র সৈকত, পার্ক রিসোর্টে হৈ-হুল্লোর করে সময় কাটাতে গিয়েছিল। সরকারী ছুটি এপ্রিলের চার তারিখ পর্যন্ত দেয়ায় বাড়ি ফেরত যাত্রীরা আজ কমলাপুর রেল স্টেশনে ভীড় করেছে। অথচ তাদের ঢাকায় থেকে যাওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়নি। এসব যাত্রীরা কে কোনভাবে কোথায়, কার সংস্পর্শে এসে-গিয়ে করনাতঙ্ক মানুষের সুনামিকে আক্রান্ত মানুষের কাতারে সামিল করতে পারে তার হিসেব কে নিবে? অথবা আক্রান্ত মানুষের লম্বা সারি যদি কল্পনার চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছুর দিকে মোড় নেয় তার দায়ভার নেয়ার মত কেউ কি প্রস্তুত আছি?
এই বিচলিত হঠকারী যাত্রীদের যাত্রাপথ কোথায় গিয়ে মিশছে? কোয়ায় আরো মিশতে পারে, শেষমেষ থামবে কোথায়, কখন? আমাদের ভরসার জায়গা তাহলে কোথায়? কেউ ভাল জানি না। তবুও আমরা মোটেও হতাশ নই। শধু বিশ্ববাসীদের মনে রাখার বিষয়- বিপদ যত বড়ই হোক না কেন মহান আল্লাহ্র রহমত বিপদ থেকে অনেক বড়।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top