logo
news image

ঢেউ থামবে কবে জানেনা তো কেউ

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
ঢেউ উঠেছিল দক্ষিণ চীন সাগরের কাছে উহানে। চীন থেকে ইটালী, বৃটেন হয়ে গোটা ইউরোপ পাড়ি দিয়ে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল। তারপর শুরু হয়েছে এশিয়ায় সেই ঢেউয়ের আঘাত। ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে ঢেউ আছড়ে পড়েছে দুই শতাধিক দেশে। পৃথিবীর কোন শক্তি এই ঢেউয়ের আঘাত আটকাতে পারেনি। প্রতিশেধক আবিষ্কারের আশার বাণী শুনতে শুনতে ঝরে গিয়েছে সাড়ে আট লক্ষ প্রাণ। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ (সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২০ পর্যন্ত)।
সারা পৃথিবীর মানুষ বিচলিত, বিপর্যস্ত। থমকে গেছে জীবনের সব নিয়মিত কর্মযজ্ঞ। বদলে গেছে স্বাভাবিক নিয়ম-কানুন ও গতি-প্রকৃতি। মানুষের ধৈর্য্যরে বাধ ভেঙ্গে ঘরবন্দী জীবন-যাপন থেকে মুক্তি ঘটানোর চেষ্টা চলছে। সমূহ বিপদ জেনেও জীবনের তাগিদে নিজ নিজ জীবিকা সচল রেখে বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছে মানুষকে ঘরের বাইরে বের করে ফেলেছে। মানুষ একদিকে মৃত্যুভয়ে জর্জরিত, অন্যাদিকে নিয়ন্ত্রণহীন ও বেপরোয়া চলাফেরা সবকিছুকে এলোমেলো করে দিচ্ছে।
এর মধ্যেই চলছে যুদ্ধের মত অশান্তিময় পরিস্থিতি। চলছে বর্ণবাদ নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি। এমনকি কোভিড-১৯ প্রতিরোধের জন্য একটি কার্যকরী টিকা আবিষ্কার নিয়ে চলছে ধোঁয়াশা! রাশিয়া প্রথম ম্যাজিক দেখিয়ে টিকা আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়ার কিছুদিন পর জানা গেল চীন তার একমাস পূর্বে নিজেদের টিকার সফল ট্রায়াল ব্যবহার শুরু করেছে নিরাপত্তা বাহিনী, ডাক্তার ওজরুরী সেবাদানকারী কর্মচারীদের মধ্যে। ইতোমধ্যে অনেক বড় দেশ তাদের জরুরী নিরাপত্তার জন্য তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শেষ হবার পূর্বেই নিজ নিজ উদ্ভাবিত টিকা ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। দরিদ্র দেশগুলোকে অনেকে আহবান করেছে তাদের ট্রায়ালে অংশ নিতে এবং আগাম টিকা পাবার জন্য দ্রুত চুক্তি করতে। করোনাক্রান্ত অনেক দেশ নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ইতোমধ্যে অনেক টিকা আবিষ্কারক প্রভাবশালী একাধিক দেশের সাথে টিকাচুক্তি সই করেছে। বাংলাদেশ কোন দেশের টিকা নেবে তার জন্যে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে শেষ পর্যন্ত একাধিক দেশের সাথে চুক্তি করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
যদিও নিম্ন আয়ের দেশ হওয়ায় আমাদের জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বিনামূল্যে টিকা পাবার আশ্বাস রয়েছে, তথাপি কবে যে তারা সেটা দিতে পারবে সেই আশায় কালক্ষেপণ না করে আমরা নিজ উদ্যেগে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যারা আগে সরবরাহ করতে পারবেন তাদের টিকা আমরা আগে সংগ্রহ করব বলে ধারণা করা হচ্ছে।
করোনার প্রভাবে জীবন-জীবিকার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বিশ্বব্যাপী স্বাভাবিক জীবনের সবকিছুই ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে রূপায়নের চেষ্টা চলছে। এই ভার্চুয়াল প্রচেষ্টায় আমারও পিছিয়ে নেই। কিন্তু এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে আমরা হোঁচট খাচ্ছি প্রতি পদে পদে। বিশেষ করে আমাদের নাগরিকদের অসম সামাজিক স্টাটাস ও বৈষম্যমূলক আয় বিন্যাস ও ভৌগলিক অবস্থানের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে ভার্চুয়াল পদ্ধতির প্রচলণ দায়সারা গোছের প্রতীয়মান হয়ে পড়েছে। ছয়মাস গত হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যায়নি। সেজন্য নিরুপায় হয়ে প্রাথমিক, জুনিয়র সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা অনেকবার পিছিয়ে নেয়া হলেও অদ্যাবধি গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভার্চুয়াল ক্লাশ ও পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা হলেও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সেগুলোর যথার্থতা নেই। সরকারী কলেজগুলোতেও একই অবস্থা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভার্চুয়াল ক্লাশ নেয়ার প্রক্রিয়া চললেও পরীক্ষা নেয়ার কোন ব্যবস্থা এখনও নেয়া যায়নি। এক মাঠ জরিপে দেখা গেছে নানা সমস্যায় ৩০-৪০ ভাগ শিক্ষার্থী এই সুযোগের আওতায় আসতে পারছে না।  একটা শক্ত অবকাঠামো ব্যতিরেকে হঠাৎ করে অনলাইন শিক্ষা গোঁজামিল করে সেশন পার করার নামান্তর মনে হচ্ছে।
এদিকে সারা পৃথিবীর সবকিছু ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়ে গেলে উন্নত দেশগুলো আরো উন্নত হতে থাকবে, তাদের আধুনিক প্রযুক্তিগত অবকাঠামো পূর্ব থেকে তৈরী থাকার জন্য। তারা আরো নতুন স্যাটেলইট পাঠাবে, সাবমেরিণ কেবল শক্তিশালী করবে, ভার্চুয়াল শক্তির ক্যাপাসিটি বাড়াবে। সাথে জনসেবার জন্য এর ব্যবহারিক মূল্য কমিয়ে দেবে। দরিদ্র দেশগুলোর এজন্য তেমন প্রস্তুতি না থাকায় তারা বরাবরের মতই পিছিয়ে যাবে এবং দরিদ্র দেশগুলোর গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত নদী-সমুদ্রচর এলাকাগুলোর জনগোষ্ঠী এই সুবিধার আওতার বাইরে থাকায় আরো বেশী বঞ্চিত হয়ে পিছিয়ে পড়বে। অধিকিন্তু অনলাইন প্রযুক্তি ব্যবহারের বাজারমূল্য বেশী হওয়ায় তারা কিনতে পারবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- করোনার প্রভাবে ধনীরা আরো বেশী ধনী হবে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী আরো বেশী বঞ্চিত হয়ে ঘাসে মিশে যাবে।
করোনার আগ্রাসী প্রভাবে যেমন নব্য বেকারত্ব সৃষ্টি হয়েছে তেমনি পেশার আমূল পরিবর্তন আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত পরিবর্তন সূচিত করে চলেছে। ফুটপাতে কাপড় ও ফল বিক্রেতা এখন হরেক রঙ্গের নকল জীবন সুরক্ষা সামগ্রীর পস্রা সাজিয়ে দিন কাটাচ্ছে। ভারতে ক্রিকেটার হয়েছেন ট্যাক্সিচালক, আমাদের দেশে সিনেমার নায়ক হয়েছেন মুদি দোকানদার। ভিক্ষুকদের বেড়েছে জীবন-যন্ত্রণা। আগে হাতে থালা নিয়ে দশবাড়ি ঘুরলেই তাদের পেট ভরতো। কারণ, এখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে তারা দরজা পর্যন্ত যেতে পারে না। সরকারী সাহায্য তাদের অনেকের নাগালে পৌঁছায় না। বিশেষ করে পঙ্গু ও অক্ষম ভিক্ষুকদের মরণদশা চলছে। তাদের কেউ খোঁজ-খবর নিতে পারে না।
মুখে মাস্ক না পরার জন্য জরিমানা করা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। বিশেষ করে বাসের মধ্যে। কিন্তু অনেকের নতুন মাস্ক কেনার টাকা নেই। মাস্ক একদিন মুখে দিলেই সেটা ঘেমে গন্ধ হয়ে যায়। পুন: ব্যবহার করা যায় না। তাই জরিমানা না করে দরিদ্রদের জন্য প্রতিটি বাসে, অফিসে, বাজারে, শপিংমলের দরজায় বিনা পয়সায় একটি বিশেষ রংঙের জন:ব্যবহারযোগ্য মাস্ক প্রদানের ব্যবস্থা রাখা উচিত। এই মাস্ক পরলে যেন বোঝা যায় যে তিনি বিনা পয়সার মাস্ক পরিধান করেছেন। তাহলে কেউ একদিন ভুল করে মাস্ক না পরে বাইরে বের হেেলও ধরে নেয়া যায় তিনি লজ্জায় পরবর্তীতে নিজের কেনা মাস্ক পরে বের হবেন। সরকার তো বটেই, বিত্তবান দানশীল ব্যক্তি ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এই মুহূর্তে দেশের প্রয়োজনীয় জায়গায় বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ শুরু করা।
কারণ, সংক্রমণ ও মৃত্যুর এই ঢেউ কবে থামবে তা কেউ জানেনা। যেসব দেশ ভেবেছিল, তাদের দেশ থেকে করোনা বিদূরিত, তারা ২য় ও ৩য় পর্যায়ের ঢেউয়ের আঘাতে পুনরায় সংক্রমিত হয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। সংক্রমণ শুরু হওয়ায় উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনামের ভুল ভেঙ্গে গেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় পুনরায় স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভারতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু। সেখানে টেষ্টসংখ্যা বেশী হওয়ায় প্রকৃত পরিস্থিতি জনগণ জানতে পারছে। প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় আমরা দিন কাটাচ্ছি আতঙ্কে, আশঙ্কায়। আমাদের দেশের মানুষ মানে না মানা। তারা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করে না, গরম লাগার অজুহাতে মুখে মাস্ক পরতে চায় না। জরিমানা করতে গেলে বলে ওহ্, মাস্কটা পকেটে আছে। বেপরোয়া বাংলাদেশীরা সারা জীবন বন্যা-সাইক্লোনে নদী-সমুদ্রের ঢেউ সামলিয়ে দিন গুজরান করতে অভ্যস্ত হলেও করোনার ২য় ও ৩য় পর্যায়ের ঢেউয়ের আঘাতের সংগে আত্মীকরণ করে টিকে থাকতে পারবে তো?

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top