logo
news image

মরণজয়ী টিকা ও ইবলিসের মায়াকান্না

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
মানুষের মরণভয় জয় করতে শুরু হয়েছে বহুল প্রত্যাশিত টিকাদানের কাজ। কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা দিতে ইউরোপ আমেরিকায় সিনিয়র সিটিজেন ও ফ্রন্টলাইনে কর্মরত সেবাদানকারীগণের মাঝে টিকাদান কর্মসূচি চলছে। আমরাও হয়তো অচিরেই নেমে পড়বো এই কাজে। আমরা সবাই চাই মানব শরীরে এখনও এই টিকার শতভাগ কার্যকারীতা ইতিবাচক প্রমাণিত হোক। কারণ, টিকাপ্রদান শুরুকারী প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা প্রদান শুরুর একদিন পরে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বিবিসি বলেছে - মারাত্মক এলার্জিজনিত সমস্যা রয়েছে এমন মানুষের এই টিকা নেয়া উচিত নয়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের দুই জন কর্মী ভ্যাকসিন গ্রহণের একদিন পর তাদের শরীরে অ্যালার্জিজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার পর এই সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
পত্রিকায় আরো জানা গেছে, ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট ও ভারত বায়োটেকের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন জরুরিভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন পায়নি। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের প্রধান বলরাম ভার্গভ জানিয়েছেন, “ভ্যাকসিনের উপকার এবং ঝুঁকির অনুপাতে সন্তুষ্ট হলে তবেই কোনও সংস্থাকে প্রতিষেধক বাজারে ছাড়ার ছাড়পত্র দেওয়া হয়।”
তবে শেষ পর্যন্ত সব কোম্পানীর ক্ষেত্রে সেটা হোক বা না হোক জীবন রক্ষাকারী টিকার প্রতি মানুষের বিশ^াস ও আস্থা রয়েছে বহু শতাব্দী আগে থেকে। করোনার কঠিন কামড়ে পর্যুদস্ত মানুষ এই দিনটির জন্য ধৈর্য্যধরে অপেক্ষার প্রহর গুণে চলেছে।
একটি কার্যকরী টিকাদান শুরু হবার খবরে সাধারণ মানুষ যেমন খুশী তেমন খুশী হ্যাকাররা। তারা টিকার সরবরাহ চেইনে হামলে পড়ছে বলে খবরে জানা যাচ্ছে। তারা ভাবছে এটা অবৈধ আয়ের স্বর্নালী সুযোগ। তারা টিকার উৎপাদন, সংরক্ষণাগার, শিপমেন্ট, সরবরাহপথ, বন্টন সবজায়গায় ফাঁদ পেতে বসেছে!
মধ্যপ্রাচ্যেসহ গরমের দেশগুলোতে মাইনাস ৭০ ড্রিগী তাপমাত্রায় ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা সংরক্ষণ করা নিয়ে দুশ্চিন্তার মাঝে সেসব দেশে টিকা সরবরাহ দিয়ে দেখা দিয়েছে চরম সংকট। বৃটেনের পর বাহরাইন ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার অর্ডার পেতে আগ্রহী। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তায় কোল্ডস্টোরেজ কোম্পানীগুলোর কোন বিনিয়োগ নেই। তাই থার্ডপার্টির আক্রমণ সম্ভাবনা নিয়ে শঙ্কিত তারা।
সারা পৃথিবীতে করোনার প্রকোপ এখনও বেশ ভয়ংকর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত ডিসেম্বর ০৯, ২০২০ চব্বিশ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩ হাজার ৭১ জন। গত এপ্রিলের পর একদিনে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। গত মাসে ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ উপলক্ষে কর্তৃপক্ষের ঘরে থাকার সতর্কতা উপেক্ষা করে লাখ লাখ লোক ভ্রমণে বের হয়েছিল। তখন থেকেই সংক্রমণ ও মৃত্যু সংখ্যা বাড়ার আশংকা ছিল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় দেড়কোটি লোক আক্রান্ত হয়েছে বলে সংবাদে এসেছে।
আমাদের দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার আজ কমছে কাল বেড়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা হলে প্রভাতের সাথে মোলাকাত হবেই। কিন্তু আবার প্রভাত হলে আবারো সন্ধ্যা নামতে পারে-এটাই স্বাভাবিক, এটাই সত্য। না হলে কেয়ামত নেমে যেতে পারে। তাই এটা ভুলে যাওয়াটা বোকামি। কেউ কেউ বলেছেন- কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের যুগে মানুষের জন্য বড় খুশীর বিষয় হলো যন্ত্রই সবকিছু করে দিতে পারবে।
কিন্তু করোনার প্রকোপ কমাতে এ পর্যন্ত কী করেতে পেরেছে বা করেছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা? মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর উপর খবরদারী করার মত তাকে নিয়ে মানুষের দম্ভ এখনও শুধু অহমিকার মত মনে হচ্ছে। টিকার ফর্মূলা তৈরীর গবেষণা করার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত গতিতে কাজে লাগানোর মত কোন সুফল দিতে পেরেছে বলে আজ পর্যন্ত কোন কিছু শোনা যায়নি। যন্ত্রের চেষ্টাও বৃথা হয়েছে বলে জানা গেছে। মানুষের মগজই আসল। বাকীটা মেকি!
একটি গাছের অনেক শেকড় থাকে। কিন্তু মূল শেকড়টাই আসল ভার বহন করে। এর অর্থ হলো- প্রকৃত মূলটাই মূল। মূল ছাড়া শাখা-প্রশাখারা ঠিকানাবিহীন। মানুষ নিজেদের স্বার্থে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরও অহেতুক নানা শাখা-প্রশাখা তৈরী করে ফেলে। এভাবে ভুল পথে চলে যায়। ভুল যুক্তি দেয়। অন্ধকারের দিকে ধাবিত করে বিভ্রান্ত  করে তোলে। ইবলিশ বা প্রধান শয়তান মানুষকে ভুল যুক্তি দেয়ার নির্দেশনা দান করে। এজন্য সে ছলনার আশ্রয় নেয় এবং কৌশলে মায়াকান্না করতে ভুল করে না। ইবলিশের কৌশল অনেক ক্ষেত্রে কাজে লাগে। কারণ, তার নীতি অনুসরণ করার শিষ্য অগণিত।
হযরত আদম (আ:)-কে বেহেশ্ত থেকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়ার ঘটনাটি ছিল মানুষের উপর মহান আল্ল্হ্ ারাব্বুল আলামীনের দেয়া প্রথম প্রথম শাস্তি। ইবলিসের তৎপরতায় মানুষ প্রথম মহান আল্ল্হার নির্দেশ অমান্য করে গন্ধম ফল ভক্ষণ করে বেহেশ্ত থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। আজও সে মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয়। সে সেটা দিতে পারে কারণ সেটা দেয়ার ক্ষমতা তথা মানুষের চিন্তা চেতনায় দ্রুত গতিতে চলাচল করার ক্ষমতা সে মহান আল্ল্হার নিকট থেকে আদায় করে নিয়েছিল। এজন্য ইবলিসের অনুসারীরাও বেশ শক্তিধর। তারা অন্যায়কে ন্যায় বলে চালিয়ে দেবার ক্ষেত্রে প্রচন্ড ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দ্বিধা করে না।
এভাবে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব থেকে যুগে যুগে সভ্যতার সংকট শুরু হবার ইতিহাস রয়েছে এবং সেইসব সংকট নিরসনে মহামানবগণের পৃথিবীতে আগমনের উদাহরণ রয়েছে। এমনই এক সংকট থেকে মুক্তিদানের উদ্দেশ্যে আরবের অন্ধকার সমাজে আলোর দূত হিসেবে এসেছিলেন মানবতার মুক্তিদূত হযরত মুহা¤মদ (সা:)। যার ওপর নাজিলকৃত মহাগ্রন্থ আল কোরআন থেকে শিক্ষা নিয়ে পৃথিবীতে নিত্যনতুন গবেষণা চালাচ্ছে মানুষ। যারা অন্যায়ের প্রণোদনা দেয়, হক্ককে কেড়ে নেয় এবং মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে তাদের জন্য পরবর্তী জীবনের কথা নাই বললাম, এই পৃথিবীতেই শাস্তি পাবার ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। তাদের নাম চিরদিন ঘৃণাভরে উচ্চারিত হতে থাকবে। কারণ, তাদের অপরিনামদর্শী, অন্যায় কাজের রেশ ধরে সূচিত হয় বিশৃংখলা, মারামারি, যুদ্ধ ও চরম অশান্তি। এবং এ থেকে শুরু হয় দুর্নীতি, মহামারী, অভাব ও দুর্ভিক্ষ। সবাই জানেন এগুলো ইতিহাসের শিক্ষা। এভাবে বহু দাম্ভিকতার অন্যায় কাজের ফসল স্বরূপ চাকচিক্যময় সভ্যতার আভরণ মিইয়ে গেছে ক্ষণিকেই। মহাকালের স্বাক্ষী হিসেবে বইগুলো সেসব ঘটনার বিবরণ জানান দিচ্ছে। কিছু জ্ঞানী মানুষ সেসব বই-পুস্তক অধ্যয়ন করে সে সর্ম্পকে সম্যক জ্ঞান আহরণ করলেও ইবলিশের প্ররোচনায় সত্যকে অস্বীকার করে কালাতিপাত করে কালের গর্ভে হারিয়ে যান এবং তাদের নিন্দিত কৃতকর্মের ফলে ঘৃণিত হতে থাকেন।
করোনার সময়ে টিকার ইতিবাচক খবরে ইবলিশের বংশধররা মায়াকান্না করে একদিকে মোহনীয় বক্তব্য দিচ্ছে অন্যদিকে খুশি হয়ে সেখান থেকে অবৈধ আয়ের যে স্বর্নালী সুযোগ তৈরী করার জন্য মরিয়া হয়ে হ্যাকিংয়ে নেমে পড়েছে তা মানবতার জন্য নতুন বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে ভেজাল টিকার ব্যবসা পৃথিবী থেকে মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নামান্তর।
তাদের অনুসারীরা যে কোন উপায়ে অর্থ-সম্পদ আয় করেন, ক্ষমতা দখল করেন। চুরি, –ডাকাতি, দুর্নীতি করে ইবলিশের মোহনীয় আহব্বানে সত্যকে অস্বীকার করতে কুন্ঠিত হন না। এমনকি মানবতার মহা বিপর্যয়ের সময়েও তাদের চেতনা জাগে না। বিষয়টি এমন- চুরি করা অর্থ দিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরী করে দেয়ার মত শঠতা সৃষ্টি করে দেয় তার মধ্যে ইবলিশ শয়তান।
হযরত ওমরকে ফজরের নামাজের সময় হয়ে ইবলিশ শয়তান এসে মায়াকান্না করে পা টিপাটিপি করে জাগিয়ে দিত- আর বলতো দ্রুত নামাজ আদায় করতে। কারণ সে জানতো, যদি হযরত ওমর একদিন ফজরের নামাজ ক্কাজা করেন তাহলে তিনি সেজন্য আল্লাহ্র নিকট অনুতপ্ত হয়ে যে পরিমাণ কান্নাকাটি ও রোনাজারি করবেন তাতে মহান আল্লাহ্ ইবলিশের জন্য কঠিন ব্যবস্থা নিয়ে তার ক্ষমতা সীমিত করে দিতে পারেন। সেজন্য সে আগেই সতর্ক হয়ে হযরত ওমরের পা টিপে নামাজের জন্য জাগিয়ে দিত। এ ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে- ইবলিস শয়তানও নিজের বড় বিপদের কথা আঁচ করতে পেরে কখনও কখনও অতি সতর্ক হয়ে মানুষকে সৎকাজে তাগাদা দেয়। সেটা শয়তানের নেতিবাচক উদ্দেশ্য।
অথচ আমরা নিজের ভালমন্দ নিজেরা উপলব্ধি করতে না পেরে শয়তানের মায়াকান্নায় ভুলে এবং ক্রমাগত ধোঁকায় নিজেকে শামিল করে অন্যায়কে ন্যায় বলে চালাতে ব্যস্ত হয়ে যাই। স্বকীয়তা ভুলে গিয়ে সীমা লঙ্ঘণকারী ইবলিসদের  ধ্বজাকে অনুসরণ করে পঙ্কিলতায় মিশে যেতে উদ্যত হই। ফলত: আত্মার পঙ্কিলতা দূরীভূত হয়না, দেহ মনে পবিত্রতার ভাব জাগে না। মসজিদের শহরে এত আজানের শব্দ শুনেও ইবলিসের কানের পর্দায় আঘাত লাগে না। মন্দির, গীর্জা, সিনাগগ, প্যগোডা থেকে ফিরেও মনের কালিমা দূর হয় না। তাইতো ইবলিসের মিথ্যে প্ররোচনায় কোভিড-১৯ এর মত জীবন সংহারী অতিমহামারীর দু:সময়ে বৈশি^ক ইবলিসরা ধোঁকাবাজির মাধ্যমে অবৈধ আয়ের স্বর্নালী সুযোগ খুঁজে বেড়ায়। আমরাও পরস্পরের দু:খকষ্টে সহায়তা না করে ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছি, মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছি। টিকা প্রাপ্তি, সংরক্ষণ, সরবরাহ, বন্টন, প্রদানের কাজে মনোযোগের সাথে সহায়তা না করে হঠকারী আচরণ করে নিজেদের বিপর্যয় ত্বরান্বিত করে চলেছি। এজন্য এই দু:সময়ে দেশের যে সার্বিক ক্ষতি হচ্ছে সেটা আমাদের জাতীয় ক্ষতি। এ ক্ষয়ক্ষতি রোধে বোধোদয় হোক সবার, সম্বিৎ ফিরুক অচিরেই।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top