সংক্রমণের উচ্চগতি দেখে চমকে যাচ্ছে নদীপাড়ের মানুষ
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
অজ পাড়াগাঁয়ে করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভাইরাসের সংক্রমণের হঠাৎ উচ্চগতি দেখে চমকে যাচ্ছে আমাদের নদীপাড়ের মানুষ। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কারণ খুঁজে পাচ্ছে না তারা। কিন্তু কারণ খুঁজতে খুঁজতে নিয়ন্ত্রণহীন সংক্রমণের শিকার হয়ে পড়লে মানুষ কি প্রতিবেশী দেশের গ্রামে আক্রান্ত মানুষের মত দিশেহারা হয়ে যাবে? সেটা এখন শুধু প্রশ্নই নয় বরং ভয়াবহ চিন্তা।
কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয় ইত্যাদি রোগ পানিতে ছড়ায় কিন্তু করোনা পানিবাহিত রোগ নয় বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মতামত রয়েছে। আগেকার দিনে এক গ্রামে কলেরা দেখা দিলে রোগীর কাপড়-চোপড় পুকুর বা নদীতে ধোয়ার ফলে সারা গ্রামে কলেরা ছড়িয়ে যেত। উজানের নদীতে কলেরার জীবাণু ছড়ালে তা কয়েকদিনের মধ্যে ভাটির দিকে সংক্রমিত হ’ত। এভাবে কোন নদীর তীরবর্তী শত শত মাইল দূরের ভাটির শহর-বন্দরে-গ্রামে কলেরা সংক্রমিত হয়ে বহু জনপদ বিলীন হয়ে যাবার নজির রয়েছে। করোনা যেহেতেু পানির মাধ্যমে ছড়ায় না সেহেতু পানি ব্যবহারে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে জনমনে।
করোনা শুরুর প্রথম দিকে পানিতে এর সংক্রমণ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে অনেক গবেষণা হয়েছিল। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে ‘নেচার’পত্রিকার বরাত দিয়ে মোহনা নিউজ প্রকাশ করেছিল, ‘পানিতে ছড়াতে পারে প্রাণঘাতি করোনা।’ গোটা বিশ্বের মানুষ ভয় পেয়েছিল এই সংবাদে। কারণ, পানিতে করোনা ছড়ালে মানুষের অস্তিত্ব বিলীণ হতে বেশী দেরী লাগবে না।
পানির মাধ্যমে না ছড়ালেও ২৩-২৫ ডিগ্রী পানির তাপমাত্রায় করোনা ভাইরাস ১০ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। ই-লাইকের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা পজিটিভ ব্যক্তির এক গ্রাম মলে রয়েছে ১০০ মিলিয়ন আরএনএ। এগুলো ড্রেনের পানিতে মিশে গেলে কি ক্ষতি হতে পারে সেটা নিয়েও গবেষণা হয়েছে। মানুষ বা প্রাণি সেই দূষিত পানি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যবহার করলে সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সংক্রমিত ব্যক্তির টয়লেটের ফ্লাশ থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনা ভাইরাস। টয়লেট ব্যবহারের পর মলদ্বারে থেকে কাপড়ে রেগে যাওয়া ভাইরাস সোফায় বা বসার স্থানে সংক্রমিত হতে পারে বলে জানানো হয়েছিল। তখন নদ-নদীতে করোনা বর্জ্য না ফেলার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু ২০২১ সালে ভারতের বিহারে ভয়ংকর করোনা সংক্রমণে মৃতদের যথাযথ সৎকারের অভাবে মৃতদেহকে নদীতে ভাসিয়ে দিতে দেখা গেছে। রাতের বেলা ব্রীজের ওপর থেকে মৃতদেহকে নদীতে ছুঁড়েফেলার ভিডিও দেখা গেছে। বিহারের গ্রামগুলো থেকে একসংগে ৪০টি মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। কেউ বলেছেন শত শত মৃতদেহ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। শ্মশানে জায়গা না থাকায় নদী তীরের বালুতে কম গভীরতায় লাশ পুঁতে রাখায় সেগুলো শিয়াল-কুকুর, চিল-কাক প্রভৃতি টেনে বের করে বাতাসে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। মূল বাহক এর সংস্পর্শে আসা আত্মীয়-স্বজন ও অন্যান্য মানুষ। সেখান থেকে নৌযাত্রী, জেলে, মাঝি, পুণ্যার্থী, ভ্রমণকারী, দর্শক ইত্যাদির মাধ্যমে শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে গেছে ভাইরাস।
আমাদের উজানে ভারতের গঙ্গা নদীতে যখন মৃতদেহ ভাসছে তখন রাস্তায় যেমন ট্রাক চলছে, নদীতে নৌযান চলাচল করছে। ট্রাকের ড্রাইভাররা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে স্থল বন্দরগুলোতে পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে ঢুকে হোটেল, রেঁেস্তারায় থাকছে-খাচ্ছে। নৌবন্দ্রগুলোতে কড়াকড়ি না থাকায় আরো বেশী করে ঢোকার সুযোগ পেয়েছে তারা।
চোরাচালানীর কথা তো মাথায়ই নেই। স্থলে কড়াকড়ি থাকায় নদীপথে বেশী চোরাচালানী হয় রাতের বেলা। গরু, কাপড়, মশলা, প্রসাধনী সবই আসে রাতের নৌকায়, চোরাপথে। তা না হলে হাটে বাজারে এত পরিমাণ আমদানী নিষিদ্ধ দ্রব্য চোখে পড়ে কীভাবে? চোরাচালানীদের বিরাট অংশ করোন সংক্রমিত কি-না তার তো কোন পরিসংখ্যান নেই। কারণ, তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করে। নির্ভত পল্লীতে ফেরীওয়ালারা চোরাচালানের নিষিদ্ধ পণ্য ফেরী করে বিক্রি করে বেড়ায় কোনরকম কোয়ারেন্টাইন ছাড়াই। এদের চৌর্যবৃত্তির জন্য আমরা আমাদের দেশের অভ্যন্তরে করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ঠেকাবো কী করে?
জুন মাসের শুরু থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পশিচমাঞ্চলের গোটা সীমান্ত জুড়ে করোনার আতঙ্ক বিরাজ করছে। উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও থেকে দক্ষিণের সুন্দরবনের নিকটে দাকোপ উপজেলায় ভয়াবহ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় চাঁপাই নবাবগঞ্জে গত দুসপ্তাহ ধরে লকডাউন চলছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মহানন্দা নদীতে ভারত থেকে ভেসে এসেছে গলিত লাশ। জুনের আট তারিখে সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপের খাটাইল গ্রামে ২৫ শে মে থেকে জুনের আট তারিখ পর্যন্ত ৩৩ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, দাকোপ উপজেলার চুনকুড়ি নদী দিয়ে ভারতে যাতায়তকারী দেশী-বিদেশী কার্গো, লাইটার জাহাজ, ট্রলার চালনা এলাকায় নোঙ্গর করলে ডাঙ্গায় উঠে আসা নাবিক ও লোকজন বাজার করে, হোটেল-রেস্তোঁরায় খায় ঘোরাফেরা করে। এদের দ্বারা ভয়ংকর ভারতীয় ডেল্টা ধরন ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা করছে এলাকার মানুষ।
নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও পশুর নদী, চুনকুড়ি নদী থেকে চুরি করে তারা নামছে স্থানীয় টাউটদের সহযেগিতায়। একজন বলেছে, তাকে চার লিটার তেল দেয়ার বিনিময়ে নামতে চেয়েছিল সে নেয়নি কিন্তু আরেকজন নিকট আট লিটার তেল নিয়ে নামিয়েছে। এছাড়া মোংলা পোর্ট এলাকায় হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। জাহাজ, কার্গোর বিদেশীরা ঘুষ দিয়ে, তেল দিয়ে ডাঙ্গায় নেমে আসছে ও স্থানীয়দের সাথে মিশে চলাফেরা করছে। ভারতে বর্তমানে ডেল্টার চেয়েও মারাত্মক ধরনের ভাইরাসের সন্ধান পোওয়া গেছে যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আরো ভয়াবহ সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নোয়াখালী এবং কুড়িগ্রামের স্থলবন্দর ও নদী এলাকার গ্রামগুলোতে সংক্রমণের কথা জানা গেছে।
সতেরটি জেলার সীমান্ত গ্রাম ছাড়িয়ে করোনার সংক্রমণ জেলাশহর এবং রাজধানী ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সীমান্ত জেলা থেকে ঢাকামুখী বাস, ট্রেন, কার, ট্রাক, সবকিছু রাতদিন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলাচল করছে। অচিরেই রাজধানী ঢাকায় আবারো সংক্রমণের উচ্চহার শুরু হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ভারতে জুন ১০ তারিখে গত ২৪ ঘন্টায় ৬,১৪৮ জনের প্রাণহানির মাধ্যমে এপর্যন্ত করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। দিল্লীর ১০০ কি.মি দূরে কৌটিলা গ্রামের নদীর তীরের বালুতে পুঁতে রাখা হয়েছে সারি সারি লাশ। ভারতের মত নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি আমরা চাই না। আমাদের সীমান্তের জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, হাইফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ কিছুই নেই। সে সকল স্থানে জরুরী লকডাউন দিয়ে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া বিকল্প আর কি আছে?
করোনাকে আমন্ত্রণ না জানালে কারো বাড়িতে আসে না, সে নিজে নিজে কারো ঘরে সহজে ঢুকে না। তাই অতি দ্রুত সতেরটি সীমান্ত জেলায় রেড এলার্ট দিয়ে লকডাউন জারী করে বর্ডারের সকল কার্যক্রম পুনরায় স্থগিত করে দিতে হবে। আমাদের অবহেলা, তাচ্ছিল্য ও অসতর্কতার খেসারত আর কত দিতে হবে? নদীর পানিতে সরাসরি সংক্রমণ না ছড়ালেও নদীতে চলাচলকারী বেপরোয়া মানুষগুলোর চরম উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে আর কত প্রাণ কেড়ে নেবে করোনা নামক অদৃশ্য অণুজীব? কোন গ্রামের মানুষ উজাড় হয়ে গেলে কি আমরা আরো বেশী চমকিত হবার সময় বা সুযোগ পাব?
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য