logo
news image

প্রবাসী কোভিড সাহেব বিয়ে করতে এসে বসতি গাড়লেন

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
বিয়ে নিয়ে কোন কৌতুক করছি না। এ নিয়ে কাউকে টিট্কারী দেয়ারও অভ্যেস নেই আমার। শুধু ওদের উল্লাস ও উন্নাসিকতা এবং কর্তৃপক্ষের দায়সারা দায়িত্ব পালনের উদাসীনতা দেখে এ মুহুর্তে আক্ষেপ করা ছাড়া কিছুই করার নেই। কারণ মাখামাখি হয়ে যাওয়া অদৃশ্য করোনার উর্ধ্বগতি প্রতিরোধে করার এখন আর কোন কার্যকর উপায় আছে বলে মনে হচ্ছে না। কেউ মানছে না স্বাস্থ্যবিধি নামক ওজনহীন কথা। তাই প্রতিকারে কঠোর হওয়াটাই এখন সম্বল।
করোনায় নাস্তানাবুদ হয়ে যাওয়া বৃটেনে বহুদিন পর গত ২৮ মার্চ ‘জিরো ডেথ’ বা একজনেরও মৃত্যু ঘটেনি। তাই বলে তারা স্বস্থির ঢেঁকুর তোলেননি। টিকা প্রদানে একশতভাগ লক্ষ্যমাত্রা কার্যকর করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রেও কিছুট কমেছে ভয়াবহতা। সেসব দেশে থেকে আমাদের প্রবাসীরা ছুটি নিয়ে দেশে এসে ভীড় করা শুরু করেছেন জানুয়ারীর শুরু থেকে। তখন আমাদের দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুসংখ্যা কম হবার সংবাদ প্রচারিত হচ্ছিল।
এদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী শুধু নয়- শীত কমতে শুরু করলে মার্চ মাসের শুকনো দিনে গ্রামে-গঞ্জেও লেগে যায় বিয়ে, খাৎনা, মেলা, ওয়াজ মাহফিল, ভ্রমণ সহ সব ধরণের সামাজিক অনুষ্ঠানের হিড়িক। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বিয়ে ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানের ধুমধাম শুরু হয়ে যায়। চালু হয় পূর্বের মত গান-বাজনা, নাচানাচি শুরু করে দেয় এতদিন ঘরবন্দী থাকা বিরক্ত মানুষ। কক্সবাজার ও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে উপচে পরা ভীড়। সে কি আনন্দ, কি আহ্বল্লাদ! তাদের কারো কিছুই হয়নি যেন। দেশের সবকিছু খোলা ছিল। শুধু অপরিহার্য বিষয় -জ্ঞানশিক্ষালাভের প্রতিষ্ঠানগুলোর দরজা বন্ধ ছিল।
সতের কোটি মানুষের মাত্র কয়েক লক্ষ মানুষ প্রথম ডোজ টিকা নিয়েই মাস্ক পরা ছেড়ে দেন। মনে ধারণা ছিল কলেরা-বসন্তের টিকার মত স্থায়ী স্বাস্থ্যনিরাপত্তা গ্রহণ করা হয়ে গেছে। এই ধরণের আত্মপ্রসাদ স্বাস্থ্যবিধিকে শিকেয় তোলে। দেশে করোনকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে বলে মিডিয়ায় দিনরাত স্তুতিবাক্য প্রচার করা শুরু করে দেয় কিছু চাটুকার মানুষ। তাদের কত ফিরিস্তি, কত ঢংয়ের কথা। শহরের মানুষেরা যখন টিকা নিয়ে স্বস্থির ঢেঁকুর তুলছেন-গ্রামের মানুষ তখনো জানেন না করোনার কথা এখনো বুঝতে চান না। মনে করেন ওগুলো শহুরে বিত্তশালীদের অসুখ। তাদের নয়!
হঠাৎ বিয়ে ও সব ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান ধুমধামের সাথে শুরু হওয়ায় কেনাকাটা বেড়ে গেছে। বাজারে ভোগ্যপণ্যে দাম আকাশচুম্বি। দেশী মুরগীর দাম কেজিপ্রতি পাঁচশত টাকা, গরুর মাংস ছয়শত টাকা এবং খাসীর মাংস ০২ এপ্রিল থেকে নয়শত টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে! করোনার সময় মানুষকে বেশী করে আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণের কথা বলা হলেও সেটা বিত্তহীনদের কাছে উপহাসের বার্তা বই কিছু নয়।
চারদিকে বিয়ের এত ধুমধামের মধ্যে শোনা গেল- সিলেটের একটি নামকরা হোটেলে প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইনে থাকাকালীণ থেকে চুরি করে বের হয়ে কিছু প্রবাসী জকিগঞ্জে গিয়ে বিয়ে করেছে। তারা বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে পুনরায় হেটেলে ফিরলে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হয়েছে। নিয়ম ভঙ্গ করায় জরিমানাও করা হয়েছে তাদেরকে।
একদিকে করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশংসায় পঞ্চমুখ যারা তারাও চরম অবহেলা করেছেন দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে। তা না হলে আধুনিক পাহাড়ার মধ্যে কোয়ারেন্টাইন ভেঙ্গে প্রবাসীরা হোটেল থেকে চুরি করে বাইরে বিয়ে করতে যান কীভাবে? তাহলে এদেশে আইন ভঙ্গ কার কি অতি সহজ?
এছাড়া মিডিয়ায় মজাদার কথা বলা হলেও স্বাস্থ্য বিধি যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের ডিজি, ডেপুটি সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করে দেশের সর্বচ্চো পর্যাায় থেকে সংসদে দাঁড়িয়ে করোনা মোকাবেলার জন্য গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা, নাকে সরিষার তেল ব্যবহার করার আহবান জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে বিশেষ অনুরোধ করা হলেও সাধারণ মানুষের নিকট সে আহব্বান পৌঁছানোর জন্য সরকারীভাবে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি-না এখনো জানা যায় নি। বিষয়টি টোটকা দাওয়াই হলেও আপাতত: মন্দের ভাল বলে বিবেচিত। কিন্তু বেপরোয়া মানুষ অবহেলা করে সেদিকে কর্ণপাত করছেন না।
কিছুদিন আগে রাজনীতির ডামাডোলে রাজপথ গরম হয়েছিল। বহু মানুষ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধীতা করে মাঠে নেমেছিলেন- গুজরাটে মুসলিম হত্যা ও বাবরী মসজিদের জায়গায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা, তিস্তানদীর পানির ন্যয্য হিস্যা নিয়ে টালবাহানা করাসহ নানা অমীমাংসিত ইস্যুকে উল্লেখ করে। এজন্য তাঁরা এখনও মাঠে আছেন। সংবাদে উদ্বৃতি দিয়ে বলা হচ্ছিল- যারা সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে রাস্তায় নেমেছে তারা জামাত-বিএনপির দোসর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী একটি বৃহৎ ধর্মীয় দলেরও নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতাসহ নানা অভিযোগ বিশ্ববাসী জানেন। তাহলে তিনিও কি জামাত বিএনপির দোসর? এরূপ ভাবলেশহীন নানা অতিকথনে জটিল বিতর্কে জড়িয়ে দায়িত্বশীলগণ করোনার সামনের ভয়াবহতাকে ভুলে গিয়ে অহেতুক কালক্ষেপন করে ফেলেছেন। এখন উপায়ন্তর না দেখে হা-হুতাশ করছেন।
ইতোমধ্যে করোনার ইউকে ভেরিয়েন্ট নামক নতুন ধরনটির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যিকারভাবে তাঁর মনের কথাটি বলে ফেলেছেন- “সমস্ত ঢাকা শহরকে হাসপাতাল বানালেও করোনা রোগীর স্থান সংকুলান করা সম্ভব নয়।” কি ভয়ংকর কথা! তবুও কারো যেন বোধদয় হচ্ছে না।
কিছুদিন পূর্বে সারাদেশে বিসিএস প্রিলিমিনারী টেষ্ট নেয়া হয়েছে। ০২ এপ্রিল মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেডিকেল ভর্তির কেন্দ্রগুলোর সামনে মানুষ ও প্রার্থীদের জটলা দেখে মনে হয়েছে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর উর্দ্ধগতি এই বাজে সময়ে মানুষের মহাসমুদ্রে গায়ে গায়ে ঠেলাঠেলি চলছে। এভাবে মাখামাখি করে সংক্রমণের গতি কী সারাদেশে ছড়ানো হলো না? এরা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়ে যখন বাড়ি ফিরবেন। এভাবে সংক্রমণ আরো ভয়াভয়ভাবে বিস্তার লাভ করবে তখন কি হবে? আরো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেলে তখন ঠেকাবে কে?
এছাড়া গেমস্ চলছে, বইমেলা চলছে। সামনে বৈশাখী মেলাও রয়েছে। মৃত্যু ঠেকাতে বৈশাখী মেলা এখনই বন্ধ ঘোষণা করতে হবে। আগে বলা হতো করোনা ঠান্ডা দেশের রোগ। এখন শুষ্কতা ও এর বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। টিকা নেবার পরও পুন:সংক্রমিত হবার ঘটনায় আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকার কার্যকারীতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় হার্ড ইমিউনিটির কথা ভেবে সবকিছু খোলা রাখা হয়েছিল। কিন্তুহার্ড ইমিউনিটি তৈরীর ধারণা ও আমাদের সমাজের বর্তমান বাস্তবতায় সেটা সম্ভব হয়নি। কারণ মানুষদল ও পশুদলের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া সব মানুষ তো পশুর মত আচরণ করে না, খায় না ঘুমায় না। অন্যদিকে দেশে ভ্রমণকরা প্রবাসীদের মাধ্যমে করোনার ৩৪টি ভিন্ন ভেরিয়েন্ট ভিন্নভাবে নানা জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাই দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়েও এই হার্ড ইমিউনিটির ধারণা পোষণ করাটা অমূলক বৈকি?
যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলে এই ধারণা তৈরীর জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে চরম অবহেলায় শুধু তাদের মৃত্যুসংখ্যা বেড়েছে, এখনও বাড়ছে।
তাই আমরা যাচ্ছি এক অজানা গন্তব্যে। অনেক প্রবাসী বিয়ে করে ইতোমধ্যে বৃটেনে, আমেরিকায় ফিরে গেছেন। চরম অবহেলা ও উদাসীনতায় নানা ভেরিয়েন্টে সংক্রমিত করে রেখে গেছেন তাদের সান্নিধ্যে আসা পরিবারে ও আত্মীয়-স্বজনদের। এখন তাদের থেকে হাটে-বাজারে, মাঠে-ঘাটে ঘুরেফিরে এক-দুই করে বেড়ে গেছে সংক্রমণের ভয়াবহতা। এই জটিল পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি আশু নতুন করে লকডাউন প্রয়োজন। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন আমাদেরকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা দান করে বিশ্ব মানবতার কল্যাণ দান করুন।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top