কোভিড-১৯ গোটা পৃথিবীটাকে অবরোধ করেছে
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
ছয় মাস আগেও একবার লকডাউন করা হয়েছিল স্পেনের মাদ্রিদ ও কাতালান। আবার নতুন লকডাউন মানতে পারছেন না সেখানকার অধিবাসীরা। এর প্রতিবাদে পুলিশের সাথে সেকি ধস্তাধস্তি। টিভিতে কালো পোশাকের পুলিশের সাথে রাজপথে মিছিলে মধ্যে টিভিতে নারী-পুরুষের মারামারি দেখে মনে হচ্ছিল কুস্তি খেলা চলছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় সেখানকার মানুষকে আবার ঘরের মধ্যে চলে যেতে নির্দেশনা দিতেই এই খেলা বিশ্ববাসী দেখেছেন।
করোনায় লকডাউনে মানুষের নড়াচড়া সীমিত করে দেয়া হয়। সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করা হয় সেই এলাকায়। যানবাহনের চলাচল থাকে খুবই সীমিত। কেয়ামতের দিনে হাশরের মাঠে মানুষ যেমন ইয়া নাফসী করবে ঠিক তেমন অবস্থা সূচিত হয় ঘরে বন্দী অসুস্থ রোগী ও জরুরী প্রয়োজন সম্বলিত মানুষদের মধ্যে।
কোভিড-১৯ আক্রান্তদেরকে যখন আইসোলেশনে রাখা হয় সেটা আরেক করুন পরিবেশ তৈরী করে। বাড়িতে আইসোলেন তবুও কিছুটা স্বস্তিদায়ক। পরিবারের সদস্যরা হয়তো দয়াপরবশ হয়ে রোগীর কক্ষে উকিঝুঁকি দিয়ে দেখে খোঁজখবর নেন। হাসপাতালের আইসোলেশন থেকে ফিরে আসা একজন রোগী জানিয়েছেন- সে অবস্থাটা তার জন্য অন্ধকার কবরের মত মনে হয়েছে। একুশ দিন আইসোলেশনে তিনি বার বার ‘কবরের মধ্যে আছি’ বলে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। গলা শুকিয়ে গেলে অনেক হাঁকডাক করেও কেউ একটু পানি দিতে আসেনি। দুনিয়াতে কবরে থাকার প্রমাণ পেয়েছেন তিনি। সেটা ঘটেছে ইউরোপের এক হাসপাতালে। যখন চিকিৎসকগণ নিজেরাই আক্রান্ত হচ্ছিলেন, এটা তখনকার কথা।
করোনার আগ্রাসী প্রভাবে সারা দুনিয়ায় মানুষের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হয়েছে। প্রথম ঢেউয়ে কর্মহারা হয়েছেন লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবি মানুষ। শ্রমিক ছাঁটাই, নতুন নিয়োগ বন্ধ, কলকারখানায় উৎপাদন বন্ধ দিনে আনে দিন খায় এমন মজুরদের পেটে পাথর বেঁধে বেঁচে থাকার কঠিন ব্রতে ঠেলে দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। যখন বেঁচে থাকার আর কোন অবলম্বন নেই, তখন নিরুপায় হয়ে মানুষ দিশেহারা হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। অন্যায় পথ খুঁজে নেয় অথবা হয়ে উঠে প্রতিবাদী । যেমন হয়েছে প্যালেষ্টাইনের মানুষ।
ফিলিস্তিনের জনগণ নিজ ভূমে পরবাসী। তাদের স্বাধীনতা নেই কোনকিছু করার। যুগ যুগ ধরে তারা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে লক্ডাউনের মধ্যে জীবন যাপন করে চেলেছে। তাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র আসার উপায় নেই। তাই তারা এখনও হাতে পাথর বা মাটির ঢেলা নিয়ে আধুনিক মারণাস্ত্রের সামনে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ইসরাইলী সৈন্যদের বোমা, গুলি, ট্যাঙ্ক, বিমান হামলা কোনটাকেই তারা ভয় পায় না। ছোট ছোট শিশু ও তাদের মায়েরাও প্রতিবাদ করে, জীবন বিসর্জন দেয় অহরহ। করোনার ভয়ে লকডাউনের আগেই তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে লকডাউনের আসল মর্ম কী। যদিও এই দুই লকডাউনের মধ্যে ব্যবহারিক পার্থক্য রয়েছে।
করোনা শুরুর আগে চীনের উইঘুর মুসলিমদেরকে নির্যাতন করা হতো। এখনো করা হচ্ছে চরম নির্যাতন। তাদের বাড়িঘর, দোকানপাট ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। লক্ষ লক্ষ উইঘুর মুসলিমকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে জোর করে। উইঘুরদের নিজেরে ভাষায় লেখা সাইনেবোর্ড দেখলেই সেসব বাড়ি, অফিস দোকান আগুন লাগিয়ে ছাই করে দেয়া হয়েছে। তাদেরকে অন্য কোন প্রদেশে যেতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। চাকুরীতে বাদ দেয়া হচ্ছে। তারাও জানে লক্ডাউনের আসল মর্মব্যাথা কেমন।
করোনা সংক্রমণের মধ্যে কাশ্মীরে শুরু হয়েছে লকডাউন বা অবরোধ। কাশ্মীরি মুসলমানদেরকে হত্যা, নির্যাতন ও সুন্দরী মেয়েদেরকে জোর করে বিয়ে করার ঘোষণা দিয়ে সভ্য মানুষরূপী মানুষের পৈশাচিক আত্মাগুলোর মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে বিশ্ব দরবারে।
আধুনিক সভ্যতার ধ্বজাধারী কিছু দেশের মধ্যে করোনা যেন মানবতার প্রতি চরম নির্যাতনের প্রতিবাদী বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে। যারা অস্ত্র-ক্ষমতার আত্মগরিমা ও মিথ্যা-জালিয়াতির বড়াই করে মানুষ হত্যা করতো, নিরীহ মানুষকে নিজ জন্মভুমিতে অবরোধ করে রাখতো, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করতো তারা করোনার ভয়ে চুপসে গেছে। করোনা তাদেরকে নাস্তানাবুদ করে ক্ষমতার দম্ভকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। করোনার কলো থাবায় তারা নিজেদের বালাখানয় বসে নিজেরাই লকাউন সূচিত করে চোরের মত ঘাপটি মেরে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছে।
কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন তারা না হয় খারাপ-তাহলে ভালো মানুষ কেন করোনায় মারা যাচ্ছে? মহামারীতে মৃত্যু ইতিহাসের অংশ। মহামারী কাউকে শাস্তি দেয়, কাউকে শিক্ষা দেয়। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, মহামারী বা দুর্যোগ শুরু হলে মানুষ যেন ভাল হবার শিক্ষা নেয়। ভালদের দলে ভিড়ে যায়। যেমনটি হয়েছিল নূহ নবীর সময়ে মহাপ্লাবনে কিস্তি ভাসানো ঘটনায়। তখন যারা নূহ নবীকে সঠিক নবী বলে কিস্তিতে আরোহণ করেছিল তারা বেঁচে গিয়েছিল। যারা অবজ্ঞা করে কিস্তিতে উঠেনি তারা প্লাবনের পানিতে ডুবে মরেছিল। এমনকি নূহ নবীর আপন ছেলেও তাকে অবজ্ঞা করায় ডুবে প্রাণ হারিয়েছিল। অর্থাৎ, মহামারী ও বিপর্যয় থেকে মানুষকে ভালো হবার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
অথচ আমরা দেখছি করোনা নামক অতি-মহামারী এসে মানুষকে চরম শিক্ষা দিলেও কিছু মানুষের বোধোদয় হচ্ছে না। তারা মানবতাকে এখনও অবহেলা করে চলেছে। ন্যায়কে ভুলে, তাচ্ছিল্য করে আরা বেশী অপরাধ করছে, মাদকদব্য গ্রহণ করছে। মাদকের ব্যবসা করে মানুষকে নষ্ট করছে। কিছু পাপাচারী মানুষ এই কঠিন সময়ে সততার শিক্ষা গ্রহণ না করে আরো ঘৃণ্য. আরো বেপরোয়া জীবন যাপন করছে।
তিনটি জিনিষ মানুষকে পশুত্বে নামিয়ে দেয়। তা হলো- মাদক, ক্রোধ ও কৃপণতা। করোনার সময় এই তিনটি জিনিষকে বেশী করে প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যাচ্ছে। শয়তান এই তিনটি জিনিষের মাধ্যমে মানুষকে ভুল পথে নেবার সুযোগ পেয়ে যায়। মুসলমান নামধারী মানুষেরা ইসলামের পথ ভুলে অনৈস্লামিক পন্থায় জীবন যাপন করার জন্য হয়রান হয়ে শয়তানির নানা আমলে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যেসব কাজে বা যে অনৈতিক র্চ্চাগুলোতে মাদকদ্রব্যের ব্যাপারে কোন বিধিনিষেধ নেই সেগুলো কীভাবে মানুষের চরিত্রের উন্নতি ঘটাতে পারে বা বোধগম্য নয়। কারণ, মাদক গ্রহণে মানুষের জ্ঞান-হুঁস হারিয়ে যে কোন বেআইনী কাজ করতে পারে। বেআইনী কাজ করাটা ভয়ংকর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়ে শাস্তি বয়ে আনতে পারে- যেটা একজন মানুষের সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন যাপনের অন্তরায়।
কোভিড-১৯ এর এই কঠিন সময়ে এভাবে ভয়ংকর অপরাধীরা এটাকে মোক্ষম সময় ভেবে মানুষের চরিত্র হনন করতে মাঠে নেমে পড়েছে। মানুষ এখন ঘরবন্দী। মানবতা লক্ড ডাউন। সারা পৃথিবীর মানুষ তাই আর ঘরবন্দী থাকতে চাচ্ছে না। স্পেনের রাস্তায় মানুষের প্রতিবাদ করোনার প্রতি নয়-যেন নতুন ফিলিস্তিন, নতুন কাশ্মীর, নতুন উইঘুরদের মত নি:শ্বাস চেপে ধরা মানবতা লুন্ঠনকারী শাসকদের বিরুদ্ধে নির্যাাতিত মানুষের হাতাহাতি, ধস্তাধস্তিকে প্রকাশ করছে। কোভিড-১৯ ছয় মাসের মধ্যেই যেন গোটা পৃথিবীটাকে অবরোধ করে রেখেছে। এই অবরোধের চাপে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ দিশেহারা, দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে দিকে দিকে যুদ্ধ, অভাব ও দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বিচলিত মানুষ ফিরে আসো ন্যায়ের পথে, ছেড়ে দাও সব জুলুম, অত্যাচার। অসীম ধৈর্য্যরে পরীক্ষায় উৎরে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মাধ্যমেই কল্যাণ হোক বিশ্বমানবতার।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য