করনাতঙ্কে বেশী বিচলিত না হয়ে ধৈর্য্য ধারণের সময় এখন
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
করোনা সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়তি সচেতনতা নেয়ার সময় এখন। শুধু আমরা নই, বিশ্ববাড়িটা এই মুহূর্তে বড়ই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। মহা দুর্যোগের ঘনঘটাকে আমরা বেশ অবহেলাতেই দোরগোড়ায় এনে ফেলেছি। বৈশ্বিক স্বাস্থ্যহানির এই ক্রান্তিকালে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তাই এককজন একেক কথা বলে, প্রচার করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলছি- যা আমাদেরকে আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
করনাতঙ্কে বর্তমান পৃথিবীটার সিংহভাগ মানুষের মধ্যে মরণাতঙ্ক ঢুকে এক করুণ অবস্থা সূচিত করেছে। তা হবেই না বা কেন? চীনে ভয়াবহ সংক্রমণের পর আজ পর্যন্ত ১৭২টি দেশে করোনা ভাইরাসের রোগী পাওয়া গেছে। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ লক্ষ ২০ হাজারের মত। এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন আট হাজার দুইশত পঁচানব্বই জন।
করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় আমাদের দেশেও অনেক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা ঘোষিত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।জনসমাগম হয় এমন কর্মসূচি যেমন সভা, পিকনিক, ওয়াজ, বিয়েবাড়ি ইত্যাদির ওপর নজর রেখে জন-জটলা এড়িয়ে চলার কথা বলা হচ্ছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে ভ্রমণে বেড়াতে নিশেধ করা হচ্ছে।
এত কিছুর পরও জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষকে ঘরের বাইরে যতে হয়। হোটেল-রেষ্টুরেন্টে খেতে বসতে হয়, কাঁচা বাজারের পথে ছুটতে হয়। সেজন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের লিখিত সতর্কবার্তায় প্রয়োজনীয় মাস্ক পরে জনভীড় এড়িয়ে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করে ঘরে ফেরার তাগিদ দেয়া হয়েছে।এছাড়া অহেতুক আতঙ্কিত ও বিচলিত না হয়ে ধৈর্য্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মানসিক শক্তি তৈরী করতে হবে। গুজবে কান না দিয়ে বিচলিত হয়ে বেশী বেশী কেনাকাটা না করতে বলা হয়েছে।
আমরা জানি মৃত্যুভয় সকল প্রাণির সবচে’ বড় ভয়। এই ভয়কে জয় করার জন্যে মানুষের চেষ্টার কমতি নেই। আমরা সবাই এই সুন্দর পৃথিবীতে ভালভাবে বেঁচে থাকতে চাই। পৃথিবীটা নশ্বর, সবাই জানি। তবুও এর আলো বাতাসের প্রতি সবার বড়ই আকর্ষণ। মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা পৃথিবী নামক বাড়িটার মোহকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ভালবাসা চিরন্তন। এই ভালবাসাকে বিপন্নদেরকে সহায়তা করার মাধ্যমে ধরে রাখার চেষ্টা করি। অহেতুক বেশী কেনাকাটা না করে বাজারদর স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ ও বুয়েটের রসায়ন বিভাগ আজ হাত ধোয়ার ৮০০ বোতল তরল সাবান বানিয়ে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রস্তুত করেছে। যদিও এট খুব সামান্য তথাপি বিশেষ প্রেরণাদায়ক কাজ। এছাড়া স্কাউট, বিএনসিসি, ইমাম, মাতবর, হেডমাস্টার, স্থানীয় ক্লাবের সদস্য, আনসার, পুলিশ ও সেনাবাহিনী সবাইকে যার যা করার দক্ষতা ও ক্ষমতা আছে তা নিয়ে করোনা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে মাঠে নেমে যাওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ছুটিতে বাড়ি ফেরত ছাত্র-ছাত্রীরা এ বিষয়ে নিজ নিজ এলাকায় বিশেষভাবে সহায়তা কাজে লাগতে পারে। এজন্য খুব দ্রুততার সাথে লোকাল সাহায্যকারী জরুরী টিম তৈরী করা উচিত। এ জরুরী অবস্থায় দেরী করার মোটেও সময় নেই।
জরুরী স্বাস্থ্য সেবার জন্য করোনা নির্ণয় করার কিটস, প্রটেকশন স্যুট, মাস্ক, গ্লাভস, অক্সিজেন, টিস্যু পেপার, সাবান, কোথায় পাওয়া যাবে তার জন্য পাড়ায় পাড়ায় নির্দিষ্ট স্থান বানিয়ে ঠিকানা প্রচার করা জরুরী। জরুরী খাবার, পানি ও হাসপাতালে নেয়ার জন্য এম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখাটা জরুরী।
মানুষকে যেখানে সেখানে কফ, থুতু না ফেলার জন্য পুন: বলতে হবে। ব্যবহৃত মাস্ক, টিস্যূ নির্দিষ্ট ঢাকনাওয়ালা ডাস্টবিনে, মাটিতে পুতে অথবা পুড়ে ফেলতে বলতে হবে। আড্ডা, হাট-বাজার, পার্ক ও বাসার বাইরে অহেতুক না যেতে সাবধান করতে হবে।
মনুষ্যত্ত্বের প্রতি অবহেলা, সাহায্য ও শ্রদ্ধার শৈথিল্য ক্রমাগত ভুলুন্ঠিত হতে থাকলে সেখানে মানবতা অচিরেই মাটিতে মিশে উধাও হয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
এতদিন গড়িয়ে যাবার পরও দেশে দেশে করোনা সংক্রমণ প্রবণতা মানুষকে হতাশ করে তুলছে। এটার ভীতি মানুষকে দিন দিন স্বার্থপর করে তুলছে যা মোটেও কাম্য নয়। ভীতিকর গুজব তৈরী করে মানসিক জড়তায় আবদ্ধ রেখে জরুরী প্রয়োজনের সময়েও এটা মানুষের মাঝে দূরত্ত্বকে বাড়িয়ে দিচ্ছে-যা মোটেও সুখকর বিষয় নয়। বিপদের সময় অতিবেশী বিচলিত হলে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া কঠিন হয়। করোনায় অতি বিচলতা ও ভীতির জন্য মানুষে মানুষে সার্বজনীন দূরত্ত্ব কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা বড় আশঙ্কার বিষয়। সেজন্য করোনা সংক্রমণ ভীতি দূর করতে আশু বিশেষ ধৈর্য্য অবলম্বন করার জন্য জ্ঞানী ও সাহসী মানুষের আলোর পরশ দরকার। এজন্য আসুন সবাই নতুন করে আত্মবিশ্বাসী হই, পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে এসে সবাইকে ধৈর্য্য ধরে এই নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে উৎসাহ যোগাই।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য