logo
news image

কেতাদুরস্ত কুম্ভীলকে করণীয় কি

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
গত চার ও পাঁচ জানুয়ারী ২০২৩ পর পর দু’টি বড় বড় আত্মসাতের ঘটনা গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। একটি ১৫৮ কোটি টাকা ও অন্যটি ৫৫২ কোটি টাকার সার আত্মসাতের সংবাদ নিশ্চয়ই অনেকের নজর কেড়েছে। এই বড় সংবাদ দুটো দেশের ব্যবসায়ীদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে সাথে দেশের মিউচুয়াল ফান্ডে অনেক বিনিয়োগকারীকেও। 
এতদিন ভাবা হতো দেশ থেকে ব্যাংকের টাকা চুরি হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, শুধু ব্যাংক নয়- শেয়ার বাজারের টাকাও আত্মসাৎ করা হয় এবং মিউচ্যুয়াল ফান্ডের টাকাও কারসাজির মাধ্যমে উধাও হয়ে যেতে পারে। এছাড়া ‘ইনটেলেকচ্যুয়াল প্রপার্টিজ’ চুরি কর হচ্ছে, একজনের রচনা বা থিসিস অন্যজন চালিয়ে দিচ্ছে নিজের নামে। এতদিন রিলিফের চাল, গম. কাপড়, বিস্কুট, টিন ইত্যাদি ছাড়িয়ে আমদানী করা সার আত্মসাতের বড় ঘটনা হয়তো এটাই প্রথম। দেশের প্রায় সব জায়গায় ছিঁচকে চোরকে ধরা হয়, শাস্তি দেয়া হয। কিন্তু এসব স্মার্ট চোর বা কেতাদুরস্ত কুম্ভীলকেরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এদের গভীর দৌরাত্ম্য ঠেকাতে করণীয় কি?
চারটি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে জমা থাকা প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের প্রায় ১৫৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন উক্ত ফান্ডের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা প্রধান ব্যক্তি। তিনি গত চার বছর থেকে কৌশলে উক্ত টাকা সরিয়ে ফেলেন। ইউনিভার্সেল ফাইন্যানসিয়াল সলিউশনস (ইউএফএস) নামক সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। ২০১৮ সাল থেকে একটু একটু করে তহবিল সরানোর ঘটনা ঘটায়  এসব তহবিল দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা কাষ্টডিয়ান প্রতিষ্ঠান এতদিন টের পাননি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-র পক্ষ থেকে আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি নজরে আনা হলে তাদের টনক নড়ে।
ইউএফএ-এর অধীনে পাঁচটি মিউচুয়্যাল ফান্ড পরিচালিত ছিল। যার মধ্যে চারটি তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এজন্য ইউএফএস সংশ্লিষ্ট ১৫ ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে ৩০ দিনে জন্য। বিষয়টি এখন হাইকোর্টের রুলের মধ্যে গড়িয়েছে। মিউচ্যুয়াল ফান্ডে অর্থ জমা করা একটি নিরাপদ তহবিল হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু এসব ঘটনায় মিউচুয়্যাল ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা আগে কিছুট কমে গেলেও আবার নতুন করে একবারে তলানীতে ঠেকে গেছে বলে অনেকে মনে করছেন।
আরেকটি বড় ঘটনা হলো সরকারীভাবে আমদানী করা বাহাত্তর হাজার মেট্রিক টন রাসায়নিক সার বন্দর থেকে খালাসের পর গুদামে পৌঁছিয়ে না দিয়ে আত্মসাৎ করেছে পরিবহনের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এজন্য সরকারের ৫৮২ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ইতোমধ্যে বিসিআইসি-র বোর্ড সভায় এ বিষয়ে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা করার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চাওয়া হবে। 
কারণ, ‘বিসিআইসি একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২-এর তথ্যানুযায়ী সর্বশেষ সাত বছরে প্রতিষ্ঠানটি তিন হাজার চারশ পঁচাশি কোটি টাকার বেশী লোকসান দিয়েছে।’ 
এসব সার পরিবহনের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠনের মালিক নরসিংদী থেকে নির্বাচিত একজন সাংসদ। তিনি বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসাসিয়েশনের সভাপতি। জানা গেছে, তিনি মূলত: দেশের সার ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। পত্রিকায় আরো বিশদভাবে অনেক তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
আমার এই লেখার মূল উদ্দেশ্য শুধু এই দু’টি অর্থ আত্মসাৎ বা সার আত্মসাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়। দেশে এখন একটি নতুন শ্লোগানের মাধ্যমে উন্নয়নের গতিকে বেগবান করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সেটা হলো আগামীর বাংলাদেশ হবে- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ।’ এজন্য সব মানুষকে কাজে, কর্মে ব্যবহারে, আচারে স্মার্ট হতে হবে। সেখানে এই ধরনের অর্থ কেলেঙ্কারির সংবাদগুলো খুব সাংঘর্ষিক। এগুলো সব শ্রেণির মানুষকে আঘাত না করলেও খেটে খাওয়া সাধারণ কর্মজীবি মানুষকে বেশী পীড়া দেয়। এগুলোর সংগে দেশের সকল মানুষের আর্থিক বঞ্চনার বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ফুটে উঠে।
দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় অনেক বেড়েছে বলে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আর্থিক তথা আয় বৈষম্য কতটু তা বেশী বলা হয় না। কখনও সরকারীভাবে সেটা প্রকাশ করা হয় না। সরকারী দায়িত্বে থাকা মানুষেরা সরকারী তহবিল তদারকি করে থাকেন। তাই সেটা সংগ্রহ ও ব্যবহার করার সুযোগ পান। অর্থাৎ, সরকারী দায়িত্ববানরাই সরকারী সম্পদের রক্ষাকর্তা ও পাহারাদার। তারা জালিয়াত ও অর্থ-সম্পদ আত্মসাতে নিয়োজিত হয়ে পড়লে স্মার্টনেসের সংজ্ঞাকে নেতিবাচক হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হয়।
বাংলা একাডেমির অভিধানে বর্ণিত (২০২৩) অনলাইন প্রদর্শিত স্মার্ট শব্দের বাংলা অর্থ থেকে জানা যায় এর নানা দিক। অনেক ইংরেজি শব্দের বাংলায় বহুল ব্যবহারের মতো আমরা বাংলাভাষায় স্মার্ট শব্দটিকে নানা জায়গায় নানা কারণে হবহু ইংরেজিতে ‘স্মার্ট’ বাংলা শব্দের পাশে কথায় বলি, লিখি। বাংলা একাডেমির অভিধানের পুরনো সংস্করণে স্মার্টের ৩১টি বাংলা শব্দ খুঁজে পেয়েছি। সে অভিধানে এর বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়া, ক্রিয়া-বিশেষণ প্রভৃতির মাধ্যমে স্মার্ট শব্দের বিভিন্ন অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে। অনলাইন প্রদর্শিত নতুন সংযোজনে আরো কতিপয় অর্থ জানা গেছে। সবগুলোকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক এ দুভাগে ভাগ করে ব্যবহারও করা হয়েছে।
বিশেষ্য যেমন- কেতাদুরস্ত, চটপটে, বাবু, সেজেগুঁজে ফিটফাট হওয়া, দক্ষ, বুদ্ধিমান, চালাক, পটু ইত্যাদি। বিশেষণ যেমন- বুদ্ধিমান, চটপটে, করিৎকর্মা, তীক্ষè, জ¦ালাময়, ছিমছাম, রসবোধপূর্ণ, উজ্জল, নবীন-দর্শন, পরিচ্ছন্ন, সুবেশ, ক্ষিপ্র, জলদি ইত্যাদি।
ক্রিয়া-শাস্তি হওয়া, দন্ডিত হওয়া, কঠোর হওয়া, বাজা, টনটন করা, কনকন করা, জ্বালাকরা, জ্বালান ইত্যাদি। ক্রিয়া-ট্রানজিটিভ, যেমন- তীব্র ব্যাথা অনুভব করা, তীব্র ব্যথা দেওয়া, পরিণাম ভোগ করা, (দেহ ও মনে তীব্র ব্যাথা ইত্যাদি)। 
অভিধানে এতগুলো অর্থ স্মার্ট বলতে বুঝানো হয়েছে। আর সেজন্যই বোধহয় মানুষ কতভাবেই না তার স্মার্টগিরিকে ফলাতে চায়। ইতিবাচকভাবে স্মার্ট বলতে আমরা ভালবাসি। বাংলা অভিধানে প্রথম দিকে স্মার্ট অর্থ- কেতাদুরস্ত, বাবু, সেজেগুঁজে ফিটফাট হওয়া, ইত্যাদি বলা হয়েছে। কিন্তু যিনি পদ-পদবী ও পোশাকে কেতাদুরস্ত ও ফিটফাট হয়ে ‘হোয়াইট কলার ক্রাইম করে’ অর্থ আত্মসাৎ করেন তাকে কি আমরা স্মার্ট বলবো নাকি আনস্মার্ট বলবো? নাকি মহাস্মার্ট বা সুপারস্মার্ট বলবো?
অভিধানে স্মার্ট-এর ক্রিয়া অর্থ বলতে বলতে প্রথমেই শাস্তি বলা হয়েছে। নেতিবাচক কিছু বুঝালে বা ঘটানো হলে সেই ‘স্মার্ট’ বিষয়ে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে কিভাব? কিছুদিন পূর্বে এক চোর চুরি করতে গিয়ে দোকানের মধ্যে আটকা পরে ৯৯৯ হটলাইনে পুলিশকে কল দিয়েছিল। সে দ্রুত উদ্ধারও পেয়েছে। মোটকথা, কেতাদুরস্ত সুপারস্মার্ট অর্থ আত্মসাতকারী অথবা পেটের দায়ে চুরি করতে গিয়ে আটকা পরা সিঁদেল চোর উভয়ের জন্য স্মার্ট শব্দের ক্রিয়াগত সংজ্ঞায় শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে- খোদ বাংলা অভিধানে।
কেতাদুরস্ত স্মার্ট আত্মসাৎকারীর শাস্তি সংজ্ঞায় থাকলে সেটা বাস্তবে রূপ দিতে হবে। কারণ, স্মার্ট বললে শুধু গুণ বুঝায় না। পাশাপাশি শাস্তিকেও বুঝায়। এই গুণ বা শাস্তি মানুষ নামক স্মার্ট, আনস্মার্ট, মহাস্মার্ট বা সুপারস্মার্ট প্রাণি ও তাদের সমাজের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। যেমন, মেক্সিকোর সুপারস্মার্ট মাদক কারবারী জোয়াকিন এলচাপো এখন আমেরিকার জেলে বন্দী রয়েছে। গত ৬ জানুয়ারী তার ছেলে ওভিদিও গুজম্যানকে মেক্সিকোর সিনোলিয়া রাজ্যের রাজধানী কুলিয়াকান শহরে গ্রেপ্তারের পর সেখানে তার সমর্থনপুষ্ট মাদক কারবারী চক্রের হামলা ও তান্ডবে ১০ জন সৈন্যসহ মোট ২৯ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। গাড়ি, বাড়ি, দোকান পুড়ে দেয়া হয়েছে শতাধিক। এতবড় স্মার্ট মাদক সম্রাট তার অনৈতিক মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে অতিস্মার্ট অধুনিক অস্ত্র সম্বলিত অপরাধী চক্র গড়ে তুলেছেন। তিনি নিজে জেলে থাকলেও তার অপরাধী ছেলে বাবার বেআইনী ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে ফিটফাট কেতাদুরস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল-যার পাল্টা আক্রমণে মেক্সিকোতে এতগুলো জান-মালের ধ্বংস সাধন হলো ।
এরকম অনেক কেতাদুরস্ত স্মার্ট আত্মসাৎকারীরা দেশের অনেক ক্ষতি করে চলেছে। গতবছর পি.কে. হালদার সাড়ে তিন হাজার টাকা পাচার করে বিদেশে পারিয়ে গেছে। হলমার্ক দেশের সোনালী ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। ডেসটিনি চারাগাছ বিক্রির নামে নিরীহ সৎ মানুষের সঞ্চয়-সম্পদ ধুয়ে-খুবলে খেয়ে সটকে পড়েছে। এরাই তো বড় বড় স্মার্ট- সুপারস্মার্ট চোর-ডাকাত, জালিয়াত। এসব অর্থ আত্মসাতকারীদের আদতে কোন শাস্তি হয়নি। এসব সম্বল হারানো বিচারপ্রার্থী মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রান করে পথের ফকির করে তোলা হয়েছে।
স্মার্ট ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, পুলিশ, বিচারক ইত্যাদি গড়ে তোলার আগে স্মার্ট মানুষ গড়ার পরিকল্পনা থাকা উচিত। কারণ আমরা দেখেছি দুর্নীতিবাজরা শুদ্ধি অভিযানের সময় স্মার্ট চালাকি করে নিজেকে রক্ষা করে। কর ফাঁকি দেয়ার নানা স্মার্ট কৌশল অবলম্বন করে কোটি কোটি টাকার মালিক শিল্পপতিরা। চাকুরীতে নিয়োগের বেলায় দুর্নীতি ও তোয়াজ-তোষণের নীতিতে পর্যুদস্ত হয়ে পিছনে পড়ে যায় যায় মেধাবীরা। পেশীর জোরে চোরের কন্ঠ সব জায়গায় হয়ে উঠে সরব। স্মার্ট চোর জালিয়াতরা অর্থ আত্মসাৎ করে ধনী সেজে অমানুষ হয়ে উঠে। টাকা দিয়ে রাজনীতিতে মনোনয়ন কিনে নেয়। এরপর মাফিয়া হয়ে উঠে। সবশেষে একসময়ের এসব সাহায্যদাতা-দাত্রীরা নিজেরাই হয়ে যায় নির্যাতনকারী ও নিপীড়ক।
এদের থাপইত বা আশ্রয়দাতারা আরো বেশী স্মার্ট হয়ে উঠে। এদেরকে আমরা স্মার্ট বলি কীভাবে? স্মার্টের অর্থ শুধু ছিমছাম-ফিটফাট ভাবলে ভুল হবে। তাইতো স্মার্ট-সুপারস্মার্ট নয়- আমরা স্বাভাবিক, সৎ কর্মঠ মানুষ চাই। কেতাদুরস্ত অতি স্মার্ট চোরদের জন্য অন্যায়ের স্মার্ট বিচার ও স্মার্ট শাস্তি কিভাবে বর্তাবে?
গুরুত্ত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে এভাবে বেআইনী কাজ করা অর্থ আত্মসাতকারী পোটন বা ইউএফএস-দের মনে ইতিবাচক পরিবর্তন না হওয়াটা আমাদের মানসিকতার দুর্বলতা। এরা একদিকে সুপারস্মার্ট ধড়িবাজ, অন্যদিকে জঘণ্য আনস্মার্ট চরিত্রের বহি:প্রকাশ মাত্র। এদের দেখে সমাজের পিছিয়ে পড়া আনস্মার্ট মানুষেরা হঠাৎ স্মার্ট সেজে ব্যাপক চুরি-জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতে মেতে উঠলে স্মার্টের সংজ্ঞানুযায়ী পাশাপাশি শাস্তির কথাটাও তাদেরকে বড় গলায় বলে দেয়াটা কার দায়িত্ব বর্তায়?
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top