logo
news image

বিনষ্ট সম্বল ও সীমাহীন কষ্ট বানভাসীদের

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
এ বছর বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ইতোমধ্যে পর পর তিনবার বন্যা ও পাহাড়ি ঢল হয়ে গেল। অল্প সময়ের ব্যবধানে এত ঘন ঘন বন্যা মোকাবেলা করার জন্য সেখানকার মানুষ মোটেও প্রস্তুত ছিল না। বিশেষ করে তৃতীয়বারের বন্যার পানির প্রবল স্রোত ও আক্রোশ এত বেশী ছিল যে তা দেখে অনেকে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। জীবন বাঁচাতে ডুবে যাওয়া বসতবাড়ি ও সহায়-সম্বল ছেড়ে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে ভেলা, নৌকা, ট্রলার, দূরের কোন উঁচু দালান, রাস্তার ধারে অথবা আশ্রয় শিবিরে।
অন্যান্যবার বন্যা হলে দু’তিনদিন পরে পানি নেমে যেত। তখন বন্যার্তরা নিজ নিজ বসতভিটায় ফিরে গিয়ে নতুনভাবে গুছিয়ে নিয়ে জীবন-জীবিকা শুরু করতো। কিন্তু এবারের বন্যার তান্ডব, বিস্তার ও স্থায়ীত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন থাকায় পানি নামতে থাকর গতি খুবই ধীর প্রকৃতির। বন্যা শুরু হবার সাত-দশদিন পরেও কোথাও কোথাও পানি সরে যাবার লক্ষণ দেখা যায়নি। গ্রামাঞ্চলে কারো কারো বসতবাড়ির ঘরের চালের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল প্রবল স্রোত। সবকিছু ভেঙ্গে-চুরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অনেকের। পানি নামার পর নিজেদের বাড়িঘরের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছেন না অনেকে।  প্রলয়ঙ্কারী বন্যার পর এলাকায় ফিরে বিধ্বস্ত ও শূণ্য ভিটা দেখে অনেকে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। সামনের দিনগুলোতে কি করবেন, কি খাবেন, সন্তানদের নিয়ে কিভাবে দিনাতিপাত করবেন-সেই চিন্তায় অধীর হয়ে উঠছেন তারা।
বন্যায় কি নষ্ট হয়নি তাদের? নষ্ট হয়ে যাওয়া বস্তভিটা ও সহায় সম্বলের মধ্যে চারদিকে শুধু কষ্ট খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। সিলেটে ৮০ ভাগ এলাকা এবং সুনামগঞ্জে ৯০ ভাগ এলাকা সাত থেকে ১০ দিন যাবত পানির নিচে ডুবে ছিল। এর ফলে যে চরম ক্ষতি হয়েছে তার সেটা মানুষ আগে মোটেও কল্পনা করেনি। বন্যার পর চারদিকে শুধু হাহাকার শব্দ যেন সেখানকার গৃহহারাদের কানে প্রতিধ্বনিত হয়ে পরিহাস করছে।
বিধ্বস্ত ভিটায় ফিরে প্রথমেই দেখছেন, তাদের খাবার পানির উৎসটি অকেজো বা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। সুপেয় পানির উৎস টিউবওয়েলটি কাদা, বালুতে ডুবে নষ্ট। যাদের বাড়িতে পাইপলাইনের পানি সরবরাহ ছিল সেগুলোতে বন্যার দূষিত পানি ঢুকে গেছে লিকেজ হয়েছে অথবা ভেঙ্গে গেছে। জলাবদ্ধতায় সেগুলো মেরামত বা নতুন করে সংযোজন করার অবস্থায় নেই অনেক দুর্গত পরিবার। দূরবর্তী স্থান থেকে অতিকষ্টে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে অনেককে। বন্যার আগে অনেকে পাহাড়ি ঝর্ণার পরিস্কার পানি ব্যবহার করতেন। এখন জমে থাকা বন্যার ময়লা পানি নিত্যসংগী হয়ে পড়েছে। এসব নোংরা পানি দিয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম সারানোর ফলে পেটের অসুখ শুরু হয়েছে অনেক পরিবারে। এভাবে ডায়রীয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, জ¦র, আমাশয় ও কলেরার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে সেটা অনেক ভয়ংকর হতে পারে। রিমোট পাহাড়ি এলাকায় খাবার পানির উৎস ঠিকভাবে কাজ না করলে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়তে পারে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এর পরের বড় কষ্ট হলো দ্রুত যোগাযোগ করার উপায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ চালু হলেও রাস্তাগুলো ভেঙ্গে যাওয়ায় চলাচলের গতি থমকে গেছে উপদ্রুত এলাকায়। মূল রাস্তায় তাৎক্ষণিকভাবে জরুরী সংস্কারের মাধ্যমে কিছু গর্ত মেরামত করে গাড়ি চলাচল করলেও পাড়া-মহল্লা ও বিশেষ করে গ্রামীণ রাস্তাগুলোর সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে এখনো। সুনামগঞ্জ জেলায় আড়াই হাজার কি.মি: সড়ক নষ্ট হয়ে গেছে। দুইশতাধিক ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙ্গে ফুটো হয়ে গেছে বলে সংবাদ হয়েছে।
কিছুদুর পর পর বড় বড় গর্ত, খানা-খন্দক সৃষ্টি হওয়ায় পায়ে চলতে গিয়ে বিড়ম্বনা সৃষ্টি হচ্ছে সুনামগঞ্জের ছাতক, গোয়াইনঘাট, দিরাই, শাল্লা, সিলেটের আখালিয়া, জকিগঞ্জ, নেত্রকোণার কেন্দুয়া, নিকলী এমনকি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি, চিলমারী, জোড়গাছবাজার, উলিপুরের থেতরাই প্রভৃতি এলাকার পল্লী জনপদগুলোতে। এসব এলাকার অটোরিক্স্চালকরা পড়েছেন মহা বিপাকে। ভাঙ্গা-চোরা রাস্তার কারণে তাদের দৈনিক আয় কমে যাওয়ায় পরিবারের ভরণ-পোষণ নিয়ে চরম কষ্টে রয়েছেন তারা। জরুরী পণ্য পরিবহন ও ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে।
সিলেট এলাকায় এমনিতেই শাক-সব্জির দাম বেশী। বন্যায় সব্জির আবাদ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং রাস্তা নষ্ট থাকায় কোন একান এলাকায় শাক-সব্জির চরম আকাল দেখা দিয়েছে। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এক হিসেব মতে, মতে শুধু সিলেট অঞ্চলে আট কোটি টাকার মাছের পোনা ভেসে গেছে। আমন ধানের বীজতলা ও চারা নষ্ট হওয়ায় এবার আমন ধানের ফলন হ্রাস পাবার ব্যাপক আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বন্যার পানি সরে যাবার সাথে সাথে দুর্গম পাহড়ি ও পল্লী অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকরা কাজের উপায় হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছেন। তাদের অনেকের সামান্য জমি। সেখানে বন্যায় পলিমাটি পড়ার নামে জমেছে বালুর পাহাড়। যেসব প্রান্তিক কৃষক  ও বেকার যুবকরা ঋণের টাকায় অন্যের পুকুর লিজ নিয়েছেন অথবা জমিতে বর্গা আবাদ শুরু করেছেন তারা ঋণের কিস্তি শোধ দেয়ার সময় বিপদের আশঙ্কা করছেন। ব্যাংকের ঋণ তারা শোধ দিবেন কীভাবে? এ নিয়ে তাদের চরম মানসিক যাতনা শুরু হয়েছে।
বসতভিটার সাথে যাদের যাদের ঘর-বড়ি কিছু অবশিষ্ট আছে তাদের আসবাবপত্র, তৈজষপত্র ভিজে নষ্ট হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশী। উপদ্রুত এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এসব এলাকায় এবছর এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠান নিয়ে এখনো চরম বিপাকে রয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
দেশের পাহাড়ের পাদেেদশে পুন:পুন: বন্যায় মানুষের মন ভেঙ্গে গেছে। বিশেষ করে ভয়ংকর আগ্রাসী বন্যার রূপ তাদের কাছে একবারেই অনাকাঙ্খিত ছিল। তাই এটা মোকাবেলা করতে গিয়ে তারা চরম অসহায় ও ভীত হয়ে পড়েছে। এবারের বন্যায় আমাদের দেশে  জুন ২৬, ২০২২ পর্যন্ত ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভারতের আসামে মৃত্যু হয়েছে ১৬৭ জনের। সেখানে রেড এলার্ট জারি করা হয়েছিল। আসামে বন্যার পরভয়াবহ জলাবদ্ধতা শুরু হয়েছে। আমাদের দেশে ভয়ের আরেকটি কারণ হলো- চেরাপুঞ্জিতে এবছর আরো বেশী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাষ রয়েছে। সামনে ঘোর বর্ষাকাল। সেসময় চেরাপুঞ্জিতে আবারো অতিবৃষ্টি হলে সিলেটে ভরা বর্ষা মৌসুমে আবারো পাহাড়ি ঢল ও প্রবল বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য আমাদের যথাযথ প্রস্তুতি কই?
দুর্নীতির পর দুর্যোগ আমাদের সব অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্থ করে তোলে। প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের আয় বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান তৈরীতে প্রদান ভূমিকা রাখে। দুর্যোগের পর ত্রাণ চুরির মহোৎসব আমাদের সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। তাই এদিকটিতে সতর্ক হওয়া জরুরী।
ঘরহারা বন্যার্তদেরকে ত্রাণ নয়- সেনাবাহিনীর মাধ্যমে গৃহনির্মাণ সামগ্রী কিনে অথবা ঘর তুলে দিন। ফসলহারা প্রান্তিক কৃষকদেরকে বাঁচাতে ঋণ মওকুফ করে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দান করুন। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী বিনামূল্যে চিকিৎসা, বই-পুস্তক, পুষ্টিকর শিশুখাদ্য প্রদান করুন। উপদ্রুত এলাকায় বন্যার পানি না সরতেই দেশে করোনার চতুর্থ ধাপের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। ডায়রীয়া, কলেরা ও অন্যান্য অসুখের জন্য জরুরী চিকিৎসা জোরদার করার পাশাপাশি করোনার ওমিক্রণ ধরণের সংক্রমণ ঠেকাতে আশু তৎপরতা জোরদার করুন। আমাদের আনন্দের মাঝে সম্প্রতি সম্বলহারা ও সীমাহীন কষ্টের মধ্যে থাকা বানভাসীরা কেমন আছে তা একটু স্মরণ করা উচিত। এই দু:সময়ে তাদের জন্য প্রাণ খুলে সাহায্যের হাত প্রসারিত করা সবার নৈতিক দায়িত্ব বটে।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top