logo
news image

খাদ্য নয় আমরা ভাত খেতে ডাকি

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
রান্না হতে দেরী হওয়ায় রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে এক শিশু। রান্না-বান্না শেষ করে মা শিশুকে ডাকছে- বাবা ভাত খাবি নারে? ওঠ। খাবারের টেবিলে যত ভিন্ন পদের খাবার থাকুক না কেন আমার প্রতিবেলায় ভাত খেতে আসার জন্য হাঁকডাক শুনে ভাত খেতে আসি, ভাত খেতে বসে ভাত খাই। কারণ, ভাত বাঙালীর প্রধান খাদ্য। কথায় বলে না, মাছে-ভাতে বাঙালী। ভাত না থাকলে মাছের কোন কদর নেই।
জাপানীজরা কাঁচা মাছের সাশিমী খেলেও বিখ্যাত সুশি নামক কাঁচা মাছের তৈরী খাবারের সাথে ভাত খায়। এজন্য তারা সুশির ভেতরে ষ্টিকি চালের ভাত পুরে দেয়। আমরা যেমন সিঙ্গারার ভেতরে আলু-কলিজা ইত্যাদি দিয়ে পুর তৈরী করি। আমরা ছাড়াও ভারত, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, চীন, জাপান সহ পৃথিবীর শতাধিক দেশে ভাত খুব জনপ্রিয় ও অনেকের প্রধান খাবার।
ভাত নিয়ে ক’দিন ধরে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। গত ২৪ অক্টোবর খাদ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের ৫০ বছরে কৃষির উৎপাদন : রুপান্তর ও অর্জন শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “আমরা অনেক বেশী ভাত খাই। ভাত খাওয়া কমাতে পারলে চালের ব্যবহার অনেক কমে যাবে।” তিনি সহজ-সরলভাবে কথাটি বললেও ভেতো বাঙালীর কানে কথাটি শুনে মনে কষ্ট পেয়েছে। ভাত খাওয়া কমানোর পরামর্শ কারো দারিদ্র্য অথবা ডায়াবেটিস রোগ হবার দিকে ইঙ্গিত করে। অনেকে ভাবছেন, তাহলে দেশে কি ভাতের অভাব দেখা দিয়েছে?  এদেশে পেট পুরে ভাত খেতে না পারলে করো কারো রাতে ঘুমই আসে না এমন ঘটনাও ঘটে যে!
ধানের দেশ গানের দেশ বাংলাদেশে একবেলা পেটপুরে ভাত খেতে না পারলে কি আর কারো মুখে ভাটিয়ালী, জারি-সারি গান বের হয়? রুটি খেলে তো আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। মিষ্টি মধুর সুরেলা কন্ঠের গান বেরুবে কোন গলা দিয়ে? ভাত নিয়ে একটি লেখা পড়তে গিয়ে একবার এক স্বাধীনতা দিবসে বাচ্চাদের অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে গেল। খেলাধূলার পর্ব শেষে গ্রামের স্কুলে বিচিত্রানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কবিতা, নাচ, গানের প্রতিযোগিতা হবে। তারপর বিজয়ীদের পুরস্কার দেয়া হবে। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। আমি মঞ্চে বসেছি একজন অতিথি হিসেবে। বিচারকরা বসেছেন একদিকে সারি করে। ঘোষক মাইকে ঘোষণা দিল- এবারে যে গান গাইতে আসছে সে খুব ভাল গান গায়। কয়েকবার তার নাম ধরে ঘোষণা দেয় হলেও সে উপস্থিত নেই। অথচ একটু আগেই তাকে মঞ্চের পাশে বসে থাকতে দেখা গেছে। একটু খোঁজাখুজি করতে তাকে স্কুলের  টিউবওয়েলে বাম হাতে হাতল চেপে ডান হাত দিয়ে নলে মুখ লাগিয়ে পানি খেতে দেখতে পাওয়া গেল।
তাকে গান গাওয়ার জন্য ধরে আনা হলো। কিন্তু সে ভাল সুরেলা কন্ঠে গান গাইতে পারছিল না। তাকে বিচারকরা জিজ্ঞেস করলো আজ তোমার কি হলো? কেন এমন হচ্ছে? সে কাঁদতে শুরু করলো। বলল, আজ সকালে ভাত খায়নি। রুটি খেয়ে স্কুলে এসেছে। তাই পেটে ব্যাথা হচ্ছে! বার বার পানির পিপাসা লেগে যাচ্ছে। সেবারে বন্যায় ওদের ধানের আবাদ হয়নি। তাই ঘরের ভাত ফুরিয়ে যাওয়ায় দু’বেলা করে রুটি খাচ্ছে ওরা। রুটি খাওয়া ওদের অভ্যেস নেই। তাই মনে খুব কষ্ট হচ্ছে। গলা দিয়ে গানের সুর বের হচ্ছে না। উপস্থিত অনেকে বললো আহারে বেচারা আজ ভাত খেতে পারেনি!
সেই ভাত কম খাওয়া নিয়ে আবার কথা বলাবলি শুরু হয়েছে। তাই বিষয়টি খুব চিত্তাকর্ষক ও গুরুত্ত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। ভাত শর্করা, শরীরে শক্তি যোগায়। কায়িক পরিশ্রমে গায়ে বল দেয়। ভাত ফুরিয়ে গেলে মঙ্গা পরিস্থিতি ভাবা যায়। এ নিয়ে রাজনীতিও জমে ব্যাপক।
আমাদের দেশে খাদ্যের উৎপাদন বেড়েছে। তবু কেন খাদ্যাভাব? বাজারে খাদ্যদ্রব্য ও তৈজষপত্রের সরবরাহে ঘাটতি নেই, তবু কেন সংকট? লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যশস্য গুদামে মজুদ করা আছে বলে তথ্যে দাবী করা হচ্ছে। তবুও কেন ক্ষুধার সময় ভাত কম করে খেতে হবে?
উৎপাদন বাড়লেও খাদ্যাভাবের বা অভাবের মূল কারণ হচ্ছে- খাদ্য সংগ্রহে ভুল তথ্য, সংরক্ষণ, বন্টন, বাজারের নিয়ন্ত্রণহীনতা ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সুরক্ষা বলয় তৈরীর অভাব। সম্পদের মেরুকরণে কেউ নিত্য বাঁশমোতি, চিনিগুঁড়া চালের পোলাও, ফ্রায়েড রাইস খায়, কেউবা ইরি-বিরি চালের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে উপোষ দিন-রাত কাটায়। আমরা পুষ্টিকর খাবারের মেন্যু নিয়ে খাবার বৈচিত্র সম্পর্কে মোটেও ভাবি না। শতকরা আশিভাগ মানুষ এক গামলা ভাত লবণ-মরিচ দিয়ে পেটে পুরতে পারলে খুশী হই। এটাই আমাদের কৃষ্টি। তাই ভাতের উপর চাপ অনেক বেশী। বাড়িতে তিনবেলা ভাত রান্না হয়। শহর-গ্রাম সব জায়গায় প্রতিবেলাতেই ভাত খেতে ডাকা হয়, ভাত খাওয়া হয়। সামান্য তরকারী ও ভরপেট ভাত-ই আমাদের পরম প্রত্যাশা ও চাওয়া। আমরা কেউই খাবার চাই না, ভাত চাই, ভাত কেতে ভালবাসি। তাই ভাতের অভাব মোটেও সহ্য করতে পারি না। ভাতের ক্ষুধা লাগলে অন্য কিছু দিয়ে তা পূরণ হবার নয়। কেউ ভাত কম খেতে বললে তার কোন নিস্তার নেই।
বাস্তব গল্পটা বলি। বহু বছর আগে আমাদের তিন বছর বয়সী মেয়ে জাপানের ‘হইকুয়েন’ বা ডে কেয়ার সেন্টার কাম স্কুলে পড়তো। সে সেখানে জাপানীজ সহপাঠীদের সাথে ষ্টিকি ভাত খেত। এক গ্রীষ্মাবকাশে পরিবার সহ ওকে একটি কনফারেন্সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংগে নিয়ে যাই। পোর্টল্যান্ডে জুলাই মাসে রাত নয়টা বাজলেও সূর্য ডোবে না। হোটেলে নানা পদের আমেরিকান খাবার খাওয়া শেষে ঘুমুতে যাবার পূর্বে সে বলল, এখনও ভাত খাইনি তো। আমি ভাত খাবার পর ঘুমাবো। সে কিছুতেই ভাত না খেয়ে ঘুমাবে না। মুষ্কিল হলো- তখন অনেক রাত, অন্ধকারও নেমে গেছে। পিৎজা, বিস্কুট, জুস কোনটাই ওর মনপুত: হলো না। আমি বললাম, এদেশে তো ভাত নেই। একথা বলার সংগে সংগে সে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। কি আর করা। ওর মা সহ ওকে সাথে নিয়ে নিচের ফুড কর্ণারে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের ষ্টিকি ভাত আছে কি-না। তারা বলল, লম্বা মোটা চালের ওয়াইল্ড রাইস দিতে পারবে। তবে একটু সময় লাগবে। আমরা বললাম ঠিক আছে, সময় লাগুক তবু ভাত রান্না করে দিন। প্রেশার কুকারে ওয়াইল্ড রাইস হতে দেরী হলো না। দুই ডলারে একটি বড় কাগজের কাপ ভর্তি করে ভাত পাওয়া গেল। আমাদের মেয়ে সেটা পেয়েই খুশী। সে সামান্য কিছু খেল, বাকীটা রুমে নিয়ে এলো। পরে যদি আবার খেতে ইচ্ছে করে তাই ফ্রীজে রেখে দেয়া হলো। পরবতী কয়েকদিন সে সেই ভাত খেয়েছিল। হাজার হোক্, ভাত না হলে বাঙালীর কি মন ভরে? আমরা যেখানেই যাই, যে দেশে থাকি না কেন- ভাত খেতে চাই, ভাত খেতে ডাকাডাকি করি, ভাত-ই খাই। ভাত কম খেতে বললে তা মানব কেন? ভাত ফুরালে আমাদের দিন চলবে কী করে?

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top