দুদিনে ২২ পরীক্ষা-হতাশায় চাকুরী প্রার্থীরা
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
বহুদিন দেখা নেই ওদের সাথে। করোনার জন্য নিজ নিজ গ্রামেই ছিল তারা। ক্যাম্পাস খোলার সুবাদে একের পর এক কুশল জিজ্ঞাসা করতে আসছে ওরা আমার অফিসে। তারপর, ওদেরকে-কেমন আছ তোমরা সবাই? বলতেই অনেকের মুখে নানা নতুন কথা শোনা গেল। অনেকে গল্প শুরু করলো অলস সময়ের করণীয় নানা বিষয় নিয়ে। অনেকে আবার একদম চুপ করে অন্যদের কথা শুনছিল। তবে একজন কিছুই বলছিল না, মনভারী করে দাঁড়িয়ে ছিল। স্বভাবতই: আমার নজরটা তার দিকে গেল। ওকে তুমি কেমন ছিলে? জিজ্ঞাসা করতেই করুণ স্বরে উত্তরে জানালো করোনাকালে সে ভাল ছিল না মোটেই, আজও ভাল নেই সে।
ওর কাছে জানা গেল, একদিনে (অক্টোবর ০৮) ১৪টি চাকুরীর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ঘোষিত হয়েছিল। কোনরকমে দুটিতে অংশ নিতে পেরেছে। এসব চাকুরীতে আবেদন করতে গড়ে প্রতি প্রার্থীর আড়াই হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। এতে তার ধার করা দু’হাজার টাকা মার গেছে। ওর কথা শেষ না হতেই অন্যরা একই বিষয়ে কথা বলা শুরু করে দিল। তারা কেউ মাস্টার্স শেষ করে এমফিলে ভর্তি হয়েছে, কেউ মাস্টার্স শেষ করে বসে আছে। কেউবা অনার্স সার্টিফিকেট দিয়ে চাকুরীর আবেদন করেছে। তারা পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করে জেনে গছে, সবাই কোন না কোন বিজ্ঞপ্তিতে নিয়মানুযায়ী চাকুরীর আবেদন করে পরীক্ষা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু প্রায় দু’বছর সবকিছু বন্ধ থাকার পর হঠাৎ হুড়মুড় করে সবকিছু একসাথে শুরু হওয়ায় তারা কোনটাতে কীভাবে অংশ নেবে সেজন্য সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগছে।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার দু’দিনে ২২টি চাকুরীর পরীক্ষার তারিখ ঘোষিত হয়েছিল। এক চাকুরীপ্রার্থী উচ্চশিক্ষিত যুবক আঙুলে গুনে গুনে হিসেব করে দেখাতে লাগলো। সবগুলো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে রাজধানী ঢাকায়। ওরা ঢাকার বাইরের একটি বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে এবং করছে। সবাই মেধাবী। বিসিএস থেকে শুরু করে বড় বড় সব চাকুরীতে ওদের অগ্রজরা আগেকার দিনে সাফল্যের পথ দেখিয়ে ওদেরকে উৎসাহিত করে গেছে। ওরাও খুব আশাবাদী হয়ে চাকুরীতে আবেদন করেছে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় চরম হতাশ ও ক্ষুব্ধ। একজন জানালো- সব পরীক্ষা ঢাকায় গিয়ে দিতে হবে কেন? করোনার ক্রিয়া তো এখনও শেষ হয়নি।
আয়ারল্যান্ডে আবারো লকডাউন দেয়া হয়েছে। সেখানকার বাংলাদেশীরা খুব ভয়ে আছেন। রাশিয়ায় আবারো ব্যাপক সংক্রমণ শুরু হয়েছে। আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু এখনও চলছে। আজ নভেম্বরের চার তারিখেও ৭ জন করোনায় মারা গেছেন। ডেঙ্গু তো এখনও ভয়াবহ। এ অবস্থাতে মানুষ মনে করছে- করোনা বিদায় নিয়েছে। আমরা এখন উন্মুক্ত জীবনে ফিরে গিয়েছি। মাস্ক পরা ছেড়েই দিয়েছে মানুষ। অথচ, করোনার তৃতীয় ঢেউ গোটা ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে আবার জেঁকে বসতে শুরু করছে। টিকা নেবার পরও সংশয় হলো- টিকার কার্যকারীতার মেয়াদ নিয়ে। তাই জার্মানীতে শুদু বৃদ্ধদের কথা বলা হলেও ইউরোপের অন্যান্য দেশে সবাইকে বুষ্টার ডোজ টিকা দেবার কথা ভাবা হচ্ছে। চীনে ছোট ছোট বাচ্চাদের টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। কারণ ওদের স্কুলগামী বাচ্চারা সংক্রমিত হবার পর ওরা খুব উদ্বিগ্ন। অথচ, আমরা সে বিষয়ে মোটেও আগাম কিছু ভাবছি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে নেয়া হলো। অথচ, চাকুরীর পরীক্ষা দেবার জন্য পুনরায় ঢাকামুখী মানুষ ছুটছে গণপরিবহনে গাদাগাদি করে বসে। কেউ যাচ্ছে কক্সবাজার বা টেকনাফ থেকে কেউবা লালমনিরহাটের বুড়িমারী বা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা থেকে। পোশাক শিল্প বা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে লোক নিয়োগের জন্য গ্রামের হাট-বাজারে গিয়েও দালালরা ঘোষণা দিচ্ছে। অনেকে এসব ঘোষণায় পুলকিত হয়ে নতুন জীবিকা লাভের আশায় ছুটছে ঢাকায়। গ্রামে ধানকাটার মওশুম শুরু হয়েছে, অথচ এসময় কৃষিশ্রমিকরা ছুটছে রিক্সা-অটো চালাতে বড় শহরে। এভাবে আবারো আগন্তুক মানুষেরা গিজ গিজ করছে ঢাকা ও বড় শহরগুলোতে।
সামনে আসছে ধুলাবালু মিশ্রিত নির্মাণকাজের শুকনো দিন। শহরে দেশী-বিদেশী মানুষের চলাচল বেড়েছে। অনিয়ন্ত্রিত যাতায়ত ও অসতর্কতায় এসময় বৈশ্বিকভাবে পুণর্জাগরিত করোনার তৃতীয় ঢেউ আমাদের দেশে শুরু হলে আমরা নিজেদেরকে সামলাতে পারবো তো? কারণ টিকা প্রদান বা গ্রহণ সবিশেষ সমাধান নয়, চিরস্থায়ী নিরাপত্তাও নয়। সংক্রমিত জন থেকে নিরাপদ দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখে সতর্ক চলাফেরার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করাটাই হচ্ছে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার মূল উপায়। সম্প্রতি রাশিয়ায় সাপ্তাহিক ছুটিতে সেখানকার জনগণের বেপরোয়াভাবে বিদেশ ভ্রমণ ও মাস্ক না পরার আন্দেলানকে করোনার পুন:সংক্রমণের কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আমাদেরকে এই সতর্কতার বিষয়টি ভুলে গেলে মহাবিপদ ঘটতে দেরী হবে না।
যাহোক, আবারো একজন কথা তুললো, স্যার দু’দিনে ২২টি পরীক্ষার তারিখ হওয়ায় একজন প্রার্থী দিনে দু’শিফট পরীক্ষা দিলেও সর্বমোট চারটির বেশী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। সেটা নির্ভর করবে একটি কেন্দ্র থেকে আরেকটি পরীক্ষা কেন্দ্র কতদূরে এবং ঢাকার ট্রাফিক জ্যামের উপর। যারা বাকী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না সেসব প্রার্থীর আবেদন ফি কি ফেরত দেয়া হবে? প্রশ্ন করলো আরেকজন। অন্যজন বলল, এভাবে অন্যায় উপায়ে টাকা কামাই করার ব্যবসা ফেঁদেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। অনেক প্রতিষ্ঠান চাকুরী দেবার নাম করে পত্রিকায় শুধু শুধু বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করে চলেছে বেকার যুবকদের সংগে। এ ধরনের ঘটনা আগেও সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল। এখন নতুন করে তারা সেই ব্যবসায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। কারণ, এসব ভুয়া চাকুরীর বিজ্ঞাপণ যাচাই করার মত কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান বা কোথাও কেউ কি আছে?
বেকারদের নিয়ে কেউ কি এসব কথা ভাবার অবকাশ মনে করে? একেকটি চাকুরীতে আবেদন করার ফি বা টাকা যোগাড় করার জন্য তাদেরকে কত কষ্ট স্বীকার করতে হয় তা তো শুধু ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করতে পারে, অন্য কেউ নয়। তাও যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় তাহলে কারো জন্য চাকুরী নামক সোনার হরিণ ধরা দেয়- সবার কপালে তা নয়।
করোনা পরবতী পৃথিবীটা সবার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। করোনায় ছাঁটাইকৃতরা সবাই এখনও আগের নিজ কাজ ফিরে পায়নি। নতুন কাজও জোটেনি অনেকের ভাগ্যে। শ্রমিক শেণির লোকেরা অডজব শুরু করলেও আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকাররা এখনও সেটাতে অভ্যস্ত নয়। তাদের জন্য মনমত চাকুরী প্রাপ্তি বেশী জটিল ও কঠিন হয়ে পড়েছে।
তাই হাজারো সমস্যা মাথায় নিয়ে বাবা মা-রা তাদের প্রাণপ্রিয় বায়োলজিক্যাল চাইল্ডদেরকে কিছু অর্থ যোগাড় করে দিয়ে পাঠাচ্ছেন বাড়ির বাইরে, দূরান্তরের পথে। দু’দিনে ২২টা না হোক- অন্তত:চার-পাচঁটি চাকুরীর পরীক্ষা দিতে পেরে যদি কিছু একটা অর্জন করতে পারে। তাঁদের নিকটজন ও সন্তানরা ছুটছে ঢাকায়, কিছু পাবার আশায়, কিছু করার আশায়। যেখানে তাদের সবার মামা-চাচার বাড়ি নেই, থাকা-খাওয়ার জায়গা নেই। নেই যাত্রাপথের নিরাপত্তা, আছে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও আরো নানা ভয়। আমরা যতটুকু জানি টিউশনী করে বা ধার-দেনা করে অধিকাংশ চাকুরীপ্রার্থীরা এই যুদ্ধে অংশ নেয়। তাই এসব বেকারদের যে কোন চাকুরীর আবেদন ফি ৫০ টাকার বেশী করা উচিত নয়। অথবা বিনা ফিতে চাকুরীতে আবেদনপত্র জমা নেয়ার জন্য সরকার এক মহতী ঘোষণার উদ্যোগ নিতে পারে। তাহলে একশ্রেণির জালিয়াত ও কুচক্রীমহলের চাকুরীর ভূয়া বিজ্ঞপ্তি দৈনিক পত্রিকায়, অনলাইনে দিয়ে বেকারদের সাথে প্রতারণা করা বন্ধ হবে।
চারদিকে নানা সমস্যা তবুও একটি নতুন জীবনের হাতছানিতে তারা যেন বেঁচে থাকার জন্য ভাল কিছুর সন্ধান পায় -ভাগ্য যেন সবাইকে সহায়তা করে এছাড়া আমরা শিক্ষকরা আমাদের ব্রেনচাইল্ডদের নিকট থেকে আর বেশী কিছু প্রত্যাশা করার জন্য নতুন করে কি করতে পারি? তবে মনে হলো- ওরা আমার সাথে দীর্ঘদিন পর অনেক জমানো কথা শেয়ার করতে পরে এক বুক আশা ভরা মনে নিজেদেরকে বেশ সতেজ করে নিয়ে নিজ নিজ ডেরায় ফিরে গেল।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd
সাম্প্রতিক মন্তব্য