logo
news image

মিসদাহে হত্যা ও পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
লিবিয়ার মিসদাহ শহরে ২৬ বাংলাদেশী হত্যা আবারো আমাদের দেশের অবৈধ মানব পাচারের ভয়াবহ দিকটি উন্মোচিত করেছে। দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ভারত, মিশর ও লিবিয়া হয়ে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাবার পথে তারা লিবীয় মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে মুক্তিপণের জন্য জিম্মি হয়ে পড়ে। দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা এনে এসব মুক্তিপণ মেটানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। সময়মত মুক্তিপণ না পেয়ে আরো কিছু বিদেশীদের সাথে বাংলাদেশী যুবকদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর লিবীয় সরকারী কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসীদের ওপর এক ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যাকারীদের নেতা খালেদ মিসাইকে মেরে ফেলেছে।
মিসদাহ ট্রাজেডীতে তরতাজা বাংলাদেশী যুবকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করাটা শুধু ওদের স্বপ্নভঙ্গ করেছে বললে ভুল হবে- ভেঙ্গে দিয়েছে বাংলাদেশের উঠতি ইমেজকে।
বিশ্ব গণমাধ্যম মনে করা শুরু করেছিল আমাদের দেশে অভাব, বেকারত্ব বুঝি শেষ হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা জানান দিয়েছে আমাদের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস পোশাক শিল্পকে ছাপিয়ে, যাঁদের প্রেরিত কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ প্রতিদিন দেশের অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে তারা আসলে কারা। অবৈধ পথে বহু কষ্টে বিদেশে পাড়ি জমানো এসব শ্রমিকরাই আমাদের দেশে তাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করলেও করোনাকালে এরাই সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় আক্রান্ত হয়ে বিদেশের বুকে বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরে হাজার হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকায় আরো হাজার হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক আক্রান্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশের তুলনায় বিদেশের মাটিতে বেশী বাংলাদেশী করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এরপরও থেমে নেই অবৈধ পথে বিদেশ যাত্রা। এদের কাছে বিদেশ যেন সোনার হরিণ, যেন স্বর্গরাজ্য।
কিছুদিন পূর্বে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে অনেকগুলো তাজা প্রাণ আত্মাহুতি দিয়েছিল। সেই কষ্টের দাগ না মুছতে আবারো ওদের করুণ মৃত্যু বুঝিয়ে দিলো আমাদের অন্ত:সারশুণ্যতা। আমাদের দেশে চারদিকে এত উন্নয়ন, এত কাজ, তবে কেন উঠতি যুবকরা দেশ ছেড়ে মরুপথে, মরণ সাগরের মাঝে ঝাঁপ দিতে দ্বিধা করে না? কিসের অভাব আমাদের এই সুন্দ্র মাতৃভূমিতে?  সুজলা, সুফলা, ধানের দেশ, গানের দেশ ছেড়ে কেন আবারো অবৈধ পথে মরণ যাত্রা? এ যাত্রার কি শেষ নেই? আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে মানুষের অভিবাসী হবার কোন তত্ত্বই যেন আমাদের সীমান্ত পথে কার্যকর নয়।
তা না হলে হাজার হাজার তরুণ কোন অবৈধ প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বের হয়ে যায়? কাদের দ্বারা পরিচালিত এই স্বার্থান্বেষী চক্র? এরা গরীব পরিবারের সন্তান হয়েও ভিটেমাটি বিক্রি করে কেউ কেউ ৮-১০ লক্ষ টাকা খরচ করে বিদেশে সোনার হরিণের আশায় পাড়ি জমায় কাদের প্ররোচনায়?  মানবপাচারকারীরা একাজে কমিশনের বিনিময়ে অনেক দালাল নিয়োগ করে। দালালরা দেশের নতুন নতুন গ্রামে-গঞ্জে ঘুরঘুর করে নিরীহ যুবকদের প্ররোচিত করে, ইউরোপ যাবার স্বপ্ন দেখায়। অনেক সময় এদের সিংহভাগ প্রতারিত হয়ে বিদেশে যেতে পারে না। দালালরা টাকা মেরে দেয়। এই টাকা উদ্ধারের জন্য ২০১২ সালের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের অধীনে প্রতিবছর অসংখ্য মামলা করা হয়ে থাকে। মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় হাজার হাজার মামলা করা হলেও সেগুলো নিষ্পত্তি না হয়ে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে।
এক তথ্যে জানা গেছে, গত আট বছরে ২০১২ সালের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের অধীনে দেশে ৫,৭১৬টি মামলারুজু করা হয়েছিল। তার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৪৭টি। এখনও ৪, ৪০৭টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অনেক মামলায় বার বার তারিখ পড়ে। শুধু তেজগাঁও থানায় ২০০৫ সালের একটি মামলায় সাক্ষী হাজির থাকার তারিখ পড়েছিল ৪৫ বার ও ক্যান্টনমেন্ট থানায় ২০০২ সালের একটি মামলায় তারিখ পড়েছিল ৫৬ বার।  এভাবে উক্ত মামলাগুলোর নিষ্পত্তির হার খুবই কম বলে জানা গেছে। ফলে ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ শেষ হচ্ছে না।
বলা হয়, কৃষিতে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, খাদ্যে স্বয়ম্ভর। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর আমাদের মন। অনেক না পাওয়ার বেদনা থাকলেও আমরা বিশ্বের সুখী জাতি। চারদিকে আমাদের প্রচারণাও সরব। তবে এতগুলো মানুষের ঘরে খাবার নেই, এত মানুষ বস্তিবাসী, ভুমিহীন, হতদরিদ্র কেন? ওদের হতাশার শেষ নেই, মনে শান্তি কেন নেই? তবে কি এগুলো মেকী প্রচারণা? বিশ্ব গণমাধ্যমে যখন দেখানো হয় বাংলাদেশের মানুষ দেশ থেকে পালিয়ে অবৈধ পথে নানা দেশ, নানা সাগর-মরুপথ দলন করে পথেই লাশ হতে দ্বিধা করে না তখন আবারো খুলে যায় আমাদের মুখোশ। লিবিয়ার মিসদাহে অবৈধ মানব পাচারকারীদের নৃশংস গুলিতে আমাদের তরতাজা যুবকদের মৃত্যুতে  স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যাওয়াটা আমাদের ধানের দেশ গানের দেশের ঐতিহ্যকে ধুলোয় মিশিয়ে একাকার করে আবারো লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে যারা বিদেশে বসে টিভিতে এসব সংবাদ দেখছে- লজ্জা ও ঘৃণায় তাদের মনটা বিষিয়ে উঠছে।
এভাবে আর কতদিন? মিসদাহ হত্যাকান্ডের শিকার সিলেটের বিশ্বনাথের জনৈক রেজওয়ানের ভাই হাউমাউ করে বলে উঠেছেন- ‘আমরা জান-মাল সব হারালাম, ভাইয়ের লাশটাও নাকি ফেরত পাব না’! এরকম শত শত পরিবারে ক’দিন পর পর কান্নার রোল ডুকরে উঠে, গুমরে গুমরে একদিন সেই কান্নার সুর ক্ষীণ হয়ে বাতাসে মিশে যায়। অথচ বড় শহরগুলোতে এমনকি কোন কোন গ্রামাঞ্চলেও মানব পাচারকারীদের সুদৃশ্য অট্টালিকা গড়ে ওঠে, বিএমডব্লিউ-ল্যান্ডরোভার, সদর্পে রাজপথ দাপিয়ে বেড়ায় এরা। ওদের সখ্য জমে বড় বড় মানুষদের সাথে, বড় ক্লাবে, ওদের প্রাণের মিতালী হয় হোমরা-চোমড়াদের সাথে। ওদের বালাখানায় বসে ভাগবাটোয়ারা হয়ে যায় ভূমধ্যসাগরের তীরে অথবা নীল ঢেউয়ে মিশে যাওয়া দেশান্তরী হতাশ যুবকদের মৃতদেহ সদৃশ ভিটেমাটি বিক্রি করা টাকার। করুণ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকে এই মহাকাল। তা না হলে বিভিন্ন সময়ে এত এ্যকশান নেয়ার পরও কুলঙ্গার গডফাদাররা কিছুদিন বাদে আবার স্বরুপে ফিরে কাদের কৃপায়? এগুলো আমাদের বঞ্চিত, অসহায় মানুষের ভাগ্যের পরিহাস হিসেবে চিরকাল গণ্য হয়ে এসেছে। তাই এগুলো কোন বিবেকবান মানুষের একার ভাবার বিষয় নয়।
সম্প্রতি পরিসংখ্যানসহ জানা গেছে বাংলাদেশের মোট ১১ জেলায় অবৈধ মানব পাচারকারীদের নৃশংস কর্মকান্ড সচল রয়েছে। ওদের পালের গোদারা মাঝে মাঝে ধরা পড়ে মিডিয়ায় চেহারা দেখান। কিছুদিন হৈ-চৈ চলে। তারপর কী হয় জানিনা- আবার সেই ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবি, বেনগাজী বা মিসদাহে গুলি অথবা জাভা বা মালয় সাগরে ভাসে শত শত অবৈধ অভিবাসী নিয়ে অবৈধ নৌকা।
বার বার এসব তরতাজা যুবকরা দেশান্তরী হয়ে যায় কোন অবৈধ পথে, কোন ধরনের অবৈধ পন্থায় তা এখন ওপেন সিক্রেট। এয়ারপোর্ট, সমুদ্র বন্দর অথবা স্থলসীমান্তের পাহারাদরদেরকে তারা ফাঁকি দেয় কীভাবে? ওনাদেরকে কি চুরি-জালিয়াতি করতে কাজ লাগানো হয়েছে? ওনাদের কি চক্ষুলজ্জা নেই, তাদের মাঝে কেউ কি ভাল মানুষ নেই?  নৈতিকতার বালাই নেই? এখন ওইসকল ভদ্রলোকদেরকে চিহ্নিত করে আইনের হাতে সোপর্দ করার মোক্ষম সময়।
দালাল ব্যবসায়ী ও চাটুকার আমলাদের উপর নির্ভরশীল না থেকে একাজে কিছুটা সৎ রাজনৈতিক, প্রতিশ্রুতিশীল ও কর্তৃত্ববাদী নীতির প্রতিফলন আশু প্রয়োজন। তা না হলে অবৈধ পথে মানব পাচারের মত লাভজনক ব্যবসা কখনই বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এরপরও যারা তরতাজা নিরীহ যুবকদের অবৈধ পথে বিদেশে পাঠানার কাজে সহযোগিতা করতে থাকবে তাদেরকে চিহিুত করতে হবে। তাদেরকে ঢাকা এসসিসি-র মত দালাল ও ঘুষখোর শনাক্তকারী টিম গঠন করে একদিনে ১১ জনকে চাকুরীচ্যুত করার মত পরিবেশ তৈরী করে ফেলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুন সৎ ও প্রতিভাবান  চাকুরীপ্রার্থীদেরকে সে সকল জায়গায় নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। আশা করছি, এতে দেশে-বিদেশে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অবৈধভাবে বিদেশের মোহে দেশ ছেড়ে ভুল পথে পাড়ি জমানোর সুযোগ পাবে না এবং আমাদের দু:খী পরিবারগুলোর কান্না থামবে ও দেশের মান-ইজ্জত রক্ষা পাবে।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top