দুই দশক ধরে অচল শাকসু
শাবি প্রতিনিধি
প্রায় দুই দশক ধরে বন্ধ রয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (শাকসু) নির্বাচন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের এই প্ল্যাটফর্মকে স্বক্রিয় করার পাশাপাশি নতুন নেতৃত্ব গঠনের পথ সুগম করার দাবি তুলেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের পর শাকসু নির্বাচনের দাবি আরও জোরালো হয়েছে। দাবি আদায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণাসহ ক্যাম্পাসে মিছিল-সমাবেশও করেছেন শিক্ষার্থীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছেন বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরাও। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাকসু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে ক্যাম্পাসে সব ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করা, সময়োপযোগী গঠনতন্ত্র ও নির্বাচনি বিধি-আচরণবিধি প্রণয়নসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে।
শাকসুর পথচলা
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এবং নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯১ সালে শাকসুর পথচলা শুরু। শাকসুর গঠনতন্ত্রের ৩নং ধারার (অ) এবং (আ) উপধারা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবেন ছাত্র সংসদের সভাপতি এবং উপাচার্য কর্তৃক মনোনীত একজন শিক্ষক হবেন সংসদের কোষাধ্যক্ষ। গঠনতন্ত্রের ৩নং ধারার (ই) উপধারা অনুযায়ী সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সর্বমোট ১৯ জন ছাত্র প্রতিনিধি শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন।
নথিতে উল্লেখ আছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে সর্বমোট পাঁচবার শাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯১ সালে তিনটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে শাবি। তিনটি বিভাগের ক্লাস প্রতিনিধিদের মনোনীত করার মধ্য দিয়ে শাকসু যাত্রা শুরু করে। পরের বছর শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভোটে শাকসুর প্রথম সাধারণ সম্পাদক (জিএস) হিসেবে নির্বাচিত হন অর্থনীতি বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হারুন উর রশিদ। তবে এ সংসদের কোনও ভিপি ছিল না। ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচনে একইসঙ্গে সহ-সভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পান শাবি শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের ভোটে ভিপি হন নির্বাচিত আব্দুস সালাম ও জিএস হন সাব্বির আহমেদ। এরপর ১৯৯৪ সালের ২৩ জুনের নির্বাচনে ভিপি হন দেলোয়ার ইসমাইল টিটু ও জিএস হন কামরুল ইসলাম। পরে ১৯৯৫ সালে আশরাফুল আলম রুবন ভিপি ও বদরুজ্জোহা শাহিন জিএস পদে জয় পান।
১৯৯৬ সালে পঞ্চম নির্বাচন নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় তা আর অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে ১৯৯৭ সালের ২৫ আগস্ট সর্বশেষ শাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভিপি হিসেবে কামরুল আহমেদ কাবেরী ও জিএস পদে আব্দুল্লাহ আল মামুন জয় পান। নির্বাচনে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল ১৯টি পদের মধ্যে ১৭টিতে জয় পায়। এরপর আর গত ২২ বছরে শাকসুর কোনও নির্বাচন হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সময়ের সরকার ও সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর অনিহার কারণেই শাকসু সচল হয়নি। নিজেদের আধিপত্য খর্ব হওয়ার ভয়ে নির্বাচন চায়নি ছাত্র সংগঠনগুলো।
শাকসু না থাকলেও বেড়েছে ফি
এদিকে শাকসুর কোনও কার্যক্রম না থাকলেও প্রতি সেমিস্টারে ইউনিয়ন ফি দিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দফতর সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে নির্ধারিত শাকসুর জন্য ইউনিয়ন ফি ছিল ৩৭ টাকা। তবে বিগত দুই দশকে ৮ দফায় বাড়িয়ে ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীদের জন্য তা ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন, দুই দশকে শাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলেও প্রতি সেমিস্টারে নেওয়া এই অর্থ কোন কাজে ব্যয় করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ?
এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক ড. রাশেদ তালুকদার বলেন,‘ইউনিয়ন ফি বাবদ যে অর্থ নেওয়া হয় তার জন্য আলাদা তহবিল গঠন করা আছে। সেই তহবিল থেকে বিভিন্ন দিবস পালনে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্থ ব্যয় করা হয়। এছাড়া এই তহবিল থেকে শিক্ষার্থীদের কল্যাণেও অর্থ ব্যয় করা হয়ে থাকে।’
শাকসুর নেই নিজস্ব ভবন
তিনটি বিভাগ নিয়ে শুরু হওয়া শাবিতে বর্তমানে ২৮টি বিভাগ রয়েছে। বিভাগগুলোতে শিক্ষার্থী রয়েছেন প্রায় ১০ হাজারের মতো। তবু শাকসু সচলের কোনও উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শাকসুর কোনও আলাদা ভবন বা কার্যালয়ও স্থাপন করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন টিচার্স ক্যান্টিনের পাশের একটি অপরিসর একচালা কক্ষ শাকসুর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হতো। দীর্ঘদিন কমিটি না থাকায় তাও পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী শাকসু কার্যালয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানেনই না।
শাকসু চালুর বিষয়ে যা বলছেন সাবেক নেতারা
শাকসুকে সচলের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের পথ সুগম করার দাবি তুলেছেন এর সাবেক নেতারা। শাকসুর প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক জিএম হারুন অর রশিদ বলেন,‘আমাদের সময় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত কোনও দাবি নিয়ে ভিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি তা পূরণ করতেন। দলমত নির্বিশেষে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পূরণে শাকসু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসী হলেও শিক্ষার্থীদের ইস্যুতে আমরা সবাই এক থাকতাম। তখন লেজুড়ভিত্তিক কোনও রাজনীতি ছিল না।’
সাবেক জিএস কামরুল ইসলাম বলেন,‘আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারতাম। তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে কথা বলতাম। এখন সেই চর্চার সুযোগ নেই। যে কারণে শিক্ষার্থীবান্ধব নতুন নেতৃত্বও উঠে আসছে না। দেশের স্বার্থে দ্রুত শাকসুকে সচল করার প্রয়োজন।’
শাকসুর সর্বশেষ ভিপি কামরুল আহমেদ কাবেরী বলেন, ‘বর্তমানে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলা মানুষের বড়ই অভাব। আমরা চাই শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের শাকসু নির্বাচনের আয়োজন করা উচিত।’
শাকসু নিয়ে সংগঠনগুলোর ভাবনা
শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে শাকসুকে সচল করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ক্যাম্পাসের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো। তবে শাকসু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে ক্যাম্পাসে সব ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত, সময়োপযোগী গঠনতন্ত্র ও নির্বাচনি বিধি-আচরণবিধি প্রণয়নসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। এগুলো নিশ্চিত হলে নির্বাচন আয়োজন সহজ ও বিতর্কমুক্ত হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
শাবি শাখা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শাকসু নির্বাচনের আয়োজন করলে আমরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্দেশনা মেনে নির্বাচনে সহযোগিতার পাশাপাশি অংশগ্রহণ করবো।’ তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচন আয়োজন বিষয়ে কোনও কথা হয়নি বলে জানান তিনি।
শাবি শাখা ছাত্রদলের সভাপতি এম এ রাকিব বলেন, ‘আমরাও চাই সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও সচল হোক শাকসু। তবে নির্বাচনের আগে ক্যাম্পাসের পরিবেশ, ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো নিশ্চিত হলেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।’
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের আহ্বায়ক প্রসেনজিৎ রুদ্র বলেন,‘শাকসু নির্বাচনের আগে কিছু প্রস্তুতি আছে। যেমন-ডাটাবেজ তৈরি, তথ্য হালনাগাদ, কারা প্রার্থী হতে পারবে, কারা ভোট দিতে পারবে, ভোট কেন্দ্র কোথায় হবে ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে কাজ করতে হবে। আমরা নির্বাচন আয়োজনে শিগগিরই উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেবো। এছাড়া মিছিল-সমাবেশ, তথ্যচিত্র প্রদর্শনীসহ বিভিন্নভাবে শাকসু নির্বাচন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক সোহানুর রহমান জানান,‘শাকসু নির্বাচন নিয়ে জোটের মিটিংয়ে এখনও কোনও আলাপ হয়নি। তবে শিগগিরই শাকসু বিষয়ে আমাদের বসার কথা রয়েছে।’ শাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন,‘আমরা জোটের পক্ষ থেকে শাকসু নির্বাচন চাই।’
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা শাকসুকে সচলের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষকরাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৯৯২-৯৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও বর্তমানে বিভাগটির প্রধান অধ্যাপক ড. এম জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শাকসুর কাজ দেখেছি। শিক্ষার্থী সংখ্যা কম থাকলেও সে সময় শাকসুর মাধ্যমে দাবি আদায় করা হয়েছে। আমি মনে করি, শিক্ষার্থীদের নৈতিক দাবি আদায় ও দেশ পরিচালনায় যোগ্য নেতৃত্ব তৈরিতে ছাত্র সংসদ অপরিহার্য।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এস এম সাইফুল ইসলাম বলেন,‘আমরা শিগগিরই শাকসু নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হোক, শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার প্ল্যাটফর্ম থাকুক, হোক মুক্ত চিন্তা ও বুদ্ধির চর্চা। আর এসব নিশ্চিতে শাকসুকে দ্রুত সচল করা প্রয়োজন।’
শাকসু সচলের বিষয়ে আশার বাণী শুনিয়েছেন শাকসুর সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন,‘শাকসু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে আমরা ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় খুব বেশি বড় না। তাই নির্বাচন আয়োজনে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না বলে মনে করছি।’
তবে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এখনও আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়নি বলে জানান তিনি। উপাচার্য বলেন,‘আমরা শিগগিরই শাকসু নির্বাচন নিয়ে বসবো। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হবে। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গেও কথা বলে অচিরেই নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
সাম্প্রতিক মন্তব্য