হার্ড-ইমউনিটি ও নাই হলো মা বসন-ভূষণ
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
খুশীর ঈদ সমাগত। এ ঈদের প্রধান আকর্ষণ নতুন জামা-কাপড়, পাঞ্জাবী, নাগরা, জুতো, আতর-খুশবু আরো কত কি! সারা বছর ধর্মপ্রাণ মুসলিম ন-নারী অপেক্ষা করেন পবিত্র রমজানের শেষে খুশীর বারতা নিয়ে হাজির হবে পবিত্র ঈদুল ফিতর। খুশীর চোটে ঈদের চাঁদ রাতে ছোটদের নিদ আসে না। আরো বড় কথা- কাপড় ব্যবসায়ীগণ চাঁদ রাতের জন্য অপেক্ষা করেন। ক্রেতা ভীড় করবে, চাঁদ দেখার সাথে সাথে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়বে দোকানে। দাম যাই হাঁকা হোক না কেন, সময় তো নেই দরকষাকষি করার। সে এক অপার অনুভূতি। মধ্যরাত অবধি বেচা-কেনা শেষে বেচে যাওয়া কাপড় থেকে নিজের জন্য একটা নিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরা। লাভ-লোকসানের হিসেবটা আর আজ রাতে কষা নয়। ঈদের নামাজ শেষে সেমাই খেয়ে কোন এক সময় করা হবে। এই তো ব্যবসায়ীগণের ফি বছরের প্রত্যাশা।
এবার কিন্তু বাধ সেধেছে করোনার কঠিন সমষ্টি সংক্রমণের ভয়। পনেরো রোজা পার হলেও দোকান খোলা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেতিবাচক বলে জানানো হয়েছে। এবার কোথাও মার্কেট খোলা রাখা হবে না। এটা দোকান মালিক সমিতির সিদ্ধান্ত। সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ফুটপাতেও হকারদেরকে বসতে দেয়া হবে না।
ঈদের আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকী। এ কয়দিনের জন্য দোকান খুলে লাভের মুখ দেখা কঠিন হবে। অধিকন্তু দোকান খোলা রাখার জন্য আরোপিত শর্ত মেনে বেচা-কেনা করা কঠিন কাজ। ঈদের বাজার মানেই ঠাসাঠাসি করা মানুষ। গায়ে-গায়ে ধাক্কা, হাতে-পায়ে ঠেলাঠেলি, মুখে মুখে চিল্লাচিল্লি করে দরকষাকষির মাধ্যমে কেনাকাটা করার রেওয়াজ রয়েছে আমাদের দেশের মার্কেটগুলোতে। আর এগুলো করোনা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য উপযুক্ত মাধ্যম। তাই দোকানদারদেরও ভয়। অচেনা, অজানা রোগী কখন দোকানে ঢুকে সংক্রমণ ছড়িয়ে একাকার করে যাবে তা তো বুঝা যাবে না। এভাবে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই সংক্রমিত হয়ে জীবন নাশের ভয় রয়েছে। মালিক সমিতির একজনের সাক্ষাৎকারে শুনলাম, এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে দোকান খুলে জীবনপাত করবো নাকি? আগে জীবন, পরে অর্থ। জীবন নিয়ে বেঁচে থাকলে পরে অনেক আয় করতে পারবো।
কথাটা একদম খাঁটি। একজন ক্রেতা কোন দোকানে ঢুকে একটি শাড়ি বা জামা বা অন্য কোন সৌখিন ঈদপণ্য অনেকবার নেড়েচেড়ে দেখার পর পছন্দ না হলে করে অন্য দোকানে চলে যান। ক্রেতারা সারাদিন ঘুরে ফিরে শত শত দোকানে পছন্দের জিনিষ খুজে ফেরেন হণ্যে হয়ে। পছন্দের সাথে দামের মিল না হলে কেনা-কাটা সম্পন্ন হয় না। এভাবে একজন করোনা রোগী-যিনি নিজে জ্ঞাত নন, আক্রান্ত কিনা যদি ১০টি দোকানে কাপড়-পণ্য নেড়েচেড়ে আসেন এবং সেগুলো যদি সুস্থ ক্রেতারাও নেড়েচেড়ে দেখতে থাকেন এবং যদি সারা দিন-রাত এভাবে স্পর্শ করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে তাহলে তা হবে অতি ভয়ংকর বিষয়।
এমনিতেই সামনের দিনুগলোতে দেশে সর্বচ্চো (পিক) সংক্রমণ শুরুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অথিদপ্তরের মহাপরিচালক জনাব আবুল কালাম আজাদ বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে দেশে দৈনিক ৬৫,০০০ মানুষ করোনায় সংক্রমিত হতে পারে। এই ভয়ংকর তথ্য আজ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। দৈনিক এত বেশী সংক্রমণ! তাহলে একমাসে কত হবে? এদের ১০ ভাগ রোগীকে যদি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় এবং অক্স্রিজেন ও ভেন্টিলেটর সুবিধা দিতে হয় তাহলে সেই ব্যবস্থ াকি আমাদের আছে? যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশ যেখানে অবহেলার খেসারত দিতে হিমশিম খেয়ে আবোল-তাবোল বলে মৃতের সংখ্যা সামাল দিতে অপারগ হচ্ছে সেখানে আমাদের দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামো তাসের ঘরের মত উড়ে যেতে পারে। আমরা কামনা করি সেই ধরনের মুছিবত যেন আমাদের দেশে না হয়।
পৃথিবীর সকল দেশ, যাদের সংক্রমণ দশ হাজারে ওঠেছে তারা সাথে সাথে সতর্ক হয়ে লকডাউন বিষয়ে আরো কঠোর হয়েছে, আর আমরা সংক্রমণ দশ হাজার ছাড়ানোর পরদিন থেকে লকডাউন শিথিল করেছি। করোনা অভিজাত বা বনেদী রোগ। দাওয়াত না দিলে এমনিতেই কারো বাড়িতে করোনা বেড়াতে আসে না। আমরা লকডাউন শিথিল করে দৈহিক ঘেঁষাঘেষি ও পারস্পরিক দূরত্ব কমিয়ে শ্রমিক শ্রেণিকে তথা গোটা জাতিকে ভয়াবহ সংক্রমণের দিকে ঠেলে দিয়েছি। অনেক বিশেষজ্ঞ এটাকে মহামারী থিওরীর হার্ড ইমিউনিটি বা করোনা রোগের হার্ড ইমিউনিটির কথা বলে বলে সান্তনার বাণী দিচ্ছেন, যা নিতান্তই অমানবিক।
কারণ, হার্ড ইমিউনিটি কোন ভাল সমাধান নয়। এটা কাপুরুষের মতো কথা। এর অর্থ, কোন মহামারীতে কোন জায়গা বা দেশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষকে আক্রান্ত হবার জন্য মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া। আক্রান্ত হবার পর ভিকটিমদেরকে টিকা দিয়ে অথবা প্রাকৃতিকভাবে মহামারী শেষ না হওয়া পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে এ্ই ধরণের গণ ইমিউনিটি যাচাই করা হয়। আমরা জানি, হার্ড ইমউনিটির সোজা বাংলা অর্থ হলো- “মইরা টইরা যা বাকী থাকে।” কেউ কি ক্ষমতা থাকতে বলে -মড়ক লেগে মরে সাফ হয়ে যে কয়টা বাকী থাকে থাকুক’। একজন সভ্য, জ্ঞানী, সাহসী লড়াকু মানুষ হার্ড ইমউনিটির মাধ্যমে এভাবে মানুষকে গিনিপিগ বানাতে দিতে পারেন না। অথচ, আমরা পোষাক কারখানা খোলা রেখে সেই দিকে অগ্রসর হয়েছি। আমরা একদিকে বলছি-ঘরে থাকুন নিরাপদে থাকুন। অন্যদিকে ডাকছি-ঢাকায় আসুন কারখানায় কাজ করুন। এই ধরনের স্ববিরোধিতা ও বৈপরীত্য চালাকি করে বলা হলেও অদৃশ্য করোনা তা কাউকে ক্ষমা করবে না। কারণ, আমরা জানি- পাপ কারো বাপকেও ছাড়ে না।
হার্ড ইমউনিটির আরেকটি সহজ অর্থ হলো- ‘ইউজেনিকস্’ বা শুধু শক্তিশালীরাই বেঁচে থাকবে। এত সামাজিক বৈষম্য আরা বেশী তরান্বিত হয়। সবাই যখন অতি ধনী হয়ে যায় তখন সবাই একইসংগে অতি গরীব হয়ে যাবারও ঝুঁকি থেকে যায়। অসম প্রতিযোগিতা, যুদ্ধবিগ্রহ ও করোনা সংক্রমণের কারণ খুঁজে না পাবার মত ঘটনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। যা বিশ^যুদ্ধ ও বিশ^মহামারীর মাধ্যমে মহামন্দা ও মহামৃত্যূর ডাক দিতে কুন্ঠিত হবে না।
তাই আর মন খারাপ নয়। এবার নতুন কাপড় ছাড়াই ঈদ হোক। এর জন্য পুরোনোটা ধুয়ে পবিত্র করে রাখি। দোয়া করি যেন সেটা পরেই যেন ঈদগাহে যাবার মত প্রতিবছরের ন্যায় এবারো ইতিবাচক পরিবেশ বজায় থাকে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মত সব কষ্ট ছাপিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে- ”নাই হলো মা বসন-ভূষণ এই ঈদে আমার, আল্লাহ আমার মাথার মুকুট, রাসুল গলার হার।” মার্কেট বন্ধ রাখার জন্য সমিতির কর্তাগণকে ধন্যবাদ জানাই। ওনাদের মত ভাবতে চাই- আগে জীবন, পরে অর্থ। জীবন নিয়ে বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে মহান আল্লাহ অনেক ভাল জীবিকা ও বেশী অর্থ উপার্জন করার সুযোগ দান করতে পারেন।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য