বাগাতিপাড়ায় শাঁখা ব্যবসায় ধ্বংস। আর্থিক সংকটে শাঁখা শিল্পীরা
মামুনুর রশিদ মাহাতাব
নাটোরের বাগাতিপাড়ায় দীর্ঘ মেয়াদি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে শাঁখা শিল্প ব্যবসায় ধ্বংস নেমেছে। শাঁখা পল্লীর তৈরি সামগ্রী বিক্রি না হওয়ায় ব্যবসায়িরা ও শিল্পিরা আর্থিক সংকটে ভুগছেন। বিভিন্ন এনজিও-র ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন অনেকে।
নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলায় জামনগর ইউনিয়ন সবুজ বৃক্ষরাজির সুশীতল ছাঁয়ায় ঘেরা। এ ইউনিয়নটি অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে হিন্দু, মুসলিম ও
খৃষ্টানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন নানা কর্মে ব্যস্থ। এখানে রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী শাঁখাশিল্প।
সবুজ বৃক্ষরাজির সুশীতল ছাঁয়ায় ঘেরা জামনগর শাঁখাপল্লী। জামনগর বাজার সংলগ্ন জামনগর ডিগ্রি কলেজের পাশে এর অবস্থান। এ পল্লীর শতাধিক পরিবার পৈত্রিক ব্যবসা শাঁখা শিল্পের সাথে জড়িত। এরা বণিক সম্প্রদায়। সারা বছর শাঁখা ব্যবসায়ি ও কারিগরদের স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চলতো। কিন্তু গতবছর থেকে বাধ সেঁধেছে করোনা ভাইরাস।
দীর্ঘমেয়াদি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ঘন ঘন লকডাউনে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় তাঁরা চরম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। এ ভাইরাসের কারণে তৈরি শাঁখা সামগ্রী বিক্রি না হওয়ায় আর্থিক সংকটে ভুগছে ব্যবসায়ি ও কারিগররা।
শ্ঙ্খ শাঁমুক প্রজাতি। শঙ্খ বা শাঁখা জন্মে সমুদ্রের তলদেশে। বাংলাদেশে ভারত ও শ্রীলংকা থেকে শঙ্খ আমদানি করা হয়। বর্তমান করোনার দাপট আমদানিতে
বাধ সেঁজেছে।
এ শাঁখা পল্লীর পুরুষ শিল্পীরা আমদানিকৃত শঙ্খ মেশিনে কেটে বালা ও আংটিসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে। পরে নারী-পুরুষ শিল্পীরা নিপুণ হাতে এগুলোর উপর কারুকার্য করেন।
সোনাতন ধর্মালম্বীরা শঙ্খ/শাঁখা সামগ্রী বেশি ব্যবহার করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বধবা নারীরা শাঁখার বালা ব্যবহার করেন। হিন্দু নারীর বিয়ে সম্পন্নকরণের সময় গৌরিপুজা শেষে বণিক সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি বা ঠাকুর কন্যার হাতে শাঁখার বালা পরিয়ে দেন।
স্বধবা নারীরা স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত শাঁখার বালা ব্যবহার করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর লাশ শ্মশানে দাহের পূর্ব মুহূর্তে হাতে পরা শাঁখার বালা ভেঙ্গে ফেলে দেয় এবং সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলে।
অপরদিকে সোনাতন ধর্মালম্বীরা শঙ্খ ফুঁকিয়ে সুমধুর সুর সৃষ্টির মাধ্যমে পুজা-পার্বণের কার্যক্রম শুরু করেন। এছাড়া পল্লী'র সব সম্প্রদায়ের অসংখ্য নব বঁধু ও কিশোরী মুখের দাগ দূরিকরণে শাঁখার গুড়ো কচি ডাবের পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া কসমেটিকস তৈরিতে শাঁখার গুড়ো ব্যবহার হয়ে থাকে।
শাঁখা ব্যবসায়ি কালিপদ চন্দ্র সহ কয়েজন ব্যবসায়ি জানান, বর্তমান শাঁখা ব্যবসা অত্যন্ত মন্দা। দীর্ঘ মেয়াদি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ঘন ঘন লকডাউনে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। লাখ লাখ টাকা মূল্যমানের তৈরি শাঁখা সামগ্রী বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। এ পল্লীর সবাই আর্থিক সংকটে ভুগছেন।
কারিগর দম্পতি অদৌত কুমার সেন (৩৮) ও স্মৃতি রানী সেন(৩২) জানান, তাঁরা বংশানুক্রমে শাঁখা শিল্পের সাথে সংপৃক্ত। শাঁখা সামগ্রী তৈরি ও কারুকার্য করেন। প্রতিজোড়া শাঁখার বালা কারুকার্যে মজুরি পান দশ টাকা। তাঁরা প্রতিদিন পঞ্চাশ থেকে ষাট জোড়া বালার উপর কারুকার্য করেন। প্রতিদিনের আয় পাঁচশত টাকা থেকে ছয়শত টাকা। এগারো বছর বয়সি ষষ্ট শ্রেণিতে পড়া মেয়ে পায়েল রানী সেনকে নিয়ে তাঁদের স্বচ্ছল সংসার। কিন্তু বাধ সেঁধেছে কোরোনা ভাইরাস। বিশ্বব্যাপি করোনা ভাইরাসের কারণে দেশে বার বার লকডাউনের ফলে শাঁখা ব্যবসায় ধ্বংস নেমেছে। দীর্ঘদিন যাবত তেমন কাজ না থাকায় তাঁরা আর্থিক কষ্টে ভুগছেন। বিভিন্ন এনজিও'র ঋণের চাপে তাঁরা বিপাকে। তাঁরা সরকারি ভাবেও তেমন কোন সাহায্য -সহযোগিতা পায়নি।
জামনগর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস জানান, করোনা সংকট মোকাবেলায় সরকারিভাবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে শাঁখা শিল্পে সংপৃক্তদের একাধিক বার আর্থিক ও খাদ্য সহযোগিতা করা হয়েছে। শাঁখা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পর্যায়ক্রমে তাদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে।
সাম্প্রতিক মন্তব্য