স্বপ্ন পূরণের গল্প
ইকরামুল কবির।।
আশির দশকের কথা। তখন দেশের টিভিতে ডিশ লাইন ছাড়াই বিবিসি-সিএনএন দেখা যেতো। বিদেশি সাংবাদিকরা যুদ্ধক্ষেত্রসহ মাঠে ময়দানে গিয়ে সরাসরি সংবাদ পরিবেশন করতেন। কী অপূর্ব দৃশ্য। প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতা দেখে মুগ্ধ আমি। ভাবতাম কবে দেশে এমন প্রযুক্তি আসবে। তারচে’ বড় ভাবনা বা স্বপ্ন ছিলো, আমি কোনদিন এভাবে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বিনাতারে সরাসরি দর্শকদের সঙ্গে সংযোগ হবো। তখন আমি গণমাধ্যমে সংযোগই হয়নি। লেখাপড়ার মাঝেই আছি। এমসি কলেজে ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশ নেই, কবিতা-প্রবন্ধ লেখি, জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় ছাপা হয়। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে জাতীয় পত্রিকার চিঠিপত্রের কলামে লেখি। অগ্রজ প্রথিতযশা সাংবাদিক ইকবাল কবির ছিলেন সিলেট সমাচারের বার্তা সম্পাদক। এম সি কলেজের সমস্যা নিয়ে সিলেট সমাচারে লেখতে থাকি। বড় ভাই বানানটানান ঠিক করে তা ছাপানোর ব্যবস্থা করতেন। সবকিছু মিলে লেখালেখির প্রতি ঝোঁক বাড়তেই থাকে। সিলেট ও ঢাকার পত্রিকায় লেখাখেখি শুরুটা ওই সময় থেকেই।
দেখতে দেখতে দিন এগুতে থাকে। এরশাদের পতনের পরপরই আমার সম্পাদনায় বের হয় সাপ্তাহিক সিলেটের কাগজ। বন্ধু হেলালের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব নেই। বন্ধু সেকিল চৌধুরী পত্রিকা প্রকাশনায় বেশ সহযোগিতা করে। প্রকাশক ছিলেন বন্ধু ফকরুজ্জান।
এরই মাঝে বড় ভাই ইকবাল কবিরের সম্পাদনা ও প্রকাশনায় বের হয় দৈনিক আজকের সিলেট। জাসদ সভাপতি লোকমান আহমদের সহযোগিতায় প্রকাশিত আজকের সিলেট-এর ওই পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বও পাই আমি। আরও এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে দৈনিক আজকের সিলেটে থাকাকালীন জাতীয় পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করি। আজকের সিলেট-এ সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের ম্যালেরিয়ার নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পিআইবি-প্যানোস ফেলোশীপের জন্য প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হই এবং চূড়ান্তভাবে ফেলোশীপ অর্জন করি। তাহিরপুর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার বন্ধু ডা. হিমাংশু লাল রায়ের (সাবেক বিভাগীয় পরিচালক, স্বাস্থ্য) উৎসাহে এই প্রতিবেদন করার জন্য তাহিরপুর গিয়েছিলাম।
১৯৯৭ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ দৈনিক মুক্তকণ্ঠ। বেক্সিমকো গ্রুপের এ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন দেশের প্রবীণ সাংবাদিক কে জি মোস্তফা। পত্রিকা যেদিন বাজারে আসে সেই উদ্বোধনী পত্রিকার লীড নিউজ ছিলো আমার। আমার নামে ছয় কলাম লীড নিউজ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম। জাতীয় কোন পত্রিকা আঞ্চলিক সংবাদ দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করে। পত্রিকা হাতে নিয়ে নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না, এটা স্বপ্ন না বাস্তব। আনন্দ চোখ ভিজে আসছিলো বারবার।
তারপরও অতৃপ্ত একটা আকাঙ্খা আমি স্বপ্নে ডুবে ছিলাম। ওই যে আগে বলেছিলাম ‘বিবিসি-সিএনএন’। কবে দেশে ওই ধরণের টিভি চ্যানেল আসবে আর আমি সুযোগ পাবো। সেই মনোরোগে ভুগছি।
১৯৯৯ সালে মুক্তকণ্ঠে থাকাকালীন দেশে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল অনুমতি পেয়েছে এমন কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিলো। আরও কিছুদিন পর জানলান সেই টিভি চ্যানেলের নাম ‘একুশে টেলিভিশন’। মনের ভিতর একটি ইচ্ছা তোলপাড় করছে। কারা আছেন ওই চ্যানেলে? কিভাবে যোগাযোগ করবো। হঠাৎ মুক্তকণ্ঠে গিয়ে জানতে পারলাম মুক্তকণ্ঠের অত্যন্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন উপসম্পাদক জনাব আহমেদ জোবায়ের ওই টিভি চ্যানেলে যোগ দিয়েছেন। টিভি চ্যানেলে কাজ করার দ্বার উন্মোচনের একটা পথের সন্ধান পেয়ে আমি বেশ পুলকিত। মুক্তকণ্ঠে বসেই সাহস করে শ্রদ্ধেয় আহমেদ জোবায়ের ভাইয়ের নম্বরে কল দিলাম। আমার কল ধরে তিনি জানালেন, আপাতত জেলা পর্যায়ে নিয়োগের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে না, টিভি অনএয়ারে আসার পর সিদ্ধান্ত হবে। কোনো সুযোগ আসলে আমাকে জানানো হবে। তাতেই আমি খুশি।
এবার অপেক্ষার পালা। দেশের আধুনিক এবং নতুন মাত্রার টেলিভিশন চ্যানেলের জনক এবং একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আবু সায়ীদ মাহমুদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইমন ড্রিং এবং পরিচালক (বার্তা) মিশুক মুনীরকে নিয়ে ২০০০ সালে দেশের প্রথম বেসরকারি টেরিস্টোরিয়াল টেলিভিশন একুশে টেলিভিশন পরীক্ষামূলক সম্প্রচারে এলো। ওই বছরের ১৪ এপ্রিল (পহেলা বৈশাখ) যাত্রা শুরু করে একুশে টেলিভিশন।
এর কিছুদিন পর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দুপুর ১২টা দিকে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে মোবাইলে কল এলো। কল ধরলো লীনা (লীনা আমার সহধর্মিণী)। মোবাইল কানে লাগাতেই আমার মুর্ছা যাওয়ার অবস্থা। অপরপ্রাপ্ত থেকে আহমেদ জোবায়ের ভাই ভারি কণ্ঠে বললেন, সিলেটের সীমান্তে যে সমস্যা চলছে তার তথ্য সংগ্রহ করে রাখতে ২টার নিউজে ফনো-লাইভ হবে। ভাই সব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলছেন আর আমার হাত পা কাঁপছে। তবে কী স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জু’মার নামাজে গেলাম। নামাজ থেকে এসে ফোনের অপেক্ষায় বেশি সময় থাকতে হলো না। এলো কল। সব বললাম আমার মতো করে। আমাদের বাসায় তখন ডিশলাইন ছিলো না। পরে বোনের শ্বশুর বাড়ি তাঁতিপাড়ায় গিয়ে রাত ৭টার নিউজে দেখলাম ওই ফনোলাইভ দিয়ে নিউজ করা হয়েছে। সে-কি আনন্দ। তারপর সব ইতিহাস। রাতেই ভাই জানালেন কাল থেকে নিউজ পাঠাতে। এই শুরু।
প্রথমে ডিশলাইনে যাত্রা শুরু করে একুশে টেলিভিশন।
এর কিছুদিন পর একুশে টেলিভিশনের সিলেট স্টেশন উদ্বোধন করলেন চেয়ারমান সাথে রিপোর্টার করতে এলেন তুষার আবদুল্লাহ ভাই। ২০০১ সালে পেলাম সিলেট বিভাগীয় প্রতিনিধির দায়িত্ব।
একুশে টেলিভিশনে কর্মরত থাকাকালীন একটা স্মৃতি আজও আমাকে নাড়া দেয়: ২০০১ সালের ঘটনা। সিলেটের গোয়াইনঘাট সীমান্তবর্তী একখন্ড অপদখলীয় ভূমি পাদুয়া ভারতের কাছ থেকে দখলে নেয় বিডিআর। রাতে খবর পেয়ে খুব ভোরে রওনা দিয়ে বিডিআরের সহযোগিতায় পাদুয়াতে চিত্র সাংবাদিক নিয়ে ঢুকে ফুটেজ নিয়ে দ্রুত ফিরে আসি। ঢুকে দেখি তিনদিকে বিএসএফ ভারি অস্ত্রে প্রস্তুত। পাদুয়া তারা পুনঃদখলে নিবেই। সেখান থেকে যথাসময়ে ওসমানী বিমাবন্দরে গিয়ে ক্যাসেটটি বিমানের ফ্লাইটে ধরাতে পারি (তখন ফুটেজ পাঠানোর জন্য বিমানই ছিলো একমাত্র ভরসা)। নিউজটি একুশে টেলিভিশনে যথাসময়ে দেখানো সম্ভব হয়। পাদুয়ায় আমরাই প্রবেশ করতে পেরেছিলাম। আমরা বেরিয়ে আসার কিছু সময় পর আর দখলে রাখতে পারেনি বিডিআর। একুশে টেলিভিশনে এই সংবাদ প্রচারের পর হৈ চৈ পড়ে যায়। রাত ১০টার দিকে ফোন রিসিভ করে পরিচয় জেনে আমি হিম হয়ে গেলাম। 'ইকরাম আমি মিশুক মুনীর'। আমি ভয়ে কাঁপছি। কী অপরাধ করলাম যে পরিচালক (নিউজ) আমাকে কল করলেন। টানা প্রায় এক ঘন্টা কথা বললেন তিনি। শুরু করলেন এভাবে, 'ইকরাম আপনি যা করলেন তাতে আমরা অভিভূত। এটা শুধু আপনার দ্বারা সম্ভব হয়েছে'। তারপর অনেক পরামর্শ দিলেন। চিত্র সাংবাদিকের জন্য কিছু পরামর্শ দিলেন। শেষ করলেন এভাবে, ' আপনার সাহস আপনাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে'। স্যালুট মিশুক মুনীর স্যার। আজও আপনার কথাগুলো বারবার মনে পড়ে।
সেই যে ১৯৯৬ সাল থেকে দেশ বরেণ্য প্রথিতযশা সাংবাদিক জনাব আহমেদ জোবায়েরের সঙ্গে মুক্তকণ্ঠ থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম আজও তার ছায়াতলে আছি। অনেকটা বছর পেরিয়ে গেলে। এরই মাঝে একুশে টেলিভিশন বন্ধ হলো আমি প্রথম আলো, সংবাদ, আমাদের সময়ে কাজ করলাম। তারপর ২০০৫ সালে দেশের প্রথম ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেল সিএসবি নিউজের সিলেট ব্যুরো প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
২০১০ সালে যমুনা টেলিভিশন থেকে ১লা ডিসেম্বর যোগ দিলাম ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেল সময় টেলিভিশনে। টেলিভিশন সাংবাদিকতায় অগাধ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব জনাব আহমেদ জোবায়ের সময় টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও দায়িত্বে রয়েছেন।
এই টেলিভিশনে কাজ করে আমরা সবাই গর্বিত। আশির দশকে বিবিসি-সিএনএনের লাইভ রিপোর্টিং দেখে মনের ভিতরে যে স্বপ্ন বাসা বেঁধেছিলো, সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে সময় টেলিভিশন। ২০১০ সালে রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। ৯ বছরে সিনিয়র রিপোর্টার, ব্যুরো চীফ এবং সবশেষে আমার পদবি বিশেষ প্রতিনিধি বা স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ও সিলেট ব্যুরো চীফ। ২০২১ সালে আমাকে আরেকধাপ এগিয়ে দেন আমাদের টিভির সুযোগ্য কর্ণধার আহমেদ জোবায়ের। আমাকে গোটা সিলেট বিভাগের দায়িত্ব দেন।
যা কিনা আমার জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কার মনে করি। কৃতজ্ঞ সময় টেলিভিশনের কাছে।
এক জীবনে নাকি সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। আমি তৃপ্ত। আমি সাংবাদিকতার কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকার করতে হয়। আমি করেছিলাম সেই অঙ্গিকার। এতোটা পথ পাড়ি দিয়েছি মসলিন অবস্থায় নয়। অনেক যন্তনা সহ্য করতে হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। বউ-বাচ্চাদের নিয়ে শুণ্যে পড়েছি, হতাশ হয়নি। মনোবল আর অঙ্গীকার আমাকে এগিয়ে দিয়েছে। স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করেছে। পেশাদারিত্বকে সমুন্নত রেখেছি বলেই ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন কর্তৃক মানবাধিকার সাংবাদিকতায় সম্মাননাসহ অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছি। পিআইবি'র প্রশিক্ষক হয়েছি। সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতির আসনে দু’বার বসিয়েছেন আমার প্রাণপ্রিয় সদস্যরা। এরই মাঝে সাংবাদিকতার পরিচয়ে ব্রিটিশ ভিসায় যুক্তরাজ্য সফর করেছি।
সবশেষে বলতে চাই আলহামদুলিল্লাহ।
পুনঃলিখনঃ ০৩.০৮.২০২৩ খ্রি.
সাম্প্রতিক মন্তব্য