logo
news image

গণতন্ত্র মুক্তি পাক

পাভেল রহমান।।
ছবিটির যে দিন জন্ম হলো আমার ক্যামেরায়!
সাংবাদিকতায় আমার মাটির তলের (আন্ডার গ্রাউন্ড) দিনগুলি-৩য় পর্ব
আমি সেই ছবিটির কথা বলি।
সারা দেশে উতপ্ত হয়ে উঠছিল স্বৈরাচার বিরোধী নব্বইয়ের আন্দোলন। জেনারেল এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবীতে দেশের সকল গণতান্ত্রিক জোটের ঐক্যবদ্ধ এক আন্দোলন। স্বৈরাচার সরকারের পদত্যাগ এবং অবাদ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবীতে ১০ই নবেম্বর দেশব্যাপী অবোরধ কর্মসূচী পালনের আহবান জানিয়েছে সকল বিরোধী রাজনৈতিক জোটভুক্ত দলগুলি। বিরোধী দল সমূহের এই অবরোধকে কেন্দ্র করে শাসন ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচার সরকার রাজধানীতে নিজেরাই অঘোষিত অবরোধ করে বসলো। বিশেষ করে ৯ই নভেম্বর গভীর রাতে শহরের রাস্তা ঘাট ব্যারিকেড দিয়ে চলাচল বন্ধ করে দিল। রাজধানীতে প্রশাসনের কেন্দ্র সচিবালয়ে মধ্য রাতের মধ্যে অফিসার কর্মচারীদের অফিসে উপস্থিত থাকতে বলা হলো। পত্রিকার কাজ শেষ রাতে বাড়ি ফেরার সময় সচিবালয়ের বাতিগুলি জ্বলতে দেখে সেখানে উপস্থিত হয়ে অভাবনীয় সব ছবি পেয়ে গেলাম আমি। অফিসের ফাইলে মাথা রেখে রাত্রি যাপনের দৃশ্য-চলাচল বন্ধ করে রাজপথ জুড়ে বসানো হলো বাশের তৈরী ব্যারিকেড। ভাবা যায়! দারুন সব ছবি। বিরোধী জোটের অবরোধে সরকার নিজেই হয়ে পড়লেন অবরুদ্ধ।
১০ই নবেম্বর ১৯৮৭ সাল।
প্রেস ফটোগ্রাফীর মুল লক্ষ্য ‘মুহূর্ত’। মুল ঘটনাস্থল এবং সঠিক সময় সঠিক স্থানে অবস্থান। আমি তখন জাতীয় ইংরেজি দৈনিক নিউ নেসান পত্রিকার চীফ ফটোগ্রাফার। একই সাথে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বার্তা সংস্থা এপি এসোসিয়েটেড প্রেসের বাংলাদেশসহ ভারতের আলোকচিত্রী। কোলকাতা আনন্দবাজার আর স্টেট্সম্যান পত্রিকার ঢাকা প্রতিনিধি। কাজ করি প্যারিসের গামা এবং সিগমা ফটো এজেন্সিতে। ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছবির বিশাল এক কর্ম ক্ষেত্র আমার ক্যামেরায় আমার চোখের মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্বে। ক্যামেরা বলতে আমার হাতে তখন নাইকন সিরিজের এফ এম টু মডেলের ২ টি ক্যামেরা আর একটি নাইকন ই এম সিরিজের ৩৫ মিলিমিটার ফিল্ম ক্যামেরা। নিজের সঠিক অবস্থান যাচাইয়ের জন্য ভোর ৫টা থেকে মোটর বাইকে পুরো শহর চষে বেড়াতের শুরু করেছি। কলাবাগান থেকে মিরপুর, মহাখালী থেকে ফার্মগেট, শাহাবাগ থেকে নীলক্ষেত, টিএসসি থেকে পল্টন গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ী মতিঝিল থেকে সদর ঘাট ঘুরে আমার মনে হলো পুরানা পল্টনে তাপমাত্রা পুরো শহরের চেয়ে একটু বেশি। ফটো সাংবাদিককে ডাক্তারের মতই বুঝতে হবে ‘প্লাস’! পল্টন মোড়ে লাল ঝাণ্ডায় সমাবেশে নবেম্বরের নাতিশীতাষ্ণ আমেজ মুখোমুখি রায়ট পুলিশ। স্থানটা উত্তম এবং মনে হলো তপ্ত হয়ে উঠবে দ্রুত!
ইতিমধ্যে বিরোধী জোট নিজেদের অবস্থান ভাগ করে নিয়েছেন রাজপথে। পল্টন থেকে বায়তুল মোকারমের দিকে সিপিবি অফিসের সামনে অবস্থান নিয়েছে ৫ দলীয় বাম জোট, আছেন সিপিবি নেতা মঞ্জুরুল আহসান খান মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, রাসেদ খান মেনন, আহসানুল হক ইনু। আরেকটু এগিয়ে বায়তুল মোকারম থেকে দৈনিক বাংলার পথে ৭ দলীয়ে জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বসেছেন রাজপথে চেয়ার নিয়ে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে স্টেডিয়াম গেটের উলটোদিকে থাকবেন ১৫ দলীয় জোট নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
এই ফাঁকে প্রেসক্লাবে সকালের নাস্তা শেষ করতে না করতেই দেখি ছাই রঙের পাজেরো জীপ চট্ট-মেট্রো-গ-১০ এর সামনের জানালায় দাঁড়িয়ে ১৫ দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ছুটেছেন কর্মীদের নিয়ে পল্টনের দিকে। আমি আমার সেই সময়ের প্রিয় সুজুকি ১২৫ সিসি, চড়ে পল্টন ইউবিএল ক্রসিং এ পৌঁছে যাই। পুরানা পল্টন মোড় তখন ঐ নামে পরিচিত ছিল। পুলিশ বক্সের ঠিক সামনেই থামলেন হাসিনা আপা তাঁর জীপ নিয়ে। ১৫ দলীয় কর্মী সহ ছাই রঙ্গের সেই জীপ ঘিরে হাজারো সমর্থক। জীপের চালক মোহাম্মাদ জালাল দীর্ঘ দিন থেকে হাসিনা আপার সাথে কাজ করছেন, আজো ড্রাইভিং এর দায়িত্বে। পাশে সীটের জানালা গলিয়ে চলন্ত জীপের বাইরে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা আপা হ্যান্ড মাইকে শ্লোগান তুলেছেন। সচিবালয় পিছনে আলোর বিপরীতে নেত্রীর দারুন সব ছবি উঠে আসে আমার ক্যামেরায়। তাঁর নিরাপত্তায় নজিব আহমেদ বাহাউদ্দিন নাসিম মৃণাল কান্তি দাস জীপের চারিদিকে। আমি তাঁকে মুখতাঙ্গন জিপিও পযন্ত ফলো করে আবার ফিরে আসি পল্টন মোড়ে। পল্টন আজ হট বেড। স্থানটা আপাতত ছেড়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
যদিও সচিবালয়কে কেন্দ্র করে আজ সব আন্দোলন, সরকারী ভাবে সর্বচ্চো নিরাপত্তায় রাখা হয়েছে পল্টন জিপিও, প্রেসক্লাব, আ. গণি রোড।
পল্টন আমি ছাড়তে পারিনা। আমি ৫ দল ৭ দল বায়তুল মোকারম থেকে আবার ফিরে আসি সেই পল্টনে।
এরই মাঝে পল্টনে এক পশলা ইষ্টক বিনিময় হয়ে যায় ৫ দলীয় জোটের সাথে পল্টনের রায়ট পুলিশের। যদিও এই প্লাটুনটি ছিল গোবেচারা লাটি পুলিশের। লাঠি পুলিশের দল আর বিক্ষোভকারিদের ইট পাল্টা ফিরিয়ে দিতেই ব্যস্ত থাকে। আমরা জানি রাইফেল পুলিশ কোথাও মোতায়ান থাকলে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে। লাটি পুলিশের বেলায় সেই সতর্কতা বা দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক ভাবেই কম।
পল্টনে বিক্ষুব্ধ জনতার জমায়েতে অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য ঘটলো আমার সামনে। আমার শরীর ঘেঁষে ঝাঁকড়া চুলের এক যুবক নির্ভীক হেঁটে যায়। যুবকের কোমড়ে বাঁধা জামা। পিঠ জুড়ে সাদা কালিতে লেখা দেখে চমকে উঠি আমি। একী, শ্যামল শরীরে চলন্ত পোস্টার! আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যায়। চোখের পাতা জোড়া কেঁপে উঠে। মন্ত্রমুগ্ধের মত আমার চোখটাই ঢুকে পড়ে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে দেকি - ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’-ঝক ঝকে সাদা অক্ষরগুলি চোখের মণিতে এসে বিঁধে যায়। আমার বাম হাতের তালুতে লেন্স আর ডান হাতের তর্জনীতে সার্টার। মুহূর্তে সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দী হয়ে যায় অবিস্মরণীয় সেই শ্লোগান-‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’-প্রথম ফ্রেমটা ভার্টিকেলে। পরমুহূর্তে কি মনে করে যুবকটি তাঁর এবড়ো থেবড়ো আঙ্গুল গুলো চিরুনি চালায় কোঁকড়া চুলে। শ্যামলা বরন পেশী যুগল ফুলে উঠে কামানের গোলার মত। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে হাজারো জনতার ভিড়ে তলিয়ে যায় সেই যুবক ! আমার ক্যামেরার ফ্রেমটা ততক্ষণে হরাইজেন্টাল তুলে ফেলেছে অবিস্মরণীয় দ্বিতীয় ছবিটি!
কোথাও নেই সে!
এরই মাঝে একটি গুলির শব্দ। ক্যাপিটাল কনফেকশনারীর পাশে নিজেকে লুকিয়ে রাখি আত্মরক্ষার্থে। আর ঠিক ঐ সময় উল্টো দিকে বায়তুল মোকারম আর জিপিও গলি পথে ছুটে আসেন বিখ্যাত রশিদ তালুকদার। আমাকে দেখেই ফলো করার ইঙ্গিত করলেন। আমি তাঁর পিছু নিলাম জাসদ অফিসের ফাঁকে রমনা ভবন হয়ে ছুটছি গোলাপ শাহ মাযারের দিকে। দেখি শেখ হাসিনাকে ঘিরে রেখেছে পুলিশের ট্রাক। আর তিনি সেই ছাই রঙের জীপের জানালা দিয়ে শরীর বেড় করে শ্লোগান তুলেছেন।
নূর হোসেনের নাম শুনলাম রাতে ইত্তেফাকের ডার্ক রুমে। আমরা তিন ফটো জার্নালিস্ট রশিদ তালুকদার, মোহাম্মাদ আলম আর আমি ব্যস্ত ছবি প্রিন্ট করতে। রশিদ ভাই এনলারজারে, ছবি প্রিন্টার, আলাম ভাই ক্যামিকেলে ছবি ওয়াশ করছেন আর আমি হাইপোতে ছবি ফিক্স করছি।
এরই মাঝে দরজায় আমাদের রিপোর্টার তারেক। তারেকের শব্দে রশিদ ভাই বিরক্ত। কাজের সময় কে আসে ? তারেক জানালো  ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ ছবিটার কথা।।
নূর হোসেনের কথা। সকালে স্টেডিয়ামের সামনে একটি মাত্র গুলিতে আহত নূর হোসেন হাসপাতাল যাবার পথে অপহৃত হয়েছে পুলিশের ট্রাকে। সেই প্রথম আমি যুবকটির নাম জানলাম। আমার অফিসে রাত ১১ টায় সবাই ছবিটাকে ঘিরে ধরলো। কিন্তু আমাদের সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন রাজী হচ্ছিলেন না ছবিটি ছাপতে। আমি আর বার্তা সম্পাদক আমান উল্লাহ কবির ব্যারিস্টারকে ছবিটা দেখিয়ে অনুরোধ করতে থাকি। তিনি প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন। তিনি ঐ ছবির দায় নিতে রাজী হচ্ছিলেন না। আমানুল্লাহ কবির আমি রাত ১টা পযন্ত ছবিটি ছাপার জন্য বেশ কয়েকবার তাঁর রুমে গিয়েছিলাম।
শেষ পযন্ত তিনি রাজী হলেন। প্রথম পাতায় ফোল্ডের নীচে, ডিসি সাইজে, ডবল কলাম, ছাপার অনুমতি দিলেন।
পরদিন ১১ তারিখ ছবিটি হৈচৈ ফেলে দিল। আমি আমাদের প্রেসক্লাবের কাউন্টারে বিটু সাইজের প্রায় ৫০টা প্রিন্ট রেখে দিলাম। যার যার প্রয়োজন তাঁকে ব্যবহার করতে দেয়া হলো।
নভেম্বরে ১২/১৩ তারিখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন গরম হয়ে যায়। হাসিনা আপা গৃহ বন্ধী হয়ে পড়েন ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে। আমি বিপদ আঁচ করে নিরাপত্তা গোয়েন্দাদের খোঁজাখুঁজির কথা জানতে পেয়ে আবার মাটির তলে আত্মগোপনে। এবার অবশ্য একে বারে ভিন্ন যায়গায়। আমি ভীত হয়ে পড়লাম যখন শুনলাম রাষ্ট্রপতি সয়ং ক্ষিপ্ত। তিনি বলেছেন ঐ ঘঠনা সঠিক নয়। এই ধরনের কোন ঘটনা রাজপথে ঘটেনি। এমনকি কিলিং এর সাথে সরকারী কেউ জড়িত নয়।
আমার ঐ আতংকের মাঝেই ১৩ কিংবা ১৪ নবেম্বর একটি গোপন মিটিং সুপ্রিম কোর্টের ৭/৮ জন ব্যারিস্টার আমাকে ডেকে পাঠান। ব্যারিস্টার ইশতিয়াক, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম প্রমুখ আমার সাথে কথা বললেন। তাঁরা আমাকে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ ছবিটি তোলার জন্য অভিনন্দন জানালেন এবং সারা দেশে পোস্টারের পরিকল্পনার সিদ্ধান্তের কথা বললেন। আমি অবশ্য আমার সমূহ বিপদ নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। সবাই অবশ্য তাঁদের ল্যান্ড ফোন নাম্বার আমাকে লিখে দেন যাতে কোন বিপদ হলে আমি যেন ফোন করি।
শীর্ষ দুই নেত্রী নূর হোসেনের মৃত্যুর পর একসাথে আন্দোলনের সিধান্ত নিলেন। আর চকলেট আপার বাসায় একটি সভায় আমার সৌভাগ্য হলো দু জনার মাঝে ছবি তোলার। ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ ছবিটি আমাকে দুই নেত্রীর মাঝে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ ছবিটি আমাকে লক্ষ কোটি মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ‘গনতন্ত্র মুক্তি পাক’ লক্ষ কোটি শব্দের চেয়ে শক্তিশালী আমার একটি ছবি!
শহীদ হোসেনের আত্মা শান্তি লাভ করুক-আমীন।

* পাভেল রহমান: প্রাক্তন ফটো সাংবাদিক এপি। সাংবাদিকতা আমার ক্যামেরায় বই থেকে।

ক্যাপশন: দুই নেত্রীর মাঝে আমি। শেখ হাসিনার বিক্ষোভ। সেই ছবিটি গণতন্ত্র মুক্তি পাক। এরশাদ গ্রেফতার। এরশাদ গ্রেফতারের দাবীতে পুলিশের গাড়িতে আগুন। এরশাদ সরকারের পতনে আনন্দ-পাভেল রহমান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top