বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা
-অধ্যক্ষ ইমাম হাসান মুক্তি। ।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব গুটি গুটি পায়ে দুই যুগ (১৯৯৪-২০১৮) অতিক্রম করতে চলেছে। ১৯৯১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলেও ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতার অগ্রযাত্রা ১৯৯৪ সালে। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সাথে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব’।
শাবি প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার কথা:
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৩-৯৪ শিক্ষাবর্ষে চতুর্থ ব্যাচে (সমাজকর্ম বিভাগের প্রথম ব্যাচ) ভর্তির হই। কিছু দিনের মধ্যে অনুভব করি জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর তেমন গুরুত্ব পায় না। এদিকে রকিব আল-হাফিজ ও মাসউদুর রহমান ভাই রিপোর্টিং শুরু করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব বেশি দূর এগোতো দেয়নি।
পূর্বের লেখালেখির অভ্যাস থেকে সংবাদপত্রের সাথে জড়িয়ে পড়ি। আমি ও বন্ধু তৌহিদ চৌধুরী দুজনে মিলে শুরু করি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ধারা। আমরা দুজনে পুরো পুরোদমে সংবাদ করতে লাগলাম। নেশা সাংবাদিকতা আমাদের পেয়ে বসে। দিন-রাত সংবাদ সংগ্রহ করে লিখে নিয়ে শহরে যেতাম। আমরা সিলেটের ডাক, আজকের সিলেট, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক পত্রিকায় কাজ করলেও প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি ও স্থানীয় পত্রিকার জন্য ফটোকপি করে নিউজ সরবরাহ করতাম। সেই সূত্রে সিলেট শহরের জাতীয় পত্রিকার প্রতিনিধি ও স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন হয়। জাতীয় দৈনিকগুলোতে যোগাযোগ করা হলে প্রতিনিধি তো দূরের কথা ঢাকা অফিস থেকে বলা হয় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে সেটাই তারা অবগত নয়। অগত্যা স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিউজগুলো পাঠানো ব্যবস্থা করি। জাতীয় পত্রিকাগুলোতে নিউজ প্রকাশিত হতে থাকে। যোগাযোগ ও প্রচেষ্টার ফলে এক সময় প্রধান দৈনিক পত্রিকাগুলো শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধির পদ সৃষ্টি করে নিয়োগের উদ্যোগ নেয়।
নিরলস সাংবাদিকতা পেশা আমাদেরকে হাপিয়ে তোলে। ১৯৯৪ সালের সালের শেষ ভাগে দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে আর সম্ভব নয়। আরোও সাংবাদিক সহকর্মী তৈরি করা প্রয়োজন। দুজনে মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে ও নোটিশ বোর্ডে সাংবাদিকতা করতে আগ্রহীদের যোগাযোগ করতে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি। তাতে সফলও হই। আমাদের আহবানে সাঁড়া দিলে বিভিন্ন পত্রিকায় কথা বলে কাজ করার উৎসাহ দিই। এদের মধ্যে জামাল হোসেন রিয়াদ (বাংলাবাজার পত্রিকা), ফারুক আহমেদ মেহেদী (খবর), প্রয়াত বিদ্যুৎ রঞ্জন দত্ত (মানচিত্র), আনোয়ার হোসেন (ইত্তেফাক), সজল ভট্টাচার্য (যুগভেরী), গোবিন্দ চন্দ্র সাহা (সংবাদ), সজীব কুমার সাহাজী (পিজন মিডিয়া) পত্রিকার সাথে যুক্ত হয়ে আমাদের ভিতকে মজবুত করে। এদের সবার সাথে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অক্ষুন্ন থাকে।
এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকদের একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বন্ধু তৌহিদ চৌধুরী সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে ৯ সদস্যের কমিটি করে ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব’। যার আবেদন জমার দীর্ঘ দিন পর ১৯৯৯ সালের ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেয়। অনুমোদনের আবেদন দিয়ে আমরা বসে না থেকে বসার একটি নির্দিষ্ট স্থানের জন্য চেষ্টা করতে থাকি। ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে তৎকালীন উপাচার্য, শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক প্রয়াত প্রফেসর হাবিবুর রহমানে ঐকান্তিক ভালবাসায় টিন সেডের একটি কক্ষ বরাদ্দ পাই। ইতোমধ্যে আরো কয়েকজন সহকর্মী মুস্তফা মনওয়ার সুজন (সিলেটের ডাক, সংবাদ), বাশিদুল হাসান সোহাগ (ভোরের কাগজ), মাসুদ করিম লিটন (মানবজমিন), হারুনুর রশিদ (জালালাবাদ), অসীম কুমার সরকার (বাংলাবাজার), মোয়াজ্জেম হোসেন (আজকের কাগজ), নজরুল ইসলাম নয়ন (সিলেট বাণী), কামরুল হাসান ফারুক (দিনকাল) প্রমুখ আমাদের সাথে যুক্ত হয়।
সাস্টের সাবেক ও বর্তমান সকল সাংবাদিকদের সেতুবন্ধন বিনির্মানে ২০১২ সালের ৩০ নভেম্বর টিএসসিতে এক সাধারণ সভায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক ফোরাম, ঢাকা’। আশাকরি এ প্রতিষ্ঠান শীঘ্রই প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।
মনের মণিকোঠায় স্থান:
বনলতা সেনের নাটোরের দেশের কম বৃষ্টিপাত আর উঞ্চতম স্থান লালপুর থেকে গিয়ে ভর্তি হই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় সিলেটে যেতে লাগতো দুই দিন। শুরুতে সিলেট শহরের জাতীয় পত্রিকার প্রতিনিধি ও স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিকদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদদাতা হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দিই। এতে প্রত্যাখ্যান হই প্রথমত আমি সিলেটী ভাষা জানিনা, দ্বিতীয়ত আমি নন সিলেটী। যা আমার কাজের স্পৃহাকে দমিয়ে দেয়। বন্ধুদের সাথে আলাপ করে সিলেটী ভাষা আয়ত্ব করার পরিকল্পনা করি। এক পর্যায়ে আমি কথা বললে কেউ বুঝতো না আমি নন সিলেটী। আমার বাড়ি সিলেটেই বলে অনেকে জানতো। আমাকে যারা নন সিলেটী হিসেবে দূরে ঠেলে দিয়েছিল তারাই আবার পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে কাছে টেনে নিয়েছেন। আপনজনের মর্যাদায় চিরঋণী করেছেন। মনের মণিকোঠায় স্থান করে দিয়েছেন।
নেশা থেকে পেশা:
ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি দুর্বল। লেখার ঝোঁক মনে হয় জ্বীনগতভাবে পেয়েছি। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ঈশ্বরদীর জংশন পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে ছাপার মাধ্যমে হাতেখড়ি। অষ্টম শ্রেণিতে লালপুর শ্রী সুন্দরী পাইলট হাইস্কুল থেকে প্রকাশিত স্মরণিকা ‘মঞ্জুরী’তে একটি কবিতা প্রকাশ হয়। নেশা হিসেবে সাংবাদিকতার শুরু ১৯৯১ সালে সাপ্তাহিক নগর বার্তা পত্রিকায়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সমাজকর্ম বিভাগের প্রথম ব্যাচ) ভর্তির পর নেশা সাংবাদিকতা জোর দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, সিলেটের ডাক, আজকের সিলেটসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ শুরু হয়। বন্ধু তৌহিদ চৌধুরী সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব’। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ফেডারেশনের অর্থ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি থেকে প্রকাশিত নতুন পৃথিবী পত্রিকায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘সাপ্তাাহিক লালপুর বার্তা’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিই।
২০০১ সালে নাটোরের লালপুরে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহনের সুবাদে দৈনিক সানশাইন, দৈনিক সোনার দেশ, দৈনিক স্বত:কন্ঠ, নাটোর বার্তা, দৈনিক আজ ও আগামীকালসহ স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করি। ২০০২ সালে প্রথম আলোর লালপুর প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে অনলাইন সংস্করণ ‘দৈনিক প্রাপ্তি প্রসঙ্গ’ পত্রিকার প্রকাশনার উদ্যোগ নিই। ২০১৬ সালে যার প্রিন্ট সংস্করণ প্রকাশনা শুরু হয়। এখন আর শুধু নেশা নয় পেশা হিসেবে সাংবাদিকতার মাধ্যমে বেঁচে থাকতে চাই আজীবন।
কৃতজ্ঞতা:
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যাঁদের সহযোগিতা পেয়েছি তাঁদের নিকট আমি চিরঋনী ও চির কৃতজ্ঞ। তাঁদের মধ্যে তৎকালীন উপাচার্য, শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক প্রয়াত প্রফেসর হাবিবুর রহমান, ড. মিরাজ উদ্দিন মন্ডল, ড. সৈয়দ সামছুল আলম, প্রফেসর ড. মো. জয়নাল আবেদীন, ছাদেকুল আরেফিন মাতিন, জনসংযোগ কর্মকর্তা ফজলুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও সিলেট শহরের সাংবাদিকবৃন্দ আমাদের সাফল্যে ঐকান্তিক সহায়তা দিয়ে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন।
শাবি প্রেসক্লাবের কমিটির সকল সদস্য ও সাংবাদিক সহকর্মীর কঠোর পরিশ্রমে সংগঠন আজ পরিপূর্ণ রূপ লাভ করেছে। তাদের প্রতি গভীর ভালবাসা।
এ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ ও সুধিজন আমাদেরকে উৎসাহ, সহযোগিতা ও সাহস জুগিয়েছেন সবার প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা। সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব’ একটি সফল ও গ্রহণযোগ্য সংগঠন হিসেবে এগিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা।'
(লেখাটি ন্যাশনাল জার্নালিজম ফেস্ট এর স্যুভেনিরে প্রকাশিত)
* ইমাম হাসান মুক্তি: প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব। অধ্যক্ষ, মাজার শরীফ টেকনিক্যাল এণ্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট উইমেন্স কলেজ ও সম্পাদক, দৈনিক প্রাপ্তি প্রসঙ্গ।
সাম্প্রতিক মন্তব্য