করোনার বন্যা ও ঈদে ঘরমুখী জনতার সুনামী
-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।
করোনার দাউ দাউ করা জ¦লন্ত প্রভাবে টগবগ করে ফুটছে সারা বিশে^র সব প্রান্তের মানবকুল। দেড় বছর ধরে এই আগুন নেভার কোন নামগন্ধ নেই। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী মে ১০ ২০২১ পর্যন্ত কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৫৯,০৩৬,৪৯২ জন এবং প্রাণ হারিয়েছেন ৩,৩০৮,৩৬২ জন মানুষ।
দীর্ঘদিন ধরে করোনার সাথে বাস করে মানুষ বিরক্ত হতে হতে এখন বেপরোয়া আচরণ শুরু করেছে। কেউ কেউ মোটেও করোনাকে পাত্তা দিতে চান না। এর জন্য স্বাস্থ্যবিধির কথা শুনালে বিগড়িয়ে উঠেন। সরকারী কর্তৃপক্ষগুলো পরামর্শ দেয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে বিফল হয়ে পড়েছেন। তারা বলছেন, আমরা পরামর্শ দিই- ওরা শুনে না, গ্রাহ্য করতে চায় না। পুলিশ এলে মাস্ক পড়ে, না এলে থুতনিতে ঝুলে রাখে অথবা একবারেই খুলে রাখে। তারা অনেকেই মনে করছে জীবনটা আমার, মরণ নিয়ে মাথাব্যাথা তো আমার। তবে পুলিশ কেন মাস্ক পরা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে?
অসচেতন মানুষকে জনস্বাস্থ্য বা গণসংক্রমণ এড়ানোর কথা বোঝানো মুস্কিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংগে উৎসব যুক্ত হওয়ায় বিপদ আঁচ করে সবার জন্য এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া দুরুহ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ঈদে ঘরে ফেরা মারমুখী মানুষের ঢল সামাল দিতে আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের নাজেহাল হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে রাজপথ, মার্কেট থেকে ফেরীঘাট সর্বত্র।
বেশ ক’দিন ধরেই মানুষ মরণপণ করে বাড়ির ঠিকানায় ছুটছে তো ছুটছেই। ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি প্রতি ঈদেই যান ওনারা কিন্তু এবারের যাত্রায় ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অগ্রীম টিকিট নেই, দুরপাল্লার যানবাহন বন্ধ। তাই ঘরে ফিরতে না পারার এবার ভয়টা আগেই শুরু হয়েছিল।
ঈদের আগে প্রতিবারের ন্যায় চেনা জনস্রোত এবারে বেশ বেপরোয়া গতিতে চলাচল করছ্ েতারা মনাছে না কোনো বাধা ও বিধি-নিষেধ। সাধারণত: ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে প্রায় এক কোটি মানুষ বাইরে যায়। সাধারণত: তাতে কোন বাধা থাকে না। কিন্তু এবারে করোনার স্থানীয় ভেরিয়েন্টের সংক্রমণের শঙ্কা থেকে ছুটিতে নিজ নিজ জায়গা ও অবস্থান থেকে নড়াচড়া না করার নির্দেশ দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু মানুষ সেটা উপেক্ষা করে চরম ঝুঁকি নিয়ে ছুটছে পৈত্রিক বাড়ি অথবা গ্রামের দিকে।
অসহায় কর্তৃপক্ষ এই জনস্রোত ঠেকানোর জন্য পুলিশের সাথে রাস্তা-ঘাটে বিজিবি মোতায়েন করেছেন। জরিমানা করা হচ্ছে যানবাহনকে। কিন্তু তবুও বেসামালভাবে সবকিছু ডিঙিয়ে মানুষের গতি বাঁধভাঙ্গা সুনামীর মত ছুটে চলেছে।
এম্বুলেন্সবাহী ও লাশবাহী গাড়ি ছাড়া ফেরীতে সাধারণ যাত্রী পারাপার নিষেধ। তবুও সেসব গাড়িকে ফেরীতে উঠতে দেখে জনতার সাথে ভীড়ের মাঝে এক মা দৌড়ে ফেরীতে উঠেছে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে। কিন্তু রাস্তায় হাতছুট হয়ে থেকে গেছে তার ৬ বছরের শিশুটি। মাকে খুঁজে না পেয়ে সে অসহায়ভাবে ডুঁকরে কেদেঁ চলেছে। আরেক বর্ষীয়ান মহিলাকে জিজ্ঞেস করা হলো- তিনি করোনার সময় কেন এভাবে কষ্ট করে বাড়ি যাচ্ছেন? উত্তর জানা গেল তিনি স্বামীর আদেশ পালন করতে ঈদে বাড়ি যাচ্ছেন। পরের ছেলের কথা না শুনলে এজন্য তার সংসারে ভাঙ্গন হতে পারে। এরকম সবার একটা না একটা অজুহাত আছেই। এছাড়া কেউ স্যান্ডেল-জুতো ছেড়ে, কেউ হাতে ব্যাগ ফেলে পানি সাঁতরে ফেরীতে উঠতে পেরেও স্বস্থির ঢেঁকুর তুলছে এই ভেবে অন্তত: ঈদে বাড়ি যাওয়া হচ্ছে তো!
করোনার জন্য দুরপাল্লার ও আন্তজেলার বাস, ট্রেন সবকিছু বন্ধ। তাই জনভোগান্তির শেষ নেই। তবে বাস, ট্রেন বন্ধ থাকলেও বেশী ভাড়ায় অন্য সবকিছু চলছে।
ঢাকা থেকে কেউ কেউ নিজেদের কার-মাইক্রোবাসে বাড়ি যাচ্ছেন। কেউ কার-মাইক্রোবাসে কার-মাইক্রোবাস, অটোরিক্সা, টেম্পু ভাড়া করে ঘাট পর্যন্ত যাচ্ছেন পথ ভেঙ্গে ভেঙ্গে। হাতে টাকা কম তাই দরিদ্র, দিনমজুরগণ ট্রাকের উপর চেপে মালামালের বস্তার সাথে গাদাগাদি করে ছুটছেন। মানুষের আয় বৈষম্যের কারণে রাস্তাতে চলাচলের ক্ষেত্রেও চরম বৈষম্য লক্ষ্যনীয়।
যুগ যুগ ধরে রাজধানী ঢাকা উপরের দিকে বেড়ে যাচ্ছে শুধু উপরতলার মানুষদের জন্যে। নিম্নশ্রেণি এবং ভাড়াবাড়িতে কোনরকমে জীবন নিয়ে বেঁেচ থাকা মানুষদের ভোগান্তির কথা শুধু গল্প আর গণমাধ্যমেই শোনা যায়। বস্তিবাসী ও শ্রমিকদের জীবনমানের ইতিবাচক কোন পরিবর্তনের লক্ষণ নেই। তাই ক’দিনের ছুটি হলে নিজেদের কষ্ট লাঘবের জন্য তারা গ্রামের বাড়ি চলে যেতে চান। এই উৎসবের যাত্রায় ভোগান্তি যেন তাদের নিত্যসাথী।
এই জনভোগান্তি কি এড়ানো যেত না? এর জন্য দায়ী কে? সবসময় গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি পালনের কথা। কিন্তু ছোট গাড়িতে, পিকআপ, ট্রাকে চড়ে গাদাগাদি করে ভ্রমণ করা মানুষকে রাজধানী থেকে বের হতে দিচ্ছে কারা? রাস্তায় রাস্তায় এত চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে তারপরেও মানুষ কীভাবে গিয়ে লাশবাহী ফেরীতে উঠে পড়ছে? একজন নেতা বলেই দিয়েছেন- মানুষ ঈদযাত্র করতে গিয়ে ‘সুইসাইড’ করছে। শুনতে ভয়ংকর হলেও আসলে মানুষ নিরুপায় হয়ে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে মোটেও ভয় বা দ্বিধা করছেন না। কারণ, রাজধানীতে কর্মহীন ও ভুখা-নাঙ্গা মানুষের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ। লকডাউনে তারা জীবন বাঁচাতে অস্থির হয়ে পড়েছে। করোনা আরও দীর্ঘায়িত হলে এবং পুনরায় লকডাউন হলে তারা কি করবে কি খাবে তার নিশ্চয়তা কে দেবে? টিউশনি করা ও সামান্য রোজগার করা হাজারো মানুষেরা পথে বসে গেছে। তাদেরও আর রাজধানীতে কিছু করে খেয়ে বেঁচে থাকার উপায় নেই। এ সময়টা গ্রামে খরিফ ফসল উঠছে। ভূট্টা ও স্কীমের ধান কাটামারাই চলছে। ঈদের নাম করে এখন গ্রামে গেলে কিছুদিন অন্তত: একমুঠো খাবার তো খেতে পারবে।
ভারতের লোকাল ভেরিয়েন্ট বাংলাদেশে কতটা সংক্রমণ ছড়িয়েছে তা এক্ষুনি বলা মুষ্কিল। সীমান্ত পথে হাজার হাজার পন্যবাহী ট্রাকে ড্রাইভারগণ এস আমাদের দেশে হোটেল-রেস্তোরাগুলোতে থাকছেন, খাবার খাচ্ছেন। ভারত ফেরত করোনা রোগী যশোরের হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বাইরে সংক্রমণ ছড়িছে। সীমান্ত হাটে ভারতীয় রাখালরা প্রতিদিন গরু ও নানা পণ্য নিয়ে ঢুকে পড়ছে। তাদের সংস্পর্শে আসা দেশীয় ব্যবসায়ী, ক্রেতা, মানুষজন নিজ পরিবার ও সমষ্টিতে মিশে গেছেন। তাই ভাবা হচ্ছে করোনার ভারতীয় তথা বেঙ্গল ভেরিয়েন্টের শক্তিশালী বাহক ইতোমধ্যে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ঈদের কেনাকাটা, ট্রাক, পিকআপ, ফেরীতে গাদাগাদি করে ওঠা, বেপরোয়াভাবে চলাফেরা করার ফলে যদি তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে যায় এবং কোন কারণে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে তাহলে সেটা আমাদের গোটা দেশে মহাবিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। সময়মত লকডাউন না দিয়ে যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলের চরম অবহেলা, ভারতের কুম্ভমেলা ও যুক্তরাষ্ট্রের নিবাচনী জনসমাগমকে এখন সবাই দায়ী করছেন তাদের নিয়ন্ত্রণহীন সংক্রমণ ও মৃত্যুর জন্য।
এজন্য আমাদেরকে অতি মাত্রায় সতর্ক থাকা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। কারণ, টিকা প্রাপ্তি খুব জটিল আকার ধারণ করেছে। অগ্রীম টাকা দিয়েও সেরামের মাধ্যমে অচিরেই টিকা পওয়ার সম্ভাবনা নেই। চীনের উপহার যৎসামান্য, মাত্র পাঁচ লক্ষ টিকা দিয়ে একটি জেলাকেও কভার করা যাবে না।
আমাদের নিজস্ব টিকা ‘বঙ্গভ্যাক্স’ আসবে বলে কৌতহুল ছিল তা থেকে আশার প্রদীপ জ¦ালানোর আভাষ শোনা যাচ্ছে। তবে যেভাবেই হোক সবাইকে দ্রুত টিকা প্রদানের আওতায় আনতে পারলে জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তাজনিত স্বস্তি তৈরী হতে পারে। সেটা হলে মানুষের মধ্যে করোনাজনিত চেপেবসা অস্থিরতা ও হতাশা কমে যাবে। এভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে পারলে করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়লেও তেমন ভয় থাকবে না।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য