logo
news image

যেভাবে পাড়ি দিলাম ১৩০ তম দেশ কানাডার সীমান্ত

নাজমুন নাহার সোহাগী।।
'নবুয়ত' ভাইয়ার চলে যাওয়ার মাঝে যেভাবে পাড়ি দিলাম ১৩০ তম দেশ কানাডার সীমান্ত।আমি আমেরিকার বাফেলো থেকে কানাডার সীমান্তবর্তী নায়াগ্রা জলপ্রপাত এলাকায় পা রেখেছি। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে কি প্রখর কষ্ট। আমি প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে বোঝাই, কিন্তু আমার মন কোন কিছুতেই বোঝে না, ''আমার হৃদয়ে ভাই হারানোর শোক, হাতে লাল সবুজের পতাকা"- তবুও আমি চলছি। আমার দুচোখে অবিরত কান্নার স্রোত। আমি দাঁড়িয়ে আছি কানাডার নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সামনে। এই জলপ্রপাতের বেয়ে পড়া পানির ধারা আর আমার দু'চোখের কান্নার ধারা বেয়ে পড়ার মাঝেই সম্পন্ন হল ১৩০ তম দেশের অভিযাত্রা।
ক'দিন থেকে আমি পাগলপ্রায়। কোন কিছুতেই যেন মন বসে না। এভাবে কাটছে আমার সময়। কাল নিউইয়র্কে আমার প্রেস কনফারেন্স, কিন্তু আমি আয়োজকদের বলতে পারছি না আমার মন ভালো নেই। তারপর ফোবানা এওয়ার্ড প্রোগ্রাম, নিউইয়র্ক স্টুডেন্ট'স সোসাইটির সম্মেলনে আমাকে স্পিচ দিতে হবে। কষ্টকে চাপা দিয়েই আমাকে এখন সবকিছুতে অংশগ্রহণ করতে হবে।
বারবার আমার মনে হচ্ছে আমি কোথায় গেলে খুঁজে পাব আমার ভাইকে। সবকিছুর মাঝে'ই ভাইয়ার স্মৃতি ভেসে আসছে। আমি যখনই ভাবি দেশে গেলে আমি আর কখনো আমার ভাইয়াকে দেখতে পাবো না, আমার ভাইয়া আমার জন্য এয়ারপোর্টে ফুল নিয়ে অপেক্ষা করবে না, আমাকে হাসি হাসি মুখে জড়িয়ে ধরবে না। ভাইয়ের ভালোবাসা কোথায় পাবো আমি! আমি যে কি পরিমাণ ভাইয়াকে মিস করছি প্রতিদিন তা শুধু বিধাতাই বলতে পারবেন।
মৃত্যু নামক কঠিন সত্যকে মেনে নিতে হয় মানুষের, কিন্তু তারপরও পরিবারের কোন মানুষকে হারানোর কষ্টের মত সত্যকে মেনে নেওয়া অনেক কঠিন।
আমার ভাই আমার জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। পরিবারের অতি দায়িত্ববান একজন মানুষ ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর সৌদি আরবের একটি বড় কোম্পানি তাকে হায়ার করেছিলো ভালো বেতনে। আমাদের সংসারের অনেক দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। সব সময় চেষ্টা করতেন সবাইকে খুশি রাখতে। আমার জীবন গঠনে আজকের যে আমি তার জন্য আমার ভাইয়ার অবদান অনেক বেশি। দায়িত্ব পালনে সব সময় তার একাগ্রতা ছিল।‌
বাবা তার নাম রেখেছে 'নবুয়ত'। ছোটবেলা থেকে বুঝ হওয়ার পর থেকে আমি ভাইয়াকে 'ময়না' বলে ডাকতাম। আমার প্রতি তার আদর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। কোন কিছুতেই সাহস হারিয়ে ফেলতেন না তিনি। খুব উদ্যমী মনের মানুষ ছিলেন। আমার মনে পড়ে না ভাইয়া কখনো আমার সাথে রাগ করে কথা বলেছেন। আমার সাথে সব সময় মজার মজার কথা বলতেন, দুষ্টামি করতেন। আমি দেশে গেলে খাবার টেবিলে বসে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতাম।
আমাকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ ছিল না, যখনই কোন নতুন দেশে যেতাম সব সময় আমার খবর রাখতেন। আমাকে জীবনের সব কিছুতেই তিনি উৎসাহ দিতেন।
১৩০ দেশে কানাডা পাড়ি দেওয়ার মুহূর্ত আমি কখনই ভুলবো না। কিভাবে আমি আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এসেছি তা আমি জানিনা। কোন এক দুর্বিষহ ঘোরের মধ্যে আমার কেটেছে ইউরোপ থেকে আমেরিকার দীর্ঘ রাত।
তখন দুপুর বারোটা, আমি সুইডেনের বাসা থেকে রওনা দিয়েছি আরলানডা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। আমি ট্রেনে উঠে বাসায় ফোন দিয়েছিলাম, ভাইয়ার সাথে আমার কথা হলো। ওপার থেকে ভিডিও কলে ভাইয়া বলছে- 'ভালো মতো যাও, দোয়া রইল, পৌঁছে ফোন দিও'। আর হাত দিয়ে ইশারা করছে, হাত নেড়ে নেড়ে আমাকে বিদায় দিচ্ছিল।' কিন্তু আমি কি জানতাম এটাই আমার ভাইয়ার সাথে শেষ কথা, শেষ বিদায়, শেষ দেখা এই পৃথিবীতে।
দু'ঘণ্টা পর যখন আমি এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম, আমার ইমিগ্রেশন হলো, প্লেনে উঠবো ঠিক এই মুহূর্তে মেসেঞ্জারে একটি মেসেজ এলো। আমার ভাগ্নি স্নেহা লিখেছে 'খালামণি 'নবুয়ত' মামা হঠাৎ খুবই অসুস্থ ইমার্জেন্সিতে, অনেক রক্তের প্রয়োজন।'
আমার প্লেন তখন আকাশে উড়ার আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি, আমি কি করব বুঝে উঠতে পাচ্ছিলাম না ওই মুহূর্তে। আমার ভীষণ অস্থির লাগছিলো।
আরলানডা থেকে লন্ডনের হিথ্রোতে পৌঁছাতে দেড় ঘন্টার বেশি সময় লাগবে। যা করার এই ১০ মিনিটের মধ্যেই আমাকে করতে হবে। আমার ভাইয়ের রক্ত জোগাড় করতে হবে যেভাবেই হোক। দুই মিনিটের মধ্যেই আমি ফেসবুকে ব্ল্যাক হোয়াইট ব্যানারের একটি পোস্ট দিলাম রক্তের প্রয়োজনে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কিভাবে প্লেনটি আকাশে উড়ে গেল আমি টের পাইনি, অজানা আশঙ্কায় আমার হৃদয় কাঁপছিলো তখন।
আমি তখন নেটওয়ার্কের বাইরে আকাশ সীমানায়। জানালার পাশে থেকে আমি ধবল মেঘের আনাগোনা দেখছি আর বারবার ভেসে আসছে আমার ভাইয়ের মুখ খানি। আমি কিছুই জানিনা, কাউকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয়নি যে মানুষটার সাথে কিছুক্ষণ আগে আমার কথা হল সে মানুষটার হঠাৎ করে কি হল ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে। আমার চোখ বেয়ে নিরবে গড়িয়ে পড়ল পানি। আমার পাশে বসা সোনালী চুলের ছেলেটি বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলো, গড়িয়ে পড়া চোখের পানি দেখে হয়তো সে ভাবছে আমি কেন কাঁদছি। তৎক্ষণাৎ আমি আড়াল করে চোখের পানি মুছে ফেললাম।
পৌনে দু'ঘণ্টার মধ্যেই প্লেনটি পৌঁছে গেল হিথ্রো এয়ারপোর্ট। এখানে আমার দু'ঘণ্টার ট্রানজিট।
আমি লন্ডনের হিথ্রোতে নেমেই আমার বোন রাবেয়া'কে ফোন দিলাম। ওপার থেকে আমার বোনের কান্নার চিৎকার, কাঁদতে কাঁদতে কথা বলতে পারছিল না আমার বোন। ওর কান্না জড়িত কন্ঠ থেকে আমি যেটুকু বুঝতে পারলাম ভাইয়ার প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ইমারজেন্সিতে আছে। আমি ওকে সান্তনা দিচ্ছিলাম ভাইয়া ভালো হয়ে যাবে, তুই কাঁদিস না আপা।
আমি বারবার জিজ্ঞেস করলাম রক্ত ম্যানেজ হয়েছে কিনা। ওর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে আমার জসিম মামা আমার সাথে কথা বললেন, দু'ঘণ্টার মধ্যে সব রক্ত ম্যানেজ হয়েছে, প্রচুর লোকজন এসেছে রক্ত দেওয়ার জন্য। গুলশান থেকে তোমার বন্ধু নাদিয়া সহ অনেক বন্ধুরা এসেছে, তারা সহযোগিতা করেছে। ততক্ষণে আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজন হাসপাতলে উপস্থিত হয়ে গেছে। আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নুয়ে এলো। আমি ভাবলাম যাক তাহলে আমার ভাইয়া সুস্থ হয়ে যাবে।
আমি আমার মনকে জিজ্ঞেস করলাম তাহলে আমি এখন কি করবো! আমি কি আমেরিকায় যাব নাকি পরের ফ্লাইট ধরে দেশে রওনা হব। আমি আমার বোনকে আবার ফোন দিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম আমার মাত্র আর থার্টি মিনিট বাকি আছে প্লেন ধরার আমি কি যাব, নাকি দেশে আসবো। ওই দিক থেকে ওর কান্না মাখা উত্তর- তুই যা সবাই আছে হাসপাতালে। চিন্তা করিস না।
আমার পিছনে ব্যাকপ্যাক, হাতে বর্ডিং কার্ড, আমার দু'পা চলছে ধীরগতিতে গেটের দিকে যেখান থেকে ভার্জিন আটলান্টিক প্লেনটি রওনা হবে আমেরিকার উদ্দেশ্যে। আমি যখনই ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হই তখন আমার ব্রেন খুব একটিভ থাকে, আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, মানুষ দেখি, প্রকৃতি দেখি। কিন্তু আজ আমার মন ভালো নেই। ওই মুহূর্তে বারবারই মনে হচ্ছিল আমার ভাইয়াকে, যদি তার পাশে থেকে একটু সেবা দিতে পারতাম। তাকে যদি কোনো ম্যাজিক দিয়ে তার হৃদপিন্ডের আশেপাশের রক্তনালী গুলোকে জোড়া লাগিয়ে দিতে পারতাম। ইস কি কষ্টই না হচ্ছিল ভাইয়ার। ভাবতে ভাবতেই পরবর্তী প্লেনটি উড়তে থাকলো আকাশে। আট ঘন্টার যাত্রা, তারপর পৌঁছে যাবো নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে।
প্লেনটি তখন লন্ডন থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিচ্ছিল নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে। প্লেনের সিটে বসে আমি মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম। আমি খুব জোর করে চোখ বন্ধ করে আছি, কিন্তু কোনভাবেই ঘুম আসছেনা। আমি শুধু ভাবছি আর ভাবছি। ভাবনার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে আমার মন, শুধুই চোখের সামনে ভেসে আসছে আমার ভাইয়ার মুখখানি।
বারবার আমার ভাইয়ের জন্য দোয়া করছিলাম। আমি অনেক আশাবাদী ছিলাম এয়ারপোর্টে নেমেই শুনতে পাব ভাইয়া সুস্থ হয়ে গেছে।
লন্ডন সময় রাত ৮ টায় আমি রওনা দিয়েছি, নিউইয়র্ক সময় রাত সাড়ে ১১ টায় আমি পৌঁছেছি। এয়ারপোর্টে নামলাম, আমার আত্মীয়-স্বজন টনি ভাই সহ অনেকেই ফুল নিয়ে এবং সাথে একটি দুঃসংবাদ নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে তা আমি জানতাম না। এক্সিট গেট দিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে ফুল দিয়ে বরণ করলেন টনি ভাই সহ অনেকেই।
আমার অনেক খারাপ লাগছিল, কেন জানি ফুলগুলো নিতে ইচ্ছে করছিল না। তারপরও ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিলাম। ওনারা বললো চলো আমরা বের হই দ্রুত, তোমার জন্য আমরা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম। রাত ততক্ষণে একটা বেজে গেছে। আমি টনি ভাইয়ের মার্সিডিজে সামনের সিটে চড়ে বসলাম। তিনি খুব দ্রুত চালাচ্ছিলেন, আমি বললাম ভাই আপনার স্পিড ঠিক আছে! বলল যে হা। এরমধ্যে আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন তোমার আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো? দেশে কথা হয়েছে? বললাম হা ১০ ঘন্টা আগে কথা হয়েছে।
মাইল দুয়েক চালানোর পর'ই টনি ভাইয়ের মুখ থেকে কয়েকটি শব্দ বের হলো- 'সোহাগী মন খারাপ করোনা আমাদের তো সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে, নবুয়ত ভাইয়া' আমাদের মাঝে আর নেই।" মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। শব্দগুলো আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। মধ্যরাতের বাতাস আমার কাছে ভীষণ ভারী হয়ে উঠলো।
সাথে সাথে দেশে ফোন দিলাম আমার বোনকে। ওই মুহূর্তের প্রখর বেদনাদায়ক মুহূর্ত কি তা আমি টের পেয়েছিলাম। সবাই ওপার থেকে শুধু চিৎকার করে কাঁদছিল, তখন তারা সবাই রাস্তায় মাইক্রোতে ঢাকা থেকে লক্ষীপুরের পথে, সাথে ভাইয়ার নিথর দেহ অ্যাম্বুলেন্সে শেষ গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
আমি বেশি কথা বলতে পারলাম না। আমার মাথা প্রচন্ড ভারী হয়ে আসছিল। গাড়িটি ব্রুকলিনের কোন লেনে এসে থামলো আমি জানিনা। নিশি আপা সহ কয়েকজন বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। আমি কোনরকম দোতলা বাড়ির উপরে উঠে কিছুটা নৈঃশব্দ্য খুঁজছিলাম জোরে চিৎকার করে কাঁদার জন্য। আমার বুকে ভীষণ ব্যথা করছিল, দম বন্ধ লাগছিলো। কিন্তু তারা আমাকে একা থাকতে দেয়নি। আমার চোখের পানি মুছে দিচ্ছিল, আমার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছিল। কিন্তু আমার সবকিছুই বিষাদ লাগছিল। দীর্ঘ জার্নির ক্লান্তি আমাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, কিন্তু আমার ভাই হারানোর শোক অনেক বেশি তীব্র হচ্ছিল আমার মাঝে।
আমাকে সবাই অনেক কিছু বুঝাতে থাকলো। রাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকলো। নিউয়র্কের অন্যান্য আত্মীয় ও বন্ধুরা সবাই আমাকে ফোন দিচ্ছিল সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য, কিন্তু আমি কারোরই ফোন রিসিভ করতে পারছিলাম না, আমার ভীষন খারাপ লাগছিল।
সবাই আমাকে বারবার ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করছিলা, কিন্তু আমি কি ঘুমাতে পারি আমার ভাইয়ের নিথর দেহ রেখে। চোখ আমার বন্ধ হয়না, এক রাত, দু'রাত, দিন রাত পার হয়ে যায়।
ওপার থেকে আম্মার ফোন এলো, আমাকে ঠিক রাখার জন্য শুধু বলছে, বাবা তুমি অসুস্থ হয়ে যেও না। তুমি খাও ঘুমাও ঠিকমতো। আল্লাহ তোমার ভাইয়াকে নিয়ে গেছে, আমরা চাইলেও তো রাখতে পারিনি।
আমার ভাইয়ার কিছুদিন ধরে লিভারে একটু সমস্যা ছিল, তার চিকিৎসা ঠিকমতো চলছিল। কিন্তু সে সমস্যার কারণে সে চলে যায়নি, তার হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের কারণে সে চলে গেল চিরতরে। মাত্র ৪৬ বছর বয়স ছিল তার। খুব অল্প সময়ে পৃথিবী থেকে তার বিদায় নেওয়াটা আমাদের সবার জন্য অনেক কষ্টের।
যে মানুষটা আমাকে সাহস দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, আমার উৎসাহ প্রেরণা দাতা সে মানুষটার এভাবে চলে যাওয়া আমার জন্য কতখানি বেদনার তা আমি টের পাচ্ছি প্রতিটা মুহূর্তে। কিন্তু আমি জানি আমাকে বেঁচে থাকতে হবে শক্তভাবে পথ চলতে হবে সামনের দিকে।
প্রচুর মেসেজ আর ফোন আসছে মেসেঞ্জারে, আমি কোন কিছুই চেক করতে পারছিনা। কারো সাথে কথা বলছি না। আমার নিজেকে ভীষণ নির্জীব লাগছে।
কয়েকদিন পর সবাই আমাকে জোর করে বাসা থেকে বের করলেন এ কথা সে কথা বলে। গাড়িটি নিউইয়র্ক থেকে নিউজার্সি হয়ে পেনসিলভেনিয়ার দিকে রওনা হলো। সবাই বললো বাফেলোতে আমাদের দাওয়াত আছে একা বাসায় থাকা যাবে না তোমাকে। মনে মনে একটু রাগ হলাম, অগত্য তাদের সাথে আমি রওনা হলাম। কিন্তু না, আমার মানসিক অবস্থা ঠিক করার জন্য তারা আমাকে জানান না দিয়ে লং জার্নিতে আমাকে নিয়ে বের হলো। আমি সারা পথ চোখ বন্ধ করে রইলাম। আগে চোখ মেলে দুপাশের প্রকৃতিকে আমি দেখতাম। এখন আমার কোন কিছুই ভালো লাগছে না। দূর প্রকৃতি মেঘের মাঝে গাড়িটি ছুটে চললো।
ওরা আমার ব্যাগ থেকে পাসপোর্টটা আগেই বের করে রেখেছে। আমি চোখ খুলে দেখতে পেলাম কানাডার সীমান্তবর্তী ব্রিজ। একটু পরেই ইমিগ্রেশন। জাস্ট জানালার কাচটা খুলেই সবার আইডি কার্ড এবং আমার পাসপোর্ট কানাডা ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে দিল। দুটো প্রশ্ন করেই দুই মিনিটের মধ্যেই আমরা ঢুকে পরলাম কানাডা নায়াগ্রা জলপ্রপাত এলাকায়। আমার হাতের ছোট্ট ব্যাগে সব সময় লাল সবুজের পতাকাটি ভাঁজ করা থাকে। সেটি ব্যাগ থেকে বের করে বাতাসে উড়িয়ে ধরলাম ১৩০ তম সীমান্ত অতিক্রম করার পর। আমি চোখ বন্ধ করে রাখলাম আমার ভাইয়া ওপার থেকে আমাকে দেখছে।
আমি অনুভব করতে থাকলাম ওই দূর আকাশের তারা হয়ে লক্ষ যোজন দূর থেকে আমার ভাইয়া আমাকে দেখতে পাচ্ছে আমি আরেকটি সীমান্ত পাড়ি দিয়েছি। আমি বিধাতাকে বললাম, বিধাতা ওপারে ভালো রেখো আমার ভাইয়াকে।
ভাইয়াকে বললাম, ভাইয়া তুমি চলে যাওনি আমাদের কাছ থেকে। তুমি সব সময় থাকবে আমার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি প্রার্থনায়।
আমাদের মাঝে লাল-সবুজে পতাকার মাঝে তোমার উৎসাহ তোমার সাহস, তোমার ভালোবাসা আমার সাথে থাকবে বাকি পথ চলার পথে। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো আমি অনুভব করবো আমার প্রতিটি জয়ে তোমার হাতে তালি দেওয়া সেই হাসি মাখা উৎসাহী মুখটি।
(সবাই ভাইয়ার জন্য দোয়া করবেন। সবার প্রতিটি মুহূর্তের সান্তনা ভালোবাসা, ওই মুহূর্তে যারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা)। ফেসবুক থেকে

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top