ঢাকা জেলায় ১০৩ টাকায় ১২৩৭ জনকে পুলিশে চাকরি
নিজস্ব প্রতিবেদক। ।
লক্ষ্মীপুরে শুরু করেছিলেন। পুলিশ নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে স্বচ্ছ নিয়োগের সেই ধারাবাহিকতাই বজায় রাখলেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান বিপিএম (বার) পিপিএম। শতভাগ সততা আর স্বচ্ছতায় বিগত চারটি নিয়োগে তার হাত ধরেই ঢাকা জেলায় চাকরি পেয়েছেন দুই হাজার ৮৬৭ জন।
গত ৭ জুলাই রাত ৮টায় ঢাকার মিল ব্যারাক পুলিশ লাইন্সে মেধায় উত্তীর্ণ নিয়োগ প্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করে ঢাকা জেলা পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান বলেন, কোন তদবীর নয়, সম্পূর্ণ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে গরীব মানুষের সন্তানদের চাকরি দেয়া হয়েছে।
রেজাল্ট পেয়ে চাকরি প্রার্থী তরুন-তরুনীরা আনন্দে অনেকে কেঁদে ফেলেন। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে শতভাগ সততা ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ যোগ্য, লিখিত পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়া ও মৌখিক পরীক্ষায় ভাল করার পর প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ১২৩৭ জন মেধাবী পুলিশ কনস্টেবলের একটি তালিকা টানিয়ে দেয়া হয়। যাতে রয়েছে দরিদ্র থেকে শুরু করে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত হত দরিদ্র একটি অংশ, রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাগনের যোগ্য সন্তান-নাতি-নাতনি, রয়েছে দরিদ্র যোগ্য পুলিশ পোষ্যরাও।
নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে অধিকাংশই গরীব পরিবারের সন্তান। তাদের মধ্যে কয়েকজন জানিয়েছেন, মাত্র ১০৩ টাকায় পুলিশে চাকরি পাবে তা কল্পনাও করেতে পরেনি তারা। নিয়োগ পরীক্ষা শুরুর আগে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি, প্রতারক ও দালালচক্রকে কোন অর্থ না দিতে এবং মেধা, যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ার প্রচারনা তাদেরকে চাকরি পেতে আশান্বিত করে। নিজেদের যোগ্যতায় চাকরি পেয়ে পুলিশ সুপারের ভূমিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় তারা। টাকা ছাড়া মেধা ও যোগ্যতায় চাকরি পেয়ে তারা আজ আনন্দে আত্মহারা।
তাদের একজন সাভারের শিমুলিয়া এলাকার মারুফ ইসলাম। এবারের নিয়োগে পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে যোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি।
চাকরি পাওয়ার আগে কেমন ছিল পরিস্থিতি? কেউ কি টাকা পয়সা চাননি? একেবারেই না। অবশ্য আমাদের পরিবারে পুরনো ধারণা ছিল, মামা খালু কিংবা অর্থকড়ি ছাড়া সরকারি চাকরি পাওয়া কোনো মতেই সম্ভব না।
আমার বাবা সামান্য একজন দর্জি। আগের পরিস্থিতি থাকলে তো আমাদের কখনোই সরকারি চাকরি জুটতো না। তবে আমার চাকরির মাধ্যমে সেই ধারণা ভেঙেছে। আগে গ্রামে-গঞ্জে চাকরি দেবার ফড়িয়া বা দালাল যে ছিলেন না-তা কিন্তু নয়। ধরেন, কেউ নিজের মেধা বা যোগ্যতায় চাকরি পেলেও কৃতিত্ব নিতেন দালালরা। এমনও হতো, পাঁচজনের কাছ থেকে গড়ে পাঁচ থেকে আট লাখ টাকা করে নিতেন। দুই-একজনের চাকরি হলে অবশিষ্টদের টাকা তারা ফিরিয়েও দিতেন। মানিব্যাক গ্যারান্টির কথা বলে নিজেদের কৃতিত্ব আর কথিত সততা জাহির করতেন। এ চক্রটি কিন্তু ভেঙে গেছে।
কীভাবে বুঝলেন? প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ধরেন আমার মতো অনেক প্রার্থী, যাদের নিজেদের ওপর কোনো আস্থা ছিল না, তারা বা তাদের স্বজনরা যখন লতায় পাতায় সেই চক্রের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন- তারা বলেছেন, বাপরে বাপ! ওই কাম আগেই ছাইড়া দিছি। অহন আর ঢাকা জেলায় টাকা দিয়া পুলিশে লোক নেয় না। এই পরিবর্তনটা আমি নিজে দেখেছি।
এবার কনস্টেবল পদে ঢাকা জেলায় মোট ১২৩৭ জন তরুণ-তরুণী নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৯১ জনই নারী।
এর আগেও একই ভাবে ২০১৮ সালে ৬৯৯ জন, ২০১৭ সালে ৪৬৭ জন এবং ২০১৬ সালে এ জেলায় নিয়োগ পান ৪৬৪ জন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগে উপ-পুলিশ কমিশনারের দায়িত্ব পালন শেষে পুলিশ সুপার হিসেবে ২০১৬ সালের ১৬ জুন ঢাকা জেলায় যোগ দেন শাহ মিজান শাফিউর রহমান।
২০০১ সালে পুলিশে যোগদান করে দিনাজপুর জেলা, সিএমপি, র্যাব, এসবি ও যশোর জেলায় দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা পুলিশের ২০তম ব্যাচের এ কর্মকর্তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে বহু প্রশংসা আর পদক। দুই বার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন তিনি ‘জাতিসংঘ শান্তি পদক’।
এর আগে সর্বশেষ পুলিশ সুপার হিসেবে লক্ষ্মীপুরে সন্ত্রাস ও গডফাদার দমনে অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার স্বাক্ষর রাখেন শাহ মিজান শাফিউর রহমান।
তিনি বলেন, এক সময়ে পুলিশের নিয়োগ আর পদন্নোতি নিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ছিল ওপেন সিক্রেট। বলতে পারেন এ বাহিনীর জন্যে বিষফোঁড়া। আমি লক্ষীপুরে পুলিশ সুপার হিসেবে নিয়োগ পেয়ে পুলিশ কনস্টেবল পদে একশ’ টাকায় চাকরি নিশ্চিত করার বিষয়ে চ্যালেঞ্জ হাতে নিই। সে সময় তদবির, নানা মহলের চাপ আর অনুরোধ মোকাবেলা এক অর্থে চ্যালেঞ্জই ছিল বৈকি, যোগ করেন শাহ মিজান শাফিউর রহমান।
২০১৫ সালে ৮৭ জন এবং একই বছর ৮১ জন নিয়োগ পান শতভাগ স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
তিনি বলেন, ঢাকা জেলায়ও মাত্র এক’শ টাকার বিনিময়ে (সরকারি ফি) চাকরি নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ নিতে গিয়ে আমাকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে পুলিশে চাকরি দেবার প্রলোভন দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন পুলিশ সদস্য থেকে গণমাধ্যম কর্মী পর্যন্ত। কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি। যে কারণে মাঠ পর্যায়ে একটি বার্তা পৌঁছে গেছে যে অন্তত ঢাকা জেলায় অর্থের বিনিময়ে পুলিশে নিয়োগ সম্ভব নয়।
গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এ শুদ্ধাচারের বিষয়টি তুলে ধরার কারণে মাত্র এক’শ টাকার বিনিময়ে পুলিশে চাকরি প্রাপ্তির মডেল এখন অনুসরণ করছে সারা দেশ। বলতে পারেন, এটাই ঢাকা জেলা পুলিশের বড় অর্জন। আমার সততার সার্থকতা, বলেন ঢাকা জেলা পুলিশের এই প্রধান কর্মকর্তা।
তিনি জানান, কেবল ঢাকা কিংবা লক্ষ্মীপুর জেলাতেই নয়। পুলিশ রিক্রুটমেন্ট কমিটির সদস্য হিসেবে ২০১৬ সালে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) কনস্টেবল পদে পাঁচশ’ জনের নিয়োগে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখায় পুলিশের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছিল।
তিনি বলেন, স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ বাহিনীতে বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালন করে ভিন্ন এক বাহিনী গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা তার সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করেছি মাত্র।
একজন পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শতভাগ সততা, দুর্নীতিমুক্ত আর স্বচ্ছতার মাধ্যমে আমার হাত দিয়ে তিন হাজার ৩৫ জনের সরকারি চাকরি হয়েছে- এটা ভাবলেই মনে হয়, দেশের জন্যে সামান্য কিছু করতে পেরেছি। কারণ এ পুলিশ সদস্যরাই হবেন আগামী দিনে পুলিশের দূত। চাকরি পেতে ঘুষ দিতে হয়নি। তাই তাদের মনোবল হবে দৃঢ়। নিজেরা যেমন সৎ থাকবেন, তেমনি সততা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তাও করবেন। এটাই তো আগামী বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশা, বলেন শাহ মিজান শাফিউর রহমান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য