বিটিভিতে প্রথম জিএম স্মৃতি কথা
মাসউদুল হক।।
খুব বেশিদিন আগের কথা না। আমি যখন সিভিল সার্ভিস থেকে বিটিভিতে স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রথম জিএম হিসেবে ( এবং অবশ্যই বিটিভি'র ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী) যোগদান করি তখন অনেকেই প্রশ্ন করেছিল, আমি আমলা থেকে বিটিভিতে কেন আসলাম বা আমাকে কেন পাঠানো হলো? কিংবা আমি কি পারবো এই দায়িত্ব পালন করতে?
আমি তর্কে না যেয়ে বলতাম, আমার কাজ 'গুড গভর্নেন্স' নিশ্চিত করা। যার মানে হলো, কাজের পরিবেশ উন্নত করা, শৃংখলা আনয়ন করা, আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। এইগুলো সম্পাদন করায় আমার অভিজ্ঞতা পনেরো বছর। সো লেটস সি। ( যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ ভাবে এবং বিশ্বাস করে আমলাদের কোন এস্থেটিক সেন্স থাকে না বা থাকতে পারে না সেহেতু ঐ প্রিডিটারমাইন্ড প্রশ্নে বাহাস করতে যেতাম না)।
অনেকেই মনে করেন, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে আমলাদের নিয়োগ দেয়া হয় ঐ বিশেষায়িত কাজটি করার জন্য। আসলে বাস্তবতা তা নয়। 'বিশেষ কাজ'টি বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ করবেন। আমলার কাজ সেই কাজটি করার পরিবেশ তৈরি করে দেয়া, কাজটি করবার জন্য দক্ষ মানব সম্পদ নিয়োগ দেয়া এবং আর্থিক শৃংখলা রক্ষা করে যথেষ্ট পরিমানে অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করা।
ধরা যাক, ফেসবুকের জনগনের উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করে সরকার সিদ্ধান্ত নিল - চাঁদে নভোযান পাঠাবে। তাহলে কি করতে হবে?
একটা প্রজেক্ট পরিকল্পনা করতে হবে। সেই প্রজেক্ট ডিজাইন করতে যথেষ্ট পরিমানে কনসাল্টেন্ট নিয়োগ দিতে হবে। প্রজেক্টের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য আপনাকে দেশের বিশ-পঁচিশ লাখ(!!!) ট্যাক্স পেয়ারের টাকার উপর নির্ভর করার পাশাপাশি প্রয়োজনে বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হতে পারে। তারপরও আপনাকে ভাবতে হবে, বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি সংগ্রহের জন্য আপনাকে কত টাকা রিজার্ভ থেকে ব্যয় করতে হবে? ঐ রিজার্ভের উপর চাপটা কতদূর বিস্তৃত হবে কিংবা মহাকাশে যাবার জন্য আপনি যে পরিমান অর্থ ব্যয় করবেন তার বিনিময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যের বাজেট থেকে কতটা অংশ কাটতে হবে। কয়েক দফায় এইসব নিয়ে ভাবার পর আপনি যদি সিদ্ধান্ত নেন চাঁদ মামার বুকে পা রাখবেনই তবে প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য একজন পিডি নিয়োগ দিবেন। মজার কথা হলো- এই পিডিও কোন বিজ্ঞানী হবেন না। তার ব্যাকগ্রাউন্ড হবে - মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা। পিএমপি কোর্স করা বা অনেকগুলো বড় বড় প্রজেক্ট বাস্তবায়নে তার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এবার পিডি খুঁজে বের করবেন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ লোক। যিনি এ ধরনের কাজে অভিজ্ঞতা রাখেন। ঠিক আপনারা যাকে চাচ্ছেন তাকে পাবেন মহাকাশ যাত্রার এই পর্যায়ে।
আর ঐ যে ভদ্রলোক যিনি স্পারসো'র চেয়ারম্যান তিনি কিন্তু প্রজেক্ট পাস করে, পিডি নিয়োগ দিয়ে অনেক আগেই চলে গেছেন। কিন্তু ঐ ভদ্রলোকের কাজের বা প্রজেক্ট ডিজাইনের উপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের মহাকাশযানটি চাঁদে যাবে কিনা। আরও সূক্ষ ভাবে বললে, তার নিয়োগকৃত কনসাল্টেন্ট বা ফার্মের ডিজাইনের উপর নির্ভর করছে মহাকাশযানের সাফল্য।
এই পর্যায়ে আপনি প্রশ্ন তুলতে পারেন , ' কেন বিদেশি বা স্বদেশী কনসাল্টেন্ট ফার্ম যা কইলো তার উপর নির্ভর করে এত বড় সিদ্ধান্ত নিল? আমারে'তো জিগাইতে পারতো?'
জ্বী ভাই। এটা সত্য। কনসাল্টেন্ট যা বলে আমলারা তাই করে না। বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকে। থাকে স্টেকহোল্ডার কনসাল্টেশন পর্ব। আপনাদের চেয়ে যারা অভিজ্ঞ তাদের ডাকা হয় , তাদের মতামত নেয়া হয়। এই কাজগুলোও করেন, ঐ যে স্পারসো'র চেয়ারম্যান ভদ্রলোক উনি।
আমরা সবাই মনে করি, একটা সভা ডাকা, একটা কনসাল্টেন্ট ফার্ম নিয়োগ দেয়া, অর্থের সংস্থান করা কি এমন কঠিন কাজ? জ্বী ভাই, এটা খুব কঠিন কাজ। এটার নামই গুড গভর্নেন্স। একজন বিজ্ঞানীকে আপনি চেয়ারম্যান হিসেবে বসায় দিলে তারপক্ষে বাংলাদেশের এক দুই হাজার স্টাফ ম্যানেজ করে, অফিস পলিটিক্স সামাল দিয়ে আবার রকেট ডিজাইন করা সহজ কোন কাজ না।
জ্ঞানের রাজ্য অনেক বিস্তৃত। আপনি যত জানবেন ততই আপনার নিজেকে নিয়ে সংশয় তৈরি হবে। আর যে অন্ধের হাতি দর্শনের মত লেজ ধরে বলেন , হাতি দেখতে সাপের মতো তার জন্য দুনিয়া খুব সহজ। আজকাল অন্ধের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অন্ধরা অন্য অন্ধদের কাছ থেকে প্রচুর লাইক বা হা হা রিয়েক্ট সংগ্রহ করতে পারে। এতেই সুখ।
( যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই আসি। বিটিভির জন্মলগ্নটি যার হাত ধরে ঘটেছিল তিনি ছিলেন জামিল চৌধুরী। উনিও একজন আমলা ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি যখন কাজ শুরু করার মত সক্ষমতা অর্জন করেছিল তখন তিনি আমলার দায়িত্ব শেষ করে নিয়মিত কোন পদে সরে গিয়েছিলেন। এটাই স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিউর।)
সাম্প্রতিক মন্তব্য