আশুরা: শোক ও শুকরিয়ায় স্মরণীয় দিন
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
ফিবছর মহরম মাসের দশ তারিখ এলেই পবিত্র আশুরার কথা জেগে উঠে। বিশেষত: কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার মধ্যে দিয়ে যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে তাকেই আমাদের স্মৃতিপটে জাগিয়ে তুলি। রাসুল (সা:) এর ওফাতের ৫০ বছর পর ৬৮০ সালে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা সংঘঠিত হয়। এক নির্মম জুলুমের শিকার হয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেনকে সেদিন প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। ইসলামের তৎকালীন শাসক এজিদের সৈন্যবাহিনীর হাতে শহীন হন তিনি। খেলাফতে রাশেদার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করে শহীদ হন তিনি। সত্য, ন্যায় এবং নবুওয়াতের পদ্ধতিতে আল্লাহর পৃথিবীতে শান্তির খেলাফত পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর সঙ্গী-সাথিরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত তা সারা বিশে^ মুসলমানদের জন্য এক প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নিষ্ঠুর ঘটনা খুব কম আছে। এজিদের সেনাবাহিনী কারবালার ধূ ধূ প্রান্তরে চারদিক থেকে ঘিরেধরে নারী শিশু সবাইকে দীর্ঘ সময়ব্যাপী পানি পান করার উৎসে যেতে থেকে নিবৃত্ত রাখে। এরপর সেদিকে অগ্রসর হলে বিষধর তীরের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হযরত ইমাম হোসাইন (রা:) দেহে ৩৫টি তীরের আঘাত বিদ্ধ হয়ে বেদনায় জর্জরিত করেছিল। তাঁর শিশুপুত্রকে মির্মমভাবে শহীদ করা হয়। সেই কষ্টে তিনি পানির নাগাল পেয়ে অঞ্জলিতে নিয়েও তা পান করেননি। মরুভূমিতে তৃষ্ণায় কাতর কোন অসহায় পরিবারকে নির্মমভাবে আর কখনও এভাবে হত্যা করা হয়নি। এমন নোংরা ঘটনার ইতিহাস মানুষের বিবেককে খুব পীড়া দেয়। মহরম মাসের দশ তারিখ যে জঘন্য ঘটনা ঘটানো হয়েছে সেটা হযরত ওসমান (রা:)-এর শাহাদতের ঘটনার ধারাবাহিকতা বলে অনেকে মতামত দিয়েছেন।
এই করুন দিনটিকে অনেকে শুধু একটি ইতিহাস হিসেবে আবেগতাড়িতভাবে স্মরণ করে থাকেন। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা এইদিনে বিশেষ মাতম করে শোক পালন করে থাকেন। আমাদের দেশে কিছু শিয়া এলাকা এবং কিছু আটকে পরা উর্দ্দুভাষী পরিবার যেমন পুরাতন ঢাকার কিছু এলাকা, জেনেভা ক্যাম্প, সৈয়দপুর ইত্যাদিতে ঘটা করে শোক প্রকাশ করা হয়। তাঁরা ডাকা বা তাজিয়া মিছিল বের করেন। কালো কাবুলী পোষাক পরে দুলদুল ঘোড়া সাজিয়ে হায়হোসেন, হায় হোসেন মাতম করে রাস্তায় বের হন। মিছিলে ঘন্টাপরা কিশোর-যুবদের ‘বৈলদল’ নিজেদের উদোম পিঠে লোহার শিকল দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করে ফেলে। কেউ ‘নওহা’ বা শোকগীতি গান, কেউ ‘ভিস্তা’ সেজে লম্বা বর্শাা ও নিশান বহন করে মাতম করেন। সুন্নীদের কেউ এগুলোকে শোক প্রকাশের অতি-আবেগ ও ‘বেদাত’ বলে থাকেন। ইরাক, ইরান, পাকিস্তানের শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা এভাবে শোক প্রকাশ করে থাকেন। তবে মহররমের ১০ তারিখ কুফার ঘটনার জন্য মাতম-মর্সিয়া দিয়ে শোক প্রকাশ করলেও এটা শুধু মর্মন্তুদ কারবালার ঘটনার জন্য সাধারণ কোন দিন নয়। তাইতো আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় বলেন-
“কত মোহরম্ এল্ গেল চলে বহু কাল
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল!
মুস্লিম্! তোরা আজ জয়নাল আবেদিন,
‘ওয়া হোসেনা-ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন!
ফিরে এল আজ সেই মোহরম মাহিনা,
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না!”
আরবী ‘আশরা’ শব্দের অর্থ দশ। মহরম মাসের দশ তারিখে সংঘটিত কারবালার ঘটনা ছাড়াও তার পূর্বে ওই তারিখে অন্তত: আরো দশটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে জানা যায়। তার মধ্যে- পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে আশুরার দিনে। কিয়ামত সংঘটিত হবে এই দিনে। হযরত মুসা (আ:) ফেরাউনের বিরুদ্ধে জয় পেয়েছিলেন এই দিনে। এছাড়া- “হজরত মুসা (আ.)-এর নীল নদ পাড়িদান এবং ফেরাউনের সলিলসমাধি ঘটে তাই এটা বাতিলের বিরুদ্ধে হকের বিজয়। এই দিনে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন প্রায় ২ হাজার পয়গম্বর। আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর দেহে পাক রুহ প্রদান, মা হাওয়া (আ.)-কে পয়দা, মহাপ্লাবন শেষে হজরত নুহ (আ.)-এর জুদি পাহাড়ে অবতরণ, নমরুদের অগ্নিকাণ্ড হইতে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর নাজাত, ৪০ দিন মাছের পেটে থাকিবার পর হজরত ইউনুস (আ.)-এর নিষ্কৃতি, হজরত আইউব (আ.)-এর ১৮ বৎসর পর রোগমুক্তি, হজরত ঈসা (আ.)-এর ঊর্ধ্বাকাশে গমনসহ অসংখ্য আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী এই দিবসটি।”
হযরত ইমাম হোসাইন (রা:) অন্যায়, অবিচার ও জুলুমের নিকট মাথা নত করেননি। তাঁর মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে এইদিন তাওহীদ শিরকের উপর বিজয়ী হয়েছিল। সেদিন তাগুতের বিরুদ্ধে রিসালাতের বিজয় অর্জিত হয়েছে বলে অনেক ইসলামী গবেষক মনে করেন। আমাদের উচিত এই মহান দিনটিতে বেশী বেশী ইবাদত করা, বিশেষ করে রোজা রাখা। হযরত ইমাম হোসাইন (রা:) সহ তারঁ পরিবার-পরিজন, অনুসারী যারা এই নির্মম ঘটনায় আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের জন্য দোয়া করা এবং যাবতীয় অন্যায়, জুলুম, অত্যাচার ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নিজের ঈমানকে মজবুত রাখা। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন সবাইকে সত্য-ন্যায়ের পথে চলার তৌফিক দান করুন। আজকের বিয়োগান্তক ও স্মরণীয় দিনে এই প্রত্যাশা।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য