প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা
গত দুই দশকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ‘বিস্ময়কর’ অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। খরা ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কয়েক দশক আগেও দেশটি ছিল পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র একটি দেশ। সেই দেশটি এখন মধ্যম আয়ের। উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতিতে চীনের বিকল্প হিসেবে এশিয়ায় বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের এ সাফল্য এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির অন্য দেশগুলোর জন্য অনুসরণীয় হতে পারে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস এক প্রতিবেদনে সম্প্রতি বাংলাদেশ নিয়ে এমন আশাব্যঞ্জক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মতো একই রকমের অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে এশিয়ার আরেক দেশ ভিয়েতনাম। প্রায় কাছাকাছি সাফল্য অর্জন করেছে কম্বোডিয়া। এসব দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এশিয়ায় চীনের একটি বিকল্প উৎপাদন অঞ্চল তৈরি করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এ অর্জন এখন একটু বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এত দিন এ বিষয়ে বিশ্বের নজর সেভাবে পড়েনি। দেশটি ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ঐতিহাসিকভাবে সস্তা শ্রমের জন্য বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। তৈরি পোশাক কারখানাগুলো লাখ লাখ নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে, যা দেশটির নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে গ্রামের পরিবারগুলো এখন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিনিয়োগ করতে পারছে। বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর কারণে দেশটি এখন ‘জনসংখ্যা বোনাস’ ভোগ করছে।
তবে এ অর্থনৈতিক উন্নয়ন কতটুকু টেকসইভাবে হচ্ছে সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ড্যানি রডরিক। তাঁর মতে, দরিদ্র অনেক দেশে শিল্পায়নের অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। ১৯৮০-এর দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অর্থনৈতিক উন্নতির পর অনেক শিল্প দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, এমনকি এশিয়ার কিছু দেশে স্থানান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু এদের অনেকেই প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।
তবে সাফল্যের গল্পও আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ১৯৬০ সালের দিকে এশিয়ায় জাপানের নেতৃত্বে যে শিল্পবিপ্লব হয়েছিল তার ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে উন্নতি করে দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের মতো দেশ। এসব দেশের মতো উন্নতি করতে হলে বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। উৎপাদনব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ব্যবহারকে এ ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এর ফলে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো শ্রমঘন দেশের জন্য এটি একটি বড় সমস্যা।
জাতিসংঘের গবেষণার তথ্য ব্যবহার করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্পায়নের কারণে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে হারে কর্মসংস্থান বাড়ার কথা সে হারে বাড়ছে না। এটি না হওয়ার অন্যতম কারণ চীন। বেশির ভাগ শিল্প উৎপাদন এখনো চীনকেন্দ্রিক হওয়ায় এশিয়ার অন্য দেশগুলো বঞ্চিত হচ্ছে। পণ্য উৎপাদনে চীনের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বেশি হওয়ার কারণে এমন অবস্থা তৈরি হচ্ছে।
উৎপাদনে চীনের প্রতি এই অতিনির্ভরতা বাংলাদেশের মতো দেশকে দিয়ে ভাঙা সম্ভব বলে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়েছে, শ্রমিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় চীনের কারখানাগুলো এখন স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থায় জোর দিচ্ছে। তবে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় শ্রমিকনির্ভর ব্যবস্থার চাহিদা আগামী আরও কয়েক দশক থেকে যাবে। এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। কারণ, দেশটিতে শ্রম এখনো তুলনামূলকভাবে সস্তা।
বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বাংলাদেশের মতো দেশের উঠে আসার ইতিবাচক দিকটি প্রতিবেদনে তুলে ধরে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের মতো দেশের উপস্থিতি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য তৈরি করছে। কারণ বাংলাদেশ যদি কম দামে পণ্য দিতে পারে, তাহলে চীন চাইলেও বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে পারবে না। বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের মতো দেশের কারণে ভোগ্যপণ্যের নতুন বাজার তৈরি হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কাজের সুযোগ পাওয়ায় লাখো মানুষ দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে।
সাম্প্রতিক মন্তব্য