logo
news image

মহামারী মোকাবেলায় অনেক দূরত্ব বাকী

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
কোভিড-১৯ সংক্রমণ শুরু হবার এক বছর চারমাস পেরিয়ে গেল। দিন দিন সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে বিশ^বাসীকে হতাশায় নিমজ্জিত করে চলেছে। কারণ এর রুট নির্মূল হবার কোন লক্ষণ নেই। বরং নিত্যনতুন প্রাণসংহারী ভেরিয়েন্ট এসে নতুনভাবে আক্রমণ করে ভয়াবহতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভারতে দৈনিক একলক্ষ আশি হাজার মানুষ নতুন করে সংক্রমিত হবার তথ্য জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট ও কানাডা ছাড়াও ব্রাজিল, ভারত ও বাংলাদেশে নতুন করে মৃত্যুভীতি জেঁকে বসেছে।
সংক্রমণ ঠেকাতে ইতোমধ্যে আমাদের দেশে লকডাউন শুরু হয়েছে। কিন্তু এর রাশ টানা কঠিন হয়ে পড়েছে। লকডাউনে সামাজিক দূরত্ব কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও ব্যক্তি-দৈহিক দূরত্ব বেড়ে গেছে। এপ্রিলের খরা ও গরমে ঘরে-বাইরে মানুষ গাদাগাদি, চাপাচাপি করে কোন রকমে নিশ^াস ফেলে বাঁচার চেষ্টা করছে। রোজা শুরু হওয়ায় ইফতারের সময় নিত্যপণ্যের বাজারে মানুষের আনাগোনা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে।
আমাদের দেশে এখনও করোনার সংক্রমণ অনেকটা বড় বড় শহরকেন্দ্রিক। রাজধানী ঢাকায় সংক্রমণের হার ও মাত্রা সবচেয়ে বেশী লক্ষ্যনীয়। রাজধানীতে গিজ গিজ করা মানুষ ও তাদের ঘরবাড়ি। এখানে আয়-ব্যায়ের বৈষম্যের মধ্যে জীনযাত্রার মানে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে চরম বৈষম্য। ঢাকার সচ্ছল পরিবারের মানুষেরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে একাধিকবার টেষ্ট করিয়ে ভাল হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণ করেও তাদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশী। এর কারণ হয়তোবা বড়লোকেদের তথ্য গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়। সে জন্যে সেগুলো সাধারণ মানুষ জানতে পেরেছে।
কিন্তু রিক্সাচালক ও খেটে খাওয়া মানুষদের করোনায় আক্রান্ত হবার খবর ঠিকমত জানা যাচ্ছে না। এমনকি নিম্নবিত্ত, সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের অনেকের করোনায় আক্রান্ত হবার খবর অপ্রচারিত থেকে যাচ্ছে। তাদের কেউ মারাত্মকভাবে সংকটাপন্ন হলে শুধু নিকটাত্মীয়রাই তাদের সংবাদ পাচ্ছেন। করোনা সংক্রমণ টেষ্টের দাম বেশী হওয়ায় তারা উপসর্গ শুরু হবার সময় থেকে কেউই টেষ্ট করাতে আগ্রহী হননি। এখনও হচ্ছেন না। কোন পরিবারের চারজন সদস্যের মধ্যে সবাই আক্রান্ত হবার পরও করোনা টেষ্ট করার এত খরচের ভয়ে কেউই টেষ্ট করাননি বলে জানা গেছে। এটা এখন শহুরে স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে বড় আফসোসের বিষয়। অর্থাভাবে তাঁরা না পারেন সইতে না পারেন কইতে তাদের অব্যক্ত বেদনার কথা।
বড় বড় শহরে বহুতল লিফটওয়ালা বাড়িগুলো এখন করোনা সংক্রমণের ব্রিডিং পয়েন্ট। কেননা, লক্ষ লক্ষ বহুতল বাড়ির নিয়মিত অশোধিত লিফটগুলো গণসংক্রমণের উৎস। বহুতল ভবনে একজন আক্রান্ত হলে তা অসতর্কতায় ঐ পরিবারের একজন থেকে সবাই পরে ক্রমান্বয়ে ঐ বিল্ডিংয়ের অপরাপর সবাই সংক্রমণের উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ প্রথমদিকে বহুতল বিল্ডিংগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্যানিটাইজার ব্যবহারের নিয়ম চালু করা হলেও সংক্রমণ বেড়ে যাবার পর তা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন দীর্ঘ হতাশা ও উদাসীনতা থেকে কেউ কারো খোঁজ-খবর রাখার ফুরসৎ পাচ্ছেন না।
এছাড়া করোনার ইউকে ভেরিয়েন্টের পর ব্রাজিল ও আফ্রিকা ভেরিয়েন্টের দ্বারা সংক্রমিত উপসর্গের লক্ষণ আগেভাগে জানা যায় না। ফলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া শুরু হবার পূর্বে চিকিৎসা শুরু করাও যায় না। এসব উপসর্গের পরিবর্তনে নতুন চিকিৎসা নেই। এসব রোগীর মাথাব্যাথা, ডাইরীয়া এমনকি অস্বাভাবিক আচরণের কথা জানা যাচ্ছে অনেক পরে। এজন্য চিকিৎসকগণ উপযুক্ত সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এসকল রোগী হঠাৎ হাসপাতালে এসে অক্সিজেন দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। অধিকিন্তু জীবন রক্ষাকারী ইন্জেকশনের অভাবে অনেক মূমুর্ষ রোগীকে সেবা দেয়া যাচ্ছে না। সরবরাহ না থাকায় অথবা একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানকে একচেটিয়া ব্যবসা করার অনুমতি দেয়ায় ‘একটিমেরা’ নামক একটি ইঞ্জেকশন অর্ধলক্ষ টাকা দিয়েও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন-এই ইঞ্জেকশন দিয়ে দশভাগ মূমুর্ষ রোগী বেঁচে যায়। সেক্ষেত্রেও রোগীর আত্মীয় স্বজনেরা ছুটাছুটি করে হতাশ হয়ে পড়ছেন।
লকডাউনে সমন্বয়হীনতা জরুরী সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বিব্রতকর অবস্থার নজির সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমে প্রচারিত সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় চিকিৎসকদেরকে হেনস্থা করা হচ্ছে। আ্ইডি কার্ড দেখানোর পরেও একজন চিকিৎসককে বলা হয়েছে- ‘আপনি যে ডাক্তার তার প্রমান কি?’ তিনি বলেছেন, হাসপাতালে জরুরী ডিউটি দিয়ে তিনি বাসায় ফিরছিলেন তবুও তাকে নাজেহাল করা হয়েছে, একটি মামলা দেয়া হয়েছে এবং তিন হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে এ যাত্রায় রাস্তাছাড় পেয়েছেন!
আমাদের দেশে জরুরী সরকারী নিরাপত্তা সেবকদের বিশ^াস-অবিশ^াস জরুরী না হয়ে যেন জরুরী আর্থিক জরিমানার ফিতায় বন্দী হয়ে পড়েছে- এটা অনেক হাজারো ঘটনার একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ মাত্র। তারা অর্থটাকে মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করে, সেবাটা নয়।
ইউজিসি অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘হাসপাতাল খোলা, চিকিৎসকরা চলাফেরার করলে জরিমানা দেবেন কেন?’ আ্ইডি কার্ড প্রদর্শণ করার পরেও যারা চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা দেয় তারা কারা? এছাড়া অনলাইনে মুভমেন্ট পাশ সংগ্রহ করারা কথা বলা হলেও অনেক জায়গা থেকে অনেক চেষ্টা করেও সেই পেজে ঢোকা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে আবেদনকারী সংখ্যার চাপে মুভমেন্ট পাশ সংগ্রহ করারা হোমপেজ হ্যাং হয়ে গেছে। তাহলে এই দু:সময়ে করোনা রোগী নিয়ে হতাশ মানুষের জন্য বিকল্প ভাবনার কথা নিরাপত্তা সেবাদানকারীগণকে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে বৈ কি?
টিকার প্রথম ডোজ ক’জন মানুষ নিয়েছে? দেশের সতের কোটি মানুষের মধ্যে হাতে গোনা ক’জন শহুরে মানুষ এই সেবা পেয়েছেন এবং তাঁরা দ্বিতীয় ডোজ নিচ্ছেন। লকডাইনের আগে রাজধানী থেকে হাজারো টেষ্টবিহীন সংক্রমিত মানুষ গ্রামে চলে গেছেন। তারা সর্বত্রই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মাখামাখি করে ছড়িয়ে দিতে এই মূহুর্তে ব্যস্ত রয়েছেন। কারণ গ্রামে কোন বিধি-নিশেধ নেই। সেখানে রাস্তায় নেই কোন ব্যরিকেড বা নাজেহালমূলক জিজ্ঞাসাবাদ। তারা এখন অবাধ বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন। তারা কেউ টিকা নেননি বা অনেকে টিকার কথা এখনও জানেনই না।
অন্যদিকে টিকার কার্যকারীতা নিয়ে দেশে দেশে বিতর্ক বেড়েই যাচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকা অক্সফোর্ড-এস্ট্রজেনকার টিকা নিষিদ্ধ করারা পর যুক্তরাষ্ট্র জনসনের টিকা স্থগিত করেছে। চীন তাদের টিকার দুর্বল কার্যকারীতা দেখে ককটেল টিকা বানানোর চেষ্টা শুরু করেছে। রাশিয়-চীন মিলে মিশ্র ডোজের টিকা বানানোর গবেষণা চালাচ্ছে। তবে কি অদুর ভবিষ্যতে চীনা হাইব্রীড টিকা করবে বাজিমাত? তবে ইতোমধ্যে করোনার নতুন রূপের হামলা মানুষের জীবন গিলে খেয়ে সাবাড় করার তালে বেশ বেপরোয়া রূপ প্রদর্শণ শুরু করে ফেলেছে। তাই এই ছদ্মবেশী প্রলয়ংকারী মহামারী মোকাবেলায় অনেকটা পথ এখনও পাড়ি দিতে হবে নাজেহাল মানুষকে।

*প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top