প্রথম ঢেউয়ে দশলক্ষ মেরে দ্বিতীয়তে কি সুনামী হবে?
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তার প্রথম সতর্কবার্তায় বলেছিল, বাংলাদেশে বিশলক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পারে কোভিড-১৯। বাংলাদেশ সেই সতর্কবার্তায় পুরোপুরি সাবধান হতে না পারলেও এখানে মৃত্যুসংখ্যা আক্রান্ত বড় বড় দেশের মত এখনও ততটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেনি। এর কারণ হিেিসবে অনেকে মনে করছেন- মানুষ অনেকটা সচেতন হয়েছে। বিশেষ করে গত ছয়মাস কেউ কারো বাড়িতে তেমন বেড়াতে যায়নি। সামজিক অনুষ্ঠানে ভিড় করেনি। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সভা, অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেছে। প্রয়োজন ছাড়া বাজারে যায়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।
বড় সুবিধা ছিল আমাদের গরম আবহাওয়া ও অতি-বৃষ্টি। স্মরণকালের সবচেয়ে বেশী বৃষ্টি ও বন্যা হয়েছে এবং শরৎকাল পেরিয়ে গেলেও সারাদেশে প্রায় প্রতিদিন মুষলধারে বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবার। মানুষ বার বার হাত-মুখ ধুচ্ছে, পাঁচবার ওজু করা ছাড়াও অনেকে নফল ইবাদত করার জন্য আরো বেশীবার অজু গোছল সেরে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখছে। বাজারের কেনা খোলা-কাঁচা খাবার খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। অনেক দেশের মানুষ পানি ব্যবহার তেমন একটা করেন না। আবার অনেক দেশে পানির বড় অভাব। কিন্তু আমাদের দেশে বার বার সাবান পানি দিয়ে হাত ধুতে ঢাকা শহর ছাড়া অন্য কোন শহর বা গ্রামাঞ্চলে কোন সমস্যা নেই। গ্রামাঞ্চলে টিউবওয়েল একবার চাপলেই বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়। তাই হাত ধোয়াতে পানি ব্যবহারে তেমন কোন সংকট নেই।
গরম কালটা এভাবে পার হলেও সামনের নভেম্বর মাস থেকে শীতের আগমনী বার্তা শুরু হলে কোভিড-১৯ দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে হানা দিতে পারে বলে ইতোমধ্যে নানাজন নানা মতামত দিতে শুরু করেছেন। দেশী-বিদেশী অনেক বিশেষজ্ঞ এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। শীতে আমাদের দেশে পিকনিক, বিয়ে, ওয়াজ, যাত্রগান, পালাগান ইত্যাদি শুরু হয়। এসময় ঠান্ডাতে এমনিতেই জ¦র, সর্দি-কাশি ও হাঁপানি রোগের বিস্তার ঘটে। শিশুদের ডায়রিয়া, হুপিংকাশি, ব্রঙ্কাইটিস শুরু হয়।
করোনা সংক্রমণের মূল কারণ ছিল অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা। করোনা সংক্রমণ শুরু হয়েছে অনধিকার চর্চা করে একধরনের অনৈতিক গবেষণা করার স্পৃহা থেকে। মানুষের অসতর্কতা ও অনিয়ন্ত্রিত গবেষণাগার সেটাকে আলো-বাতাসে ছড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করেনি। অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচার, সর্বোপরি কোন কোন রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা ও উদাসীনতা কোভিড-১৯ কে ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বময়।
মানুষর নিজ নিজ পরিধির বাইরে চলে গিয়ে কদাচারী জীবন যাপন করে এবং তা করোনা সংক্রমণকে সাহায্য করেছে অনেক বেশীগুণ। বিশেষ করে সীমাহীন মাদকের ব্যবহার ও অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও সবসময় চাপের মধ্যে বসবাস করে যেসব সমাজের মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ দেখা দিলে মৃত্যুর কবল থেকে ফিরে আসার হার কম দেখা গেছে। হতাশা, অতি-ব্যস্ততা ও ক্রমাগত বিশ্রামহীনতা করোনা রোগীকে চিকিৎসা নিয়েও সেরে উঠতে দেয়নি।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর করোনায় মৃত্যুসংখ্যা দশলক্ষ পেরিয়ে ইতিহাসের একটি চরম ’পেইনফুল মাইলস্টোন’ ছুঁয়েছে। আ্রকান্তের হয়েছে সাড়ে তিনকোটিরও বেশী মানুষ। স্পেন, বৃটেন, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি ২য় ঢেউ সামলাতে নাজেহাল। দ্বিতীয়বার লকডাউনে যেতে নারাজ অনেক দেশের মানুষ। এ নিয়ে রাজপথে পুলিশের সাথে মারামারি, ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। ইতোমধ্যে চীনে আরেকটি নতুন ভয়ংকর রোগের সংক্রমণ শুরু হয়েছে।
বেকারত্ব ঠেকাতে প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধারা কর্মস্থলে ফিরে যেতে ব্যাকুল। কিন্তু বিমানের টিকিট পেতেই তারা গলদঘর্ম। সেখানে দেরীতে গিয়ে কাজ ফিরে পাবেন তো? তাঁরা দেখেছেন দেশে তাদের উপযুক্ত কাজ ও মজুরী পাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই ফিরে যেতে মরিয়া হয়েছেন তারা। তা না হলে বিশ্বের এই কঠিন সংকটের দিনে পরিবার ও জন্মভ’মির মায়া ছেড়ে কেউ কি বিদেশে যেতে চায়? টিকিট পেতে প্রবাসী কর্মীদের চাপ ও ঢেউ যেন মতিঝিল অফিস পাড়ার বড় রাজপথকে বিচলিত জনতার সুনামীতে রূপ দিয়েছে।
চারবার বন্যা হতে দেখেনি উত্ত্রের মানুষ। রংপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রের বাসাবাড়িতে ঘরের মধ্যে একবুক পানিতে খাট-বিছানা বালিশ নৌকার মত ভেসে বেড়াচ্ছে-এমন দৃশ্য নিকট অতীতে কেউ দেখেনি। সে দৃশ্য আবার শরৎকালের শেষে।
তৃতীয়বার ধানের চারা লাগানো হলেও চতুর্থবারের বন্যার পর নতুন ধানের চারা তৈরী করার উপায় বা সময় কোনটাই যে আর নেই! সে অবস্থা অনুভব করে হয়তো সরকার দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করেছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও অনেক বিশেষজ্ঞ ভেবেই বলছেন- দুর্ভিক্ষ হবার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। খাদ্য বাণিজ্য নিয়ে রাজনীতি শুরু হলে সামলাবে কীভাবে? খাদ্যপ্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা যেন বহুগুণ বেড়ে না যায় তার জন্য কোথাও কোন প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে কি?
টিকা বাণিজ্য নিয়ে অনেক দেশ গোপনে লাভের হিসেব কষছেন। নিজেদের ক্ষমতার দাপট বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন শক্তিধর দেশগুলো। ট্রায়াল ঘোষণা দেয়ার মাস পেরিয়ে গেল তবু টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে স্পুৎনিক-৫, সিনোভ্যাক, অক্সফোর্ড কারো কোন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না এখন। আগাম টাকা দিয়েও টিকা পাওয়া যাবে কি-না তা নিয়ে আমাদের সংশয় রয়েছে।
দিকে দিকে চরম স্বার্থবাদী চেতনার উন্মেষ করোনার নেতিবাচক ফল। ভোট পাবার জন্য মরিয়া হয়েছে ভোগবাদী নেতারা। মানুষের করুণ মৃত্যু তাদের প্রাণে দোলা দেয় না। তারা মাদক, ধর্ষণ, চুরি, দুর্নীতিতে গা ভাসিয়েছে এই কঠিন সময়েও। হার্ড-ইমিউনিটি আমাদের দেশে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, এই তত্ত্ব অনুযায়ী করোনা শুরুর ১ থেকে ৭৬ দিন পর সংক্রমণ বন্ধ হবার কথা ছিল। কিন্তু ১৯০ দিন পেরিয়ে গেলেও তার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সংক্রমণ ও মৃত্যু কোনটাই থামেনি। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে শীতকালে মৃত্যু-সুনামী লোকালয়ে ঢুকতে দ্বিধা করবে না বলে মনে হয়।
এখন দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে তার সাথে আরো অনেক হিসেব-নিকেশ জড়িত হয়ে পড়বে। তাই এই ঢেউ সুনামীতে রূপ নিয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরী হতে পারে। বিশেষ করে খাদ্য, চিকিৎসা ও ক্ষমতার মেরুকরণের অনৈতিক চেষ্টাগুলো মানুষের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
আর যাই হোক্, বাংলাদেশে ২০ লাখ মানুষকে কোনভাবেই করোনায় মরতে দেয়া যাবে না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হুশিয়ারী মিথ্যা প্রমাণের জন্য এক্ষুণি আমাদেরকে সতর্ক হয়ে কাজে নামতে হবে। সবাইকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে আমরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে সুনামীতে পরিণত হতে দেব না।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য