পিঞ্জর ছেড়ে পাঁজরে বসতি ও ভিন্নরকম চ্যালেঞ্জ
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
কর্মীদের অদক্ষতায় কোভিড-১৯ নামক ভয়ংকর অণুজীবটি গবেষণাগারের নিরাপত্তা পিঞ্জর ছেড়ে মানুষের পাঁজরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে ২০১৮ সালে। খুব গোপনীয়তার মধ্যে করোনা ভাইরাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দেশে গবেষণা কার্যক্রম চলে আসছিল। চীনের উহানে নির্জন ল্যাবরেটরীতেও করোনা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা কার্যক্রম চলার মধ্যে একদিন দুর্ঘটনা ঘটে। এই সুযোগে পরীক্ষণপাত্রের নিরাপত্তাবেষ্টনী থেকে মুক্ত বাতাসে বের হয়ে পড়ে ক্ষুদ্র প্রোটিনের অনুজীব। এক সময় পরীক্ষারত কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে ওদের শরীরে মিশে যায়। এ নিয়ে একজন ডাক্তার সতর্কবাণী করেছিলেন। কিন্তু তাকে পুলিশের মাধ্যমে নজরদারিতে রাখা হয়। পরবর্তীতে তথ্য ফাসের জন্য দীর্ঘদিন জেল খেটে সেই আক্রান্ত চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছিলেন। অবশ্য চীনা কর্তৃপক্ষ এই দুর্ঘটনার কথা স্বীকার করতে নারাজ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য শুরু থেকেই চীনা কর্তৃপক্ষকে এককভাবে দায়ী করে আসছিল। এজন্য তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে চীনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এজন্য জার্মানীও চীনকে দায়ী করেছে। এভাবে পারস্পরিক দোষারোপ চলছেই।
পৃথিবীর সাধারণ বিপর্যস্ত মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির মধ্যে রাজনীতি ঢুকে গেছে বলে ভুক্তভোগী মানুষ ভাবছে- করোনা সংক্রমণ নিয়ে পাটা-পুতোয় ঘষাঘষি চলছে, মরিচের দফা রফা হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার সঠিক প্রমাণ নিয়ে আজও বাকযুদ্ধ থেমে নেই। চীন বলছে তারা বাদুড়ের করোনা নিয়ে গবেষণা করছিল। এটা বাদুড়ে সংক্রমিত। এই ভাইরাস মানুষের চেয়ে ২০ ভাগ কম সংক্রমণ ছড়ায়।
করোনা একটি ক্ষুদ্র প্রোটিন, যা খালি চোখে দেখা যায় না। এটা বিটা ভাইরাস। সাধারণত: ভাইরাস হলো একটা অকোষীয় রোগ সৃষ্টিকারী বস্তু বা অতি ক্ষুদ্র জৈব কণা বা অণুজীব যা জীবিত কোষের ভেতরেই মাত্র বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। জীবদেহ ডিএনএ, আরএনএ ও নিউক্লিক এসিড দিয়ে গঠিত প্রোটিন। ভাইরাসের সুনির্দিষ্ট কোন কোষ নেই। কিছু ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে। এদেরকে ‘ব্যাকটেরিওফেজ’ বলা হয়। উদ্ভিদ ও প্রাণিদেহের মধ্যে বহু রোগ সৃষ্টিকারী উপাদান হলো ভাইরাস। তাই এটাকে নীরব ঘাতকও বলা হয়।
এরপর চীন থেকে ইটালী। ইটালীর সংক্রমণের মাত্রা ও মৃত্যুর ভয়াবহতা সারা বিশ্বকে ভয়ে জর্জরিত করে তুলেছিল। ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকায় এর সংক্রমণ প্রসারিত হতে বেশীদিন লাগেনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করোনা সংক্রমণকে উড়িয়ে দিয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প মাস্ক পরতে অনীহ ছিলেন। মার্কিনীরাও একে তেমন একটা আমলে নেয়নি। ফলে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী সংক্রমণ ও বেশী মৃত্যুর শিকার হয়েছে তারা। করোনা সংক্রমণের পাঁচ মাস গত হলেও উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় করোনা থামার কোনো লক্ষণ নেই। জুলাই ২২ তারিখে প্যান-আমেরিকান স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনা ভাইরাস থামানোর জন্য নানা বিধিনিষেধ মানার পরও থামানো যাচ্ছে না সংক্রমণ। ওয়ার্ল্ডো মিটারের তথ্যমতে, জুলাই ২৭ তারিখ পর্যন্ত সারা বিশ্বে এক কোটি পঁয়ষট্টি লাখ উনচল্লিশ হাজার সাতশত পঁয়তাল্লিশ জন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর মৃত্যু হয়েছে ছয় লাখ চুয়ান্ন হাজার একশত উনচল্লিশ জন। সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে এ পর্যন্ত ৪৪ লক্ষ লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার মানুষ।
মার্কিন যুক্তরাষ্টের পর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসেনারো করোনা সংক্রমণ নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছিলেন। তিনিও মাস্ক পরতে অনীহ ছিলেন। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর তাদের দেশেই সবচে বেশী সংক্রমণ, বেশী মৃত্যু হচ্ছে। ওয়ার্ল্ডো মিটার তথ্যমতে, জুলাই ২৭ তারিখ পর্যন্ত ব্রাজিলে ২১ লাখের বেশী করোনা শনাক্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ৮৭ হাজার একশত একত্রিশ জন। ভারতে ২৭ তারিখ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, এগার লাখ পঞ্চান্ন হাজার একশত একানব্বই জন, মারা গেছেন তেত্রিশ হাজার চারশত আচচল্লিশ জন।
বাংলাদেশে ২৭ তারিখ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, দুই লাখ ছাব্বিশ হাজার দুইশত পঁচিশ জন। মারা গেছেন দুই হাজার নয়শত পঁয়ষট্টি জন। এই মুহূর্তে দুই আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশী ভয়াবহ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
পৃথিবী থেমে গেছে করোনাভয়ে। আতঙ্কিত মানুষ গৃহবন্দী হয়ে চুপষে গেছে। যতদুর জানা যায়- এর আগে প্রাকৃতিক কোন ঘটনা বা রোগের সংক্রমণে এত বেশী ভয় পেয়ে পৃথিবীর মানুষ কোনঠাসা হয়ে জীবন-যাপন করেনি।
করোনাকালের অনেক নেতিবাচক ঘটনার মধ্যে প্রথম কয়েক মাসের মধ্যেই কিছু ভাল সংবাদও শোনা গিয়েছে। শব্দহীন, দূষণহীন, কম্পনহীন নীরব পৃথিবীতে প্রাকৃতিক সজীবতার আভরণ লক্ষ্য করা গেছে। দু’একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে বলা যায়, চারদিকে সুনসান নীরবতার মাঝে বন্যপ্রাণীরা নির্ভয়ে চলাচল করার সাহস পেয়েছে। কোথাও কোথাও তারা লোকালয়ের দিকে চলে এসেছে।
করোনাকালে পৃথিবীর জন্য নতুন সুসংবাদ হলো- বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) জানিয়েছে যে, ওজোন ছিদ্র বন্ধ হয়ে গেছে। ক্রমাগত ক্ষতিকর গ্যাস বৃদ্ধির প্রভাবে ২০১১ সালের পর থেকে পৃথিবীর ওজোন স্তরে বৃহত্তর ক্ষতের সন্ধান দেখা দিয়েছিল। বরফে ঢাকা উত্তর মেরুর আকাশে ওজোন স্তরে এক মিলিয়ন বা দশ লাখ বর্গ কিলোমিটারের একটি বিশাল গর্ত তৈরীর কথা জানিয়ে ২০২০ সালের এপ্রিলের শুরুতে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কার কথা প্রকাশ করলেও পরে সেটা আর দেখা যায়নি। করোনার প্রভাবে কল-কারখানা, বিমান চলাচল ও নানা ধরনের ক্ষতিকর কর্মযজ্ঞ বন্ধ থাকায় সেই ক্ষতচিহ্ন মিলিয়ে গিয়ে একবারে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। এটা পৃথিবীর জন্য নতুন সুসংবাদ।
করোনার প্রভাবে অতিরিক্ত কার্বন নি:সরণকারী দেশসমূহ লকডাউন করায় তাদের ভারী যন্ত্রপাতি ও কল-কারখানা বন্ধ ছিল। এর ফলে তেল ও গ্যাসের চাহিদা অভূতপূর্বভাবে হ্্রাস পেয়েছে। আন্তর্জাতিক জ¦ালানী সংস্থা (আইইএ) আভাষ দিয়েছে করোনার বছরে বিশ্বব্যাপী জ¦ালানী ব্যবহার আট শতাংশ কমে যাবে। এজন্য দূষণের মাত্রা কম হবার ফলে ওজোন স্তরের ক্ষত হবার সম্ভাবনা কমে যাবে। এছাড়া কপারর্নিকাস এ্যাটমোসফেয়ার মনিটরিং সার্ভিস (সিএএমএস) ও কপারর্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (সি৩এস) বায়ুমন্ডলের সাম্প্রতিক কিছু ছবি প্রকাশ করে নিশ্চিত করেছে যে, ‘নিজের ক্ষত নিজেই সারিয়ে তুলছে পৃথিবী’।
অপরদিকে করোনার নেতিবাচক প্রভাবে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিচ্ছে অনেক অসহায় মানুষ। করোনা সংক্রমণের পাঁচ মাস গত হলেও উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সাথে সারা পৃথিবীতে করোনাতঙ্ক থামার কোনো লক্ষণ নেই। বরং দিন দিন আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। সাথে বেড়েছে অপরাধ, হিংস্রতা ও নির্মমতা।
তবুও চারদিকে সবকিছু গেল গেল বলে মহারোল শুরু হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস, জলাবদ্ধতা, পঙ্গপাল, দাবানল, বজ্রপাত, ইত্যাদির সাথে যুক্ত হয়েছে মানবসৃষ্ট অপরাধ, সহিংসতা, জালিয়াতি, প্রতারণা ইত্যাদি। মানবতা যেন ধূলোয় মিশে তলানিতে হারিয়ে গেছে।
অনেকে বলছেন, করোনার কদর্য সময়টাতে মানুষের কোন মহাপাপে মহাচাপ শুরু হয়েছে কি? পাপের কারণে পৃথিবীতে মহামারীর আগমন ঘটে বলে ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল নানা তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে। সীমা লঙ্ঘণকারী বহু মানুষের বেপরোয়া জীবন-যাপন, জালিমের অন্যায় অবিচার, অবাধ যৌনাচার ইত্যাদি কারণে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আ’দ ও সামুদ জাতির ঘটনা অথবা ইটালীর পম্পেই নগরীর ধ্বংসের ঐতিহাসিক ঘটনা এগুলোর মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করেছে। কিছু মানুষ নৈতিকতা বিবর্জিত আচরণ শুরু করে দুর্নীতিকে শিল্পে পরিণত করে ফেলেছে। পাপ কাজকে ঘৃণা না করে বরং সাধারণ বিনোদন মনে করছে। তাই এদেরকে প্রাকৃতিকভাবে পাকড়াও করার সময় ও চাপ এসে গেছে।
এভাবে মানুষের অবহেলা, অসতর্কতা, লোভ-লালসার কারণে অনৈতিক কর্মকান্ড নিত্যনতুন স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলে মানব সভ্যতাকে যুগে যুগে বিপদে ফেলেছে। এটাই হয়তো পাপ ও চাপের এক ধরনের ব্যাখ্যা হাজির করতে পারে। কিছু লোভী মানুষের আক্রমণাত্মক ও ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারা অনৈতিক গবেষণাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে উৎসাহ যুগিয়েছে। একথা অনস্বীকার্য যে সেসব গবেষণার বেশীরভাগই মানব সভ্যতার উপকারের চেয়ে অপকার ডেকে এনেছে। জীবাণু অস্ত্রের গবেষণার প্রতিযোগিতা এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের কথা নিয়ে ব্যাপক তোড়জোর শুরু হয়ে গেছে।
এরপর অনলাইনে সব কিছু সমাধানের প্রয়াসও লক্ষ্যণীয় বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ শক্তির অতি ব্যাপক ব্যবহা রের যুগ শুরু হয়ে গেছে। পনের বছর আগে অনলাইন বলে কোন কিছু ছিল না। পৃথিবীর সবকিছু অনলাইনের মাধ্যমে চালু হয়ে গেলে দৈনিক যে পরিমাণ শক্তি খরচের প্রয়োজন সেটার আঞ্জাম দেয়ার মত ক্ষমতা ও দূরদর্শী পরিকল্পনা সব দেশের সব মানুষের আছে কি-না তা এখনও কেউ পর্যালোচনা করেছেন বলে জানা যায় নি।
বিশ্বব্যাপী শিক্ষার ক্ষেত্রে অনলাইন সমাধান খোঁজার চেষ্টা শুরু হয়েছে। অফিস-আদালতের সিদ্ধান্ত গ্রহণের হচ্ছে মিটিং শুধু ভার্চুয়াল। এভাবেই সমাধান খোঁজার চেষ্টা। নিত্যপণের কেনাকাটা, জানাজা, বিয়ে কোরবানি সবকিছুই অনলাইনে শুরু হয়ে যাওয়ায় ভার্চুয়াল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বিশ্বের মানুষ।
করোনা সংক্রমণের প্রথম পাঁচ মাসেই মানুষ মরতে শুরু করেছে হাজারে হাজারে, লাখে লাখে। মৃত্যুভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়েছে দিকে দিকে। বড় লোকদের মৃত্যুর হিসেব রাখা হচ্ছে সরকারী খাতায়। কারণ, আক্রান্ত হয়ে তারা হাসপাতালে ঠাঁই নিতে পেরেছে। দরিদ্র মানুষ কারানার নমুনা টেষ্ট করতে সাহস করেনি। অর্থ ও অন্যান্য সামর্থ্য নেই তাদের। উপসর্গ নিয়ে মৃতদের মৃত্যুর সব হিসেব সরকারী খাতায় নেই।
ডাক্তার, পুলিশ, নিরাপত্তাকর্মীদের ব্যাপক সংক্রমণ, বেশী মৃত্যু সবাইকে হতচকিত করে দিয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীতে ভেজাল, দুর্নীতি, লুটপাট শুরু হয়েছে। এজন্য মামলা, তদন্ত, জেল জরিমানা ও দোষারোপের ঘৃণ্য রাজনীতি শুরু হয়েছে।
করোনার দুর্বল সময়ে প্রতারণামূলক কাজের মাধ্যমে নৈতিকতার চরম ধ্বস, চরম অবক্ষয় শুরু হয়েছে। রিজেন্ট-জে.কে.জি. হাসপাতালের ভুয়া করোনা সনদ বিক্রির মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ধরা পড়েছে। ওদের ভুয়া করোনা সনদ কিনে ধরা পড়ে ইটালী থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীসহ বিমান ফেরত এসেছে। বৈশ্বিক করোনার ভুয়া সনদ বিকিয়ে বৈশ্বিক লজ্জা দিয়েছে সাহেদ গংরা। দুর্নীতিতে বাংলাদেশকে ও প্রবাসী বাংলাদেশীদেরকে ঘৃণা ও চরম লজ্জায় ফেলে দিয়েছে সাহেদ-আরিফ-সাবরিনারা। এ লজ্জা ঢাকার চাদর নেই কারো।
বেকারত্ব বৃদ্ধি সারা বিশ্বে। জুন মাস জুড়ে আমেরিকায় ফ্লয়েড হত্যা ও বর্ণবাদী বিদ্রোহ চলেছে। জুলাই মাসের শেষদিকে এসে পর পর তিনদিন দৈনিক এগারশত জনের মৃত্যুর ঘটনা দেশটিকে আরো বেশী সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। চীন, ইটালী সহ অনেকে দেশে করেনার প্রাদুর্ভাব কমে এলেও নতুন করে পুনরায় সংক্রমণের মাত্রাবৃদ্ধি ও মৃত্যু ঘটনা ঘটায় আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে।
কর্মহীন ও ছাঁটাইকৃত প্রবাসীরা প্রতিদিন আমাদের দেশে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে বড় বড় শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটছে কর্মহীন অসহায় মানুষ। এই কঠিন করোনাকালে কৃষি ছাড়া অন্যকিছুকে সম্বল ভাবতে পারছেন না তারা। কৃষিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে সেসব মানুষকে।
করোনার মধ্যে শুরু হয়েছে বন্যা। জুলাই ২৭ তারিখের তথ্য অনুযায়ী দেশের একত্রিশটি জেলায় বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বসতবাড়ি, ফসল, বাজার-ঘাট সবকিছু। উত্তরের তিস্তা নদীতে এ বর্ষার মধ্যে পর পর তিনবার পানি বৃদ্ধি হয়েছে। তিস্তা নদীর পানি (জুলাই ২৪, ২০২০) গত একশত বছরের মধ্যে সর্বচ্চো বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। একই দিনে যমুনায় পানি বৃদ্ধির ফলে শেরপুর, জামালপুর, সিরাজগঞ্জসহ দেশের মধ্যাঞ্চল তলিয়ে গেছে এবং মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় এসইএসডিপি উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি সুদৃশ্য বৃহৎ তিনতলা ভবন পদ্মা নদীতে বিধ্বস্ত হয়ে ডুবে গেছে। চাঁদপর জেলার সদর উপজেলায় উদ্বোধনের পূর্বেই ২ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা ব্যায়ে নবনির্মিত রাজারাজেশ্বর ওমর আলী হাইস্কুল ও সাইক্লোন শেল্টার কেন্দ্র মেঘনা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
করোনার মধ্যে এসেছিল কান্নাভেজা রমজানের ঈদ। রোজার ঈদে শহর ছেড়ে করোনার গ্রামের বাড়ি যাত্রার মহাব্যবস্থা। আগামী আগষ্টের ১ তারিখে উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে পবিত্র ঈদুল আযহা। কোন জৌলুষ নেই ঈদের বাজারে। কোরবানির হাটে পশু কেনাকাটায় মানুষ শারিরীক দূরত্ব মানতে পারবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কৃষক ও ফড়িয়া-দালালরা অনলাইনে পশু কেনাবেচার কৌশল ও নিয়ম না জানায় ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হতে পারেন। কোরবানির ঈদে বন্যা ও কান্নার ভিন্নরূপে ত্যাগের মহিমা সমুজ্জল রাখাটা অনেকের জন্য কঠিন হয়ে আসায় এ ঈদটাও ফিকে হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
এমতাবস্থায় ধনীদের অনলাইন জীবন। দুস্থ:-ভিখারীর অফলাইন জীবন। মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে না পারলে তাদের ভাতে মরণ হবার যোগাড় হয়েছে। ধনীদের উচিত দুস্থ:-ভিখারীদের দিকে সুদৃষ্টি দেয়া। তাদেরকে এই বিপর্যয়ের সময়ে মরণাবস্থা থেকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসতে হবে। তাদের প্রতি সদয় আচরণ করতে হবে।
চারদিকে এতো মৃত্যু। করোনা বড়লোকদের অসুখ। করোনা আরবান ডিজিজ। শহরের মানুষ বেশী মারা যাচ্ছে।
লকডাউন শহরে, রেড এলার্ট শহরে। জীবন যন্ত্রণাও শহরে বেশী। মধ্যবিত্তের বিড়ম্বনা ও মহাবিপদ। ভাড়া কমিয়ে দিয়েও শহরে বাড়িভাড়া নেয়ার মানুষ নেই।
করোনা প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আশা ৬ মাস ধরে শুনেছি, আজও শুনছি। এখনও টিকার যাদুকর নেই, যাদুকরী সমাধানও নেই। জুলাই ২২, ২০২০ তারিখে অক্সফোর্ডের আবিষ্কৃত টিকার সফলতা দাবী করে সংবাদ সম্মেলণ করা হয়েছে। খুব শীগগির বাজারে না এলেও অক্সফোর্ডের আশার বাণী এই মুহুর্তে মানুষকে কিছুটা আশার আলো দেখালেও বিশ্বস্বাস্থ্য এখনও এ ব্যাপারে সাড়া দেয়নি।
এ যাত্রায় বেঁচে গেলে নতুন এক পৃথিবী দেখবে মানুষ। এ সংকটের সময়ে আমি কারো ঋণী হতে চাই না। কিন্তু করোনা মানুষকে কারো না কারো কাছে ঋণী বানিয়ে ছাড়ছে। বিশেষ করে আপনজনরা যখন করোনাভয়ে আপনজনকে ফেলে পালিয়ে যেতে দ্বিধা করে না, তখন কী যে হয় মানবতার!
অন্যরকম এক সময়ে মানুষ আজ। ভয়ংকর অণুজীবটি পিঞ্জর ছেড়ে মানুষের পাঁজরের মধ্যে ঢুকে বসতি গেঁড়েছে। একটি কার্যকরী টিকার সন্ধান কবে আসবে সবাই তার অপেক্ষায় দিন গুজরান করছে। ততদিন নিউ নর্মাল জীবনে অভ্যস্ত হবার জন্য মানুষকে ভার্চুয়ালি আহবান করা হচ্ছে। তবে যাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য কোন উপায় নেই তারা কীভাবে নর্মাল জীবন খুঁজে পাবেন সেটা বলা মুষ্কিল! ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে এসকল সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরী করছে। এসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বিশ্বের মানুষ তাদেরকে অভিযোজন লাভের অনুষঙ্গ সরবাহ করতে না পারলে তাদের জন্য নতুন স্বভাবিক জীবনে উপনীত হবার আশাটা কি শুধু শুধুই উপহাস করে যাবে? যেমন- দরিদ্র শিক্ষার্থীদেরকে অনলাইন শিক্ষার উপকরণ হাতে তুলে দিতে না পারাটা নিউ নর্মালের চেয়ে নিউ এ্যাবনর্মাল পরিস্থিতি বা এক ধরনের সামাজিক বৈষম্য এনেছে বৈ কি?
অর্থাৎ, হঠাৎ একটা প্রচেষ্টা যেন আরেকটা সমস্যার বীজ বপন করে না ফেলে সেজন্য আমাদের সতর্ক পদযাত্রা নেয়াটা আশু জরুরী। যা সদাই একটি নতুন চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। করোনা সংক্রমণ শুরু হবার মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই এতা কিছু ঘটে গেছে এবং যাচ্ছে এই সুন্দর পৃথিবীটাতে। করোনার এই কদর্য সময়টা অনেক দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে বহু বিজ্ঞজন ইতোমধ্যে আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন। তাই পরের দিনগুলোর কথা পরে আরো অনেক বেড়ে যেতে পারে। অনাগত সেই দিনগুলো হয়তো আরো ভিন্নরকম হতে পারে।
একটা ভয়ংকর অন্যরকম সময়ে ভিন্নরকম কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ মানুষের জন্য প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে এবং হবে। এবারে করোনার মধ্যে প্রলয়ংকারী বন্যায় দেশের ৪০ ভাগ পানির নিচে ডুবে গেছে। এর মধ্যেই অশ্রুভেজা কোরবানির ঈদ সমাগত। ত্যাগ ও কষ্টের এ কঠিন পরীক্ষার মধ্যেই নাজেহাল মানুষের ভবিষ্যতের ঘরকন্না চলবে। কতদিন সেটা চালাতে হবে এখনও কেউ বলতে পারছেন না। আশাকরি সেই দিনগুলো অনেক ভাল হোক।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য