নাটোর রাজবাড়িতে ‘রাজকন্যা’
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ।।
রাজবাড়ি ঘুরে দেখানোর জন্য টমটমওয়ালারা যখন হাঁক ছেড়ে ডাকছিলেন, তখন সুমনা ভট্টাচার্য্যের মানসপটে ভেসে ওঠে শৈশবের স্মৃতি। রাজা বীরেন্দ্রনাথ গাইতেন, ‘কাদের কুলের বউ গো তুমি কাদের কুলের বউ...’। আর তার ছোট্ট নাতনি সুমনা শাড়ি পরে গানের সুরে সুরে ঘুরে ঘুরে নাচত।
আজ আর সেই রাজা নেই। রাজ্যও নেই। তবে রাজবাড়ি আছে। আর আছে সেই নাতনি। সেই সুমনার বয়স এখন ৭৭ বছর। থাকেন সুইডেনে। সেখান থেকেই ছুটে এসেছিলেন রাজার স্মৃতিবিজড়িত নাটোরের রাজবাড়িতে। হৃদয় খুঁড়ে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ালেন সারা দিন। কোনো টমটমে উঠলেন না। পায়ে হেঁটেই গেলেন নাটোরের ছোট তরফের শেষ রাজা বীরেন্দ্রনাথের রাজবাড়ির সামনে। কিন্তু রাজবাড়ির দরজা বন্ধ ছিল। এত দূর থেকে এসেও বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারলেন না।
একটি ভবনের দেয়ালে দেখলেন, এখনো ছোট তরফের শেষ রাজা ও রানির ছবি টাঙানো রয়েছে। ছবির নিচে লেখা রয়েছে ‘মহারাজা বীরেন্দ্রনাথ রায়বাহাদুর’। রানির ছবির নিচে লেখা ‘রাণী তারা দেবী’।
১৮০২ সালে রানি ভবানীর মৃত্যু হলে তাঁর দত্তকপুত্র রামকৃষ্ণের দুই পুত্র বিশ্বনাথ ও শিবনাথের মধ্যে জমিদারি ভাগাভাগি হয়। বড় ছেলে বিশ্বনাথের অংশের নাম হয় বড় তরফ। ছোট ছেলে শিবনাথের অংশের নাম হয় ছোট তরফ। সেই থেকে তাঁদের উত্তরাধিকারীরা ছোট তরফ ও বড় তরফ নামে জমিদারি পরিচালনা করেন। নাটোর রাজবংশের ছোট তরফের শেষ রাজা ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ (১৮৯৭-১৯৫৫)। আর বড় তরফের রাজা ছিলেন যোগীন্দ্রনাথ (১৮৮৬-১৯৮১)। দেশভাগের সময় তাঁরা ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারি প্রথা বাতিল করলে তাঁরা রাজ্য হারান। তাঁরা নাটোরের রাজবাড়ির মতো করেই কলকাতায় আরেকটা রাজবাড়ি করেছিলেন। সেই বাড়িকেও তাঁরা নাটোরের রাজবাড়িই বলতেন। কলকাতায় ছোট তরফের সেই বাড়িতেই নাতনি সুমনার সঙ্গে মজা করতেন রাজা বীরেন্দ্রনাথ।
৯ মার্চ রাতে রাজশাহী পর্যটন মোটেলে বসে কথা হয় সুমনা ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে। এ সময় তাঁর ছেলে গৌতম ভট্টাচার্য্য সঙ্গে ছিলেন। গৌতম দিল্লিতে নিযুক্ত সুইডেনের উপহাইকমিশনার। মাকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন রাজবাড়ি দেখাতে। ৮ মার্চ তাঁরা নাটোরের রাজবাড়ি দেখতে গিয়েছিলেন। ৯ মার্চ পুঠিয়া রাজবাড়ি দেখেছেন।
কথায় কথায় সুমনা বললেন, ‘সব স্মৃতি এখনো মনে জ্বলজ্বল করছে। একবার রাজা বীরেন্দ্রনাথ আমার হাতে একটা জিনিস দিয়ে বলেছিলেন, “এ হচ্ছে নাটোরের রাজবাড়ির ঝাড়বাতির হিরের একটা টুকরো। তোকে উপহার দিলাম। তুই বড় হ। বড় হলে তোকে আমি বিয়ে করব।”’ সুমনা সেই উপহারটা এখনো রেখে দিয়েছেন। তবে বড় হয়ে জেনেছেন, সেই টুকরাটা নাটোরের রাজবাড়ির ঝাড়বাতির ঠিকই, তবে ওটা হিরের টুকরা নয়, কারুকার্যখচিত কাচের একটা টুকরা। নাটোরের রাজবাড়ি থেকে ঝাড়বাতি খুলে নিয়ে যাওয়ার সময় পড়ে যাওয়া কাচের টুকরা
তিনি দেখেছেন, বড় তরফের শেষ রাজার কলকাতায় যে বাড়ি ছিল, সেখানে হাতির দুটি পা রাখা ছিল। রাজার একটা পাগলা হাতি ছিল। সেই হাতি খেপে গিয়ে মাহুতকে পায়ের তলায় পিষে মেরেছিল।
রাজা তখন তাঁর বন্দুক দিয়ে হাতিটাকে গুলি করে মেরেছিলেন। মারার পর হাতির পা দুটি কেটে রেখে দিয়েছিলেন। সুমনা কলকাতার বাসায় দেখেছেন তা। সুন্দর করে চামড়ায় মোড়ানো হাতির পায়ের ভেতরে রাজা ছাতা রাখতেন।
সুমনা ভট্টাচার্য্য রাজবাড়ির বংশলতিকা অনেক দূর পর্যন্ত বলতে পারেন। বংশের অনেকের নাম তাঁর মুখস্থ। তাঁর মা কমলা দেবী ছিলেন শেষ রাজা বীরেন্দ্রনাথের বোন সুরুচি দেবীর মেয়ে। সেই সূত্রে সুমনা শেষ রাজা বীরেন্দ্রনাথের নাতনি। সুরুচি দেবী ও বীরেন্দ্রনাথের বাবা ছিলেন রাজা জিতেন্দ্রনাথ। জিতেন্দ্রনাথ (১৮৭৪-১৮৯৫) খুবই অল্প বয়সে মারা যান। সেই সময় রাজ্যের হাল ধরেছিলেন তাঁর স্ত্রী, অর্থাৎ বীরেন্দ্রনাথ ও সুরুচি দেবীর মা হেমাঙ্গিনী দেবী। সুমনা ভট্টাচার্য্য এই হেমাঙ্গিনী দেবীকেও দেখেছেন। চেহারাও মনে আছে। ছোটখাটো মানুষ ছিলেন, কিন্তু যেমন সুন্দরী তেমনি তেজস্বিনীও। দক্ষ হাতে তিনি রাজ্য চালিয়েছেন। রাজস্বের হিসাব নেওয়ার সময় যখন কলকাতা থেকে নাটোরে যেতেন, তখন একটা পর্দা টাঙিয়ে দেওয়া হতো। পর্দার আড়াল থেকে হেমাঙ্গিনী দেবী কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলতেন। এই হেমাঙ্গিনী দেবীকে সুমনারা বুজুমা বলে ডাকতেন।
দিদিমা সুরুচি দেবীর বোনের সঙ্গে আবার পুঠিয়ার চার আনার রাজার বিয়ে হয়েছিল। এ জন্য পুঠিয়ার রাজবাড়িও তাঁর দিদিমার স্মৃতিবিজড়িত। পুঠিয়ার রাজবাড়ির অনেক স্মৃতিকথাই দিদিমার মুখ থেকে শোনা। এ জন্য তাঁরা পুঠিয়ার রাজবাড়িতেও গিয়েছিলেন। সেদিন দোল উৎসব চলছিল। দিদিমার মুখে গোবিন্দমন্দিরের অনেক কথা শুনেছেন। সেই মন্দিরের সামনে যখন গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তখন পূজারি এসে তাঁর হাতে প্রসাদ তুলে দিলেন। তখন তিনি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
সুমনা বললেন, আগে তাঁদের পরিবারের মেয়েদের রাজপুত্রের সঙ্গেই বিয়ে দেওয়া হতো। তাঁর দিদিমা ছিলেন রাজকুমারী। তাঁর বিয়ে হয়েছিল ভারতের হাওড়ার বালি শহরের এক জমিদার বাড়িতে। প্রথম তাঁর মায়ের বিয়ে হয় রাজবাড়ির বাইরের লোকের সঙ্গে। তাঁর বাবা অমরনাথ লাহিড়ী লন্ডনপ্রবাসী বাঙালি ছিলেন। পেশায় ছিলেন একজন প্রকৌশলী। সুমনার স্বামীও ছিলেন একজন প্রকৌশলী। শ্বশুর হরিদাশ ভট্টাচার্য্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক। বিয়ের পর সুমনা ২১ বছর বয়সে স্বামীর সঙ্গে সুইডেনে পাড়ি জমান। সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
সুমনা ভট্টাচার্য্য বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (শান্তিনিকেতন) থেকে সংস্কৃত বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। শিক্ষক হিসেবে সৈয়দ মুজতবা আলীকে পেয়েছিলেন। তিনি তাঁদের জার্মান ভাষা পড়াতেন। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি ঘটনার কথা বললেন, চিরকুটে মুজতবা আলী তাঁকে নাকি একটি কবিতার দুটি লাইন লিখে দিয়েছিলেন। স্মৃতি হাতড়ে সেটিও মনে করলেন। লাইন দুটি এ রকম, ‘মনের ভেতর তালাচাবি দিয়া, রাখিনু তোমারে, থাক মোরে নিয়া, হারায়ে গিয়াছে চাবিটি তাহার, নিষ্কৃতি তব নাই নাই আর।’
নিজ বংশের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িঘর দেখে কী মনে হলো? সুমনা ভট্টাচার্য্য বললেন, ‘খুব খারাপ লাগল, রাজবাড়ির আঙিনাকে পিকনিক স্পট বানানো হয়েছে। একসঙ্গে পাঁচটা পিকনিক পার্টি মাইক বাজাচ্ছে। এরা জায়গাটা নষ্ট করে ফেলবে। এটা ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা দরকার।’ জানালেন নাটোরের লোকজন পরিচয় পেয়ে তাঁদের অনেক সমাদর করেন। রাজবাড়ির অনেক গল্প শুনিয়েছেন, খুব ভালো লেগেছে।
ফেরার সময় রাজবাড়ির আঙিনা থেকে একটি ছোট্ট পাথরের টুকরা সঙ্গে নিয়েছেন সুমনা ভট্টাচার্য্য। ‘রাজবাড়ির স্মৃতি হিসেবে এটাই সুইডেনে নিয়ে যাব।’
কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো
সাম্প্রতিক মন্তব্য